• সেরা ফুটবল ক্লাব
  • " />

     

    কালো চিতা ও একজন ইউসেবিওর গল্প

    কালো চিতা ও একজন ইউসেবিওর গল্প    

     

    ১০ জুলাই, ২০১৬। ইউরো ’১৬ ফাইনালের অতিরিক্ত সময়ের অন্তিম মূহুর্ত। ইঞ্জুরির কারণে রোনালদোর অশ্রুসজল প্রস্থানের পরও প্রায় ‘অচেনা’ এডারের গোলে এগিয়ে পর্তুগাল। গ্রিয়েজম্যানদের প্রাণপণ চেষ্টায়ও ম্যাচে ফিরতে পারলো না ফ্রান্স। রেফারির শেষ বাঁশি বাজতেই মাঠে লালের বিস্ফোরণ। নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মত আন্তর্জাতিক শিরোপার স্বাদ পেলেন রোনালদো ও পর্তুগাল। বুনো উল্লাস, বিজয়ের আনন্দাশ্রু মাঝে মাঠের এক কোণায় হাঁটুগেড