• বিশ্বকাপ ২০১৪
  • " />

     

    একসাথে কাঁদা কিংবা উল্লাসের স্বপ্ন

    একসাথে কাঁদা কিংবা উল্লাসের স্বপ্ন    

    প্যাভিলিয়ন আয়োজিত স্পোর্টস ফিচার লেখা প্রতিযোগিতা 'খেলার লেখা, লেখার খেলা -২' এর দশজন বিজয়ীর লেখা ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে! আজ থাকছে সপ্তম স্থান অধিকারী মারুফ মুক্তাদির খান-এর লেখা ‘একসাথে কাঁদা কিংবা উল্লাসের স্বপ্ন’।

     

    [বিঃ দ্রঃ লেখাটি গত বছরের ফুটবল বিশ্বকাপের আগে লিখিত। লেখকের বর্ণনায় তাই সে আসরের সম্ভাবনার কথা উঠে এসেছে।]

     


     

    দেখতে দেখতে ২৮ বছর পেরিয়ে গেলো স্বপ্নের কাপ যায়নি বুয়েনস আয়ার্সে। ১৯৮৬ সালের পর বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজনও করেনি ল্যাটিন আমেরিকার কোন দেশ। গেলো ২৮ বছরের স্মৃতিচারণ খুব বেশি সুখকর নয় ম্যারাডোনা উত্তরসুরীদের। তবে এবারের ব্রাজিল বিশ্বকাপ নিয়ে কিন্তু স্বপ্নের জাল বুনছে আর্জেন্টাইনরা। তার সঙ্গে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা আর্জেন্টিনার শত-কোটি ভক্ত। এবার আবার দক্ষিণ আমেরিকায় খেলা, তৃতীয়বারের মতো কাপ নেওয়ার দাবিতো তাদের থাকবেই

     

    ১৩ জুলাই ২০১৪ তারিখে বিশ্বকাপ ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলের কাছে আর্জেন্টিনা হারবে বলে যে প্রতিবেদন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক গোল্ডম্যান সাচ তাকে মিথ্যা প্রমানের দ্বায়িত্ব কাধেঁ নিতে হবে মেসিকেই

     

    ২০ তম বিশ্বকাপের আয়োজক ল্যাটিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিল। তবে নিজ দেশের জনগণ আর প্রতিপক্ষকে একসঙ্গেই মোকাবেলা করতে হচ্ছে ব্রাজিলিয়ানদের। অন্যদিকে ল্যাটিন আমেরিকায় ভেন্যুর সুযোগ কাজে লাগিয়ে আবারো উন্মাদনায় মেতে উঠতে পারে বুয়েনস আয়ার্স। কারণ ল্যাটিন আমেরিকার কাপ যে ইউরোপে যায় না, সেটি কিন্তু প্রমানিত

     

    ৪ বছর আগে ফুটবল ঈশ্বর ম্যারাডোনার হাত ধরে হিতে বিপরীত হয়েছিলো নীল-সাদা জার্সির। ঈশ্বর হলেও সেরা ফুটবলার যে সেরা কোচ নয় সেটা কিন্তু হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া গেছে। জার্মানবাহিনীর কাছে ৪-০ তে ধরাশায়ী হয়ে দেশে ফিরতে হয়েছিল সেবার হিগুয়েনদের

     

    দীর্ঘবিরতির পর আবারও বিশ্বকাপ পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন দেখছে আলেসান্দ্রো সাবেলার আর্জেন্টিনা। ব্রাজিলের মাঠে ডি মারিয়া, আগুয়েরো, হিগুয়েন, জাবালেতাদের সঙ্গে নিয়ে লিওনেল মেসির দল টুর্নামেন্ট শুরু করবে বিশ্বকাপের অন্যতম দাবীদার হিসেবেই

     

    ১৯৮৬ সালে ফিফা কাপে ম্যারাডোনা যে চুমু খেয়েছে সেটা আজো আর্জেন্টাইন সমর্থকদের সবচেয়ে সুখকর স্মৃতি। এরপর ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপের ফাইনাল খেললেও তারপর থেকে কোয়ার্টার ফাইনালের গণ্ডি পেরোতে পারেনি আর্জেন্টাইনরা। বাতিস্তুতা, ক্যানেজিয়া এরপর মেসির জার্সিতে ভরসা করলেও বারবারই হতাশ হয়েছে সমর্থকরা।।

