• আফগানিস্তানের বাংলাদেশ সফর ২০২৩
  • " />

     

    ম্যাচ উইনারের পালাবদলে টি-টোয়েন্টির বাংলাদেশের দিন বদল

    ম্যাচ উইনারের পালাবদলে টি-টোয়েন্টির বাংলাদেশের দিন বদল    

    'লুজার, লুজার', হঠাৎ কানে ভেসে এল তুমুল চিৎকার। 

    আফগানিস্তানের লোকজনদের সাজসজ্জা আর চেহারা দেখেই আলাদা করে ফেলা যায়। সঙ্গে পতাকা থাকলে তো আর হলোই! আফগান হাতেগোনা কয়েকজন দর্শক জড়ো হয়েছিলেন সিলেট স্টেডিয়ামে দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে। ম্যাচে আফগানিস্তান তখন হারের শঙ্কায়। কোন এক সময়ে দেখা গেল, বাংলাদেশি এক সমর্থক দল 'লুজার, লুজার' চিৎকারে ব্যস্ত। আবার একটা-দুটো ডট বল হলেই আফগানিস্তানের এক সমর্থক এসে জবাব দিয়ে যাচ্ছেন, হাতের ইশারায় চুপ বলে! 

    গ্র‍্যান্ড স্ট্যান্ডে থাকা সেই আফগান গ্রিন গ্যালারীতে থাকা বাংলাদেশিদের লক্ষ্য করে কিছুক্ষণ পরপরই এই কাজে ব্যস্ত হচ্ছিলেন। দেখে মনে হচ্ছিল, পুরো মাঠের সঙ্গেই সেই গুটিকয়েক আফগানরা যেন লড়াইয়ে নেমে গেছেন। অবশ্য আদতে তো তারা শুধু প্রাণভরে উপভোগই করছিলেন। ম্যাচ শেষ হলে আফগানি সেই দর্শক মহলে যদিও নীরবতা নেমে আসে, দুয়েকজনকে মাথা নিচু করে বসে থাকতেও দেখা যায়। হারের হতাশা তখন জেঁকে বসেছিল তাদের। 

    আচ্ছা বাংলাদেশ যদি হারত, তাহলে কী বাংলাদেশি সমর্থকদেরও এভাবে নিরাশা গ্রাস করে বসত? সম্ভবত না। কারণ ওই, ফরম্যাটটা যে টি-টোয়েন্টি! যাতে আমাদের আশা-ভরসার পারদ থাকে একেবারে নিচের দিকেই। তার ওপর আফগানিস্তানের সবচেয়ে শক্তিশালী ফরম্যাট এই টি-টোয়েন্টিই। আফগানদের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে প্রথম সিরিজ জয়ও এলো সেদিনই। দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে ম্যাচের নায়ক? আর কে! সাকিব আল হাসান।

    তবে বাংলাদেশের এবছরের কুড়ি-বিশের কীর্তিতে কিন্ত শুধু সাকিবই একা ম্যাচ উইনার নন। আগের ম্যাচেই যেমন ম্যান অব দ্যা ম্যাচ হয়েছেন তাওহিদ হৃদয়, ৩২ বলে অপরাজিত ৪৭ রানের গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলে। এবছর বাংলাদেশ টি-টোয়েন্টিতে খেলেছে আরও দুটি সিরিজ। ইংল্যান্ড সিরিজের প্রথম ম্যাচে ম্যাচসেরা হয়েছিলেন নাজমুল হাসান শান্ত, ৩০ বলে ৫১ রানের ইনিংস খেলার সঙ্গে ৩টি ক্যাচও নিয়েছিলেন। সে সিরিজের দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে ম্যাচের নায়ক বনেছিলেন মেহেদী হাসান মিরাজ, ১২ রানে ৪ উইকেট নিয়ে পরে লক্ষ্যতাড়ায়ও অবদান রেখেছেন ১৬ বলে ২০ রান করে। সিরিজের শেষ ম্যাচে লিটনের ব্যাটে দেখা মিলেছিল ৫৭ বলে ৭৩ রানের এক জয়সূচক ফিফটি। 