     

    তাত্ত্বিক আলোচনা থাক, আমি বরং আমার কিছু ব্যাক্তিগত দুঃখবোধের গল্প বলি। সে গল্প শুরুর আগে শুনতে হবে আরেক গল্প, গল্পের পেছনের গল্প। আর সব স্মৃতিচারণ শেষে একটা স্বপ্ন, হাস্যকর অসম্ভব মনে হলেও সে স্বপ্ন সত্যি দেখি আমি।

     

    ২০০৬ বিশ্বকাপ, কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচ, আর্জেন্টিনা বনাম জার্মানী। পরদিন আমার পরীক্ষা, প্রথম সাময়িক পরীক্ষা চলছে বোধহয়। বই হাতে নিয়ে খেলা দেখতে বসেছি। হাতে বই থাকলেও পড়া যে মৌটেও হচ্ছে না, তা তো সহজেই অনুমেয়। আম্মুর চোখ রাঙানীর ভয়েই বই হাতে রাখা আর কি!

     

    তবে বইয়ে চোখ না থাকলেও শুধু খেলা দেখছি না, কথার যুদ্ধ ও চলছে সমান তালে পাশে বসা বাবার সাথে।

     

    আমি আর্জেন্টিনার সমর্থক, সে তো লেখার শুরু থেকেই বুঝতে পারছেন, বাবা সেদিন একদম আমার রিভার্স পজিশনে, আ্যান্টি পার্টি। জার্মানী জার্মানী করে বাসা মাথায় করে রাখেন প্রতিবার বিশ্বকাপ এলেই।

     

    ভাইয়া বাম রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকায় বেশ একটা আ্যালার্জি ছিল হিটলারের দেশ জার্মানীর প্রতি। বাবা 'খেলার সাথে রাজনীতি মেশাবেন না' ধরণের যুক্তি ঝেড়ে পার পাওয়ার চেষ্টা করলেও বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারেন না। ভাইয়ার নতুন নতুন শেখা কমিউনিস্ট বুলির তোড়ে ভেসে যান বেশীরভাগ সময় ই। ছোট মানুষ আমি এসবের ধার ঘেষি না, আমি ফুটবল নিয়েই পড়ে থাকি।

     

    তবে সেবার বাবার চুড়ান্ত সুসময় চলছে, স্বর্গসুখ উপভোগ করছেন বাসায় বসে। ভাইয়া ঘুরতে বেরিয়েছিল বন্ধুদের সাথে, এক মাসের সফর। জার্মানী জার্মানী করলেও বাবাকে আর বাঁধা দেয়ার কেউ নেই, কমিউনিস্ট বুলি কপচিয়ে তাকে ধুয়ে দেয়ার কেউ নেই। বাসার ছাদে পতপত করে উড়তে থাকা জার্মানির পতাকাটা লাগানোর কৃতিত্ব ও বাবার।

     

    নক আউট পর্ব শেষে যখন কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানী প্রতিপক্ষ হিসেবে নিশ্চিত হলো আগের রাউন্ডে মেক্সিকোকে ২-১ গোলে হারিয়ে উঠে আসা আর্জেন্টিনা, তখন বাবা আমাকে পেলেন প্রতিপক্ষ হিসেবে। বাসায় থাকার প্রতিটা সেকেন্ড খুঁচিয়ে চললেন আমাকে ক্রমাগত। ম্যারাডোনার করা 'ঈশ্বরের হাত' খ্যাত গোলকে প্রতারণার গোল বলে আখ্যা দেয়া থেকে শুরু করে ২০০২ বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্ব থেকেই লজ্জাজনক বিদায়, কিছুই বাদ যায় না তার খোঁচানোর তালিকা থেকে। আমিও ছেড়ে দিই না, সল্প জ্ঞ্যানে যতটুকু ধরে, তাই দিয়ে রক্ষণ মাঠ সামলাই, মাঝে মাঝে প্রতি আক্রমণ।

     

    আসল খেলার চেয়ে নেহায়েত কম প্রতিদ্বন্দ্বীনতাপূর্ণ না আমাদের কথার খেলা, একমাত্র দর্শক হিসেবে আছে আম্মু, বলাই বাহুল্য, এসবে চুড়ান্ত বিরক্ত দর্শক তিনি।

     

    ম্যাচে ফিরে যাই, রাত জেগে খেলা দেখছি।

     

    কোয়ার্টার ফাইনালে বার্লিনের অলিম্পিয়াসটিডিয়ন ভেন্যুতে মুখোমুখি হয় স্বাগতিক জার্মানী ও আর্জেন্টিনা। রাবার্তো আয়লা আর মিরাশ্লোভা ক্লোসার গোলে নিদ্দিষ্ট সময়ে ১-১ গোলে ড্র করে আর্জেন্টিনা- জার্মানী! তারপর ট্রাইব্রেকারে ৪-২ গোলে আর্জেন্টাইনদের ফাইনাল খেলার স্বপ্ন ধুলায় মিশিয়ে জয়ী হয় আন্জেলা মার্কেল আর মিরাস্লোভা ক্লোসার জার্মানী!

     

     

    আর তার মাঝে প্রদর্শিত হয়ে গেল ইতিহাসের অন্যতম বাজে রেফারিং, স্বাগতিক দেশকে ফিফার দৃষ্টিকটুভাবে সুবিধা দেয়ার নিদর্শন অবশ্য সব সময়ই চলে আসছে অত্যন্ত নিন্দনীয়ভাবে আলোচিত হওয়া সত্ত্বেও।

     

    প্রিয় দলের বিদায়, প্রিয় খেলোয়াড়দের মাঠে বসে কান্না যে এক স্কুলে পড়া বালকের চোখ শুষ্ক রাখেনি, তা না বললেও চলে। অন্যদিকে বাবার চিত্কার, উল্লাস আর বাঁকা কথা চলছিল সমানতালেই।

     

    রাতে শুয়ে আর ঘুমোতে পারিনি, চোখের সামনে ভাসছিল ম্যাচের দৃশ্যগুলো।

     

    “ভুল অফসাইডটা যদি না ধরা হতো, তাহলে ওই গোলটা হয়ে যেত, ইশ, যদি ওই শটটা বারে না লাগতো, আরে মেসিকে একটু আগে নামালেই আর ঠেকানো যেত না কিছুতেই, গোলকিপারকে ওভাবে মেরে মাঠের বাইরে না পাঠালে তো ট্রাইবেকারগুলোর দু-তিনটে ঠিক ই ঠেকিয়ে দিত, আসল গোলকিপার মাঠে থাকলে তো খেলা অতিরিক্ত সময়ে যেত ই না, নতুন গোলকিপারের ভুলেই তো!” এমন হাজারটা কথা মনের মধ্যে আকুলিবিকুলি করে আমাকে ঘুমোতে দিচ্ছিল না।

     

    হঠাত পাশের রুম থেকে আম্মুর চাপা গলার ক্রুদ্ধ কন্ঠস্বর, “ছেলেটার কান্নার সামনে এভাবে নাচন-কুঁদন না করলেও পারতে!” বাবা মিনমিন করে কিছু একটা বলছিল, আমার কানে যায়নি কিংবা মনে নেই, তবে সেদিন বোধহয় একটা স্বপ্নের বীজ মনে গাঁথা হয়ে গিয়েছিল।

     

    এমন একদিনের স্বপ্ন যেদিন আমরা দুজনই একসাথে উল্লাসে চিত্কার করবো কিংবা কাঁদবো হারার কষ্টে, খেলা না বোঝা আম্মুও প্রার্থনা করবে চোখ বুজে, সারাদেশের মানুষের কন্ঠে একই আকুতি থাকবে। ছাদে ছাদে উড়বে লাল-সবুজ, আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল-জার্মানী-ফ্রান্সের পতাকার সাথে না, শুধুই লাল-সবুজের পতাকা দেখার স্বপ্ন।

     

    ২০১২ এশিয়া কাপ ক্রিকেট সে স্বপ্নের অনেকটাই পুরণ করে দিয়েছিল, ফুটবলের স্বপ্ন দেখতে দোষ কী!

     

    আমি আর বাবা না হই, আমাদের কোন উত্তরসূরি, আজ না হোক, অন্য কোনদিন, কোন একদিন তো বটেই, স্বপ্নে বাঁচতে দোষ কী!