    ইংল্যান্ডের পর আয়ারল্যান্ড সিরিজেও একই ধারা চলেছে। সেখানে প্রথম ম্যাচে ৩৮ বলে ৬৭ রানের উড়ন্ত ইনিংস খেলেই ম্যাচটা নিজেদের দিকে এনে ফেলেছিলেন রনি তালুকদার। দ্বিতীয় ম্যাচে সাকিবই হয়েছিলেন ম্যাচসেরা, ২৪ বলে অপরাজিত ৩৮ এর সঙ্গে ২২ রানে ৫ উইকেট নিলে আর কে হয় তা! তবে সে ম্যাচে ম্যাচ উইনিং পারফরম্যান্স এসেছিল লিটন-রনির ব্যাট থেকেও। ওপেনিং জুটিতেই বাংলাদেশ পেয়েছিল ১২৪ রান। ৪১ বলে ৮৩ রানের ইনিংস খেলেই তবে থেমেছিলেন লিটন। সিরিজের শেষ ম্যাচে বাংলাদেশ ছোট্ট ফরম্যাটটায় এই বছরের একমাত্র হার পেয়েছিল, তবে সে ম্যাচেও ৪২ বলে ৫১ রানের ইনিংস এসেছিল শামীমের ব্যাট থেকে। ১২৪ রানের পুঁজিটা যথেষ্ট হয়নি, তবে একসময় ৬১ রানেই ৭ উইকেট খুইয়ে ফেলা বাংলাদেশ তাতে যেতে পেরেছিল শামীমের ব্যাটেই। 

    ২০২৩ সালে যে তিনটি টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলেছে বাংলাদেশ, তাতে ম্যাচ সেরা হয়েছেনও ভিন্ন ভিন্ন তিনজন। আফগানিস্তান সিরিজে ৩৭ রান ও ৪ উইকেট নিয়ে সাকিবই সিরিজ সেরা। তবে ইংল্যান্ডের সঙ্গে ৩ ম্যাচে ১৪৪ রান করে ম্যান অব দ্যা সিরিজ হয়েছিলেন নাজমুল হাসান শান্ত, আয়ারল্যান্ড সিরিজে ৩ ম্যাচে ৮ উইকেট নিয়ে তাসকিন আহমেদ। 

    তার মানে কী দাঁড়ালো? প্রত্যেক জয়েই ভিন্ন ভিন্ন ম্যাচ উইনারের অধিকতর অবদান থেকেছে। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ছোট থেকে ছোট অবদানও অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। কিন্ত দিনশেষে যে ফরম্যাটে ধারাবাহিকতা ধরে রাখা বড্ড কঠিন, সেখানে ম্যাচ উইনারদের গুরুত্ব বেশিই দিতে হয়। একটা দলে যত ম্যাচ উইনারের সংখ্যা বেশি, তাদের সফলতা পাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে উপরের দিকে। ম্যাচ উইনারদের কাতারে যাদের ফেলা হয়, তারা জ্বলে উঠলে যে দলও এগিয়ে যায় অনেকটুকুই। বাংলাদশের সাত জয়ে দেখুন তো ভিন্ন ভিন্ন ছয়জন হয়েছেন ম্যাচসেরা। যা টি-টোয়েন্টির বাংলাদেশের বেলায় বড় সুসংবাদই বলতে হয়। একেক ম্যাচে দেখা মিলেছে একেকজনকে ম্যান অব দ্যা ম্যাচের পুরস্কার নিয়ে দাঁড়াতে। 

    টি-টোয়েন্টির বাংলাদেশের দিনবদলে এই ম্যাচ উইনারের পালাবদলই কিন্ত বড় কারণ। যে ফরম্যাটে জেতার খুব একটা আশা নিয়ে বাংলাদেশিরা খেলা দেখতে বসে না, সেখানে এবছরে ৮ ম্যাচেই মিলেছে ৭টি জয়। এর আগে এক বছরে বাংলাদেশ এর চেয়েও বেশি ম্যাচ জিতেছিল, তবে ২০২১ সালে সেই ১১ জয় পেতে খেলতে হয়েছিল ২৭ ম্যাচ। আরও একটি বছরে সাত জয় পেয়েছিল টাইগাররা, ২০১৬ সালে সেবার তা পেতে যদিও ১৬ ম্যাচের কম প্রয়োজন পড়েনি। 

    জয় ও হারের অনুপাত কিন্ত বাংলাদেশের এবছরেই সর্বোচ্চ। তা হচ্ছে ৭, অর্থাৎ এক হারের বিপরীতে ৭টি জয়। এর আগে সে অনুপাত ১.৩৩ (২০১৯ সালে) এর উপরেই যায়নি কখনো। একের উপরেই তো অন্য কোন বছরে থাকেনি। তার মানে, এক হারের বিপরীতে একটি জয়ের বেশি বাংলাদেশের ওই দুবছর ছাড়া আর কোন বছরেই আসেনি। সালটা টি-টোয়েন্টির বাংলাদেশের জন্য কতটা সাফল্যমন্ডিত, বুঝতেই পারছেন। কেউ কেউ তো দিন বদলের ছবিও দেখতে শুরু করেছেন। 

    সর্বদাই ম্যাচ উইনার সাকিব আল হাসান তো আছেনই, এখন যে তার সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন আরও কয়েক ‘ম্যাচ উইনার’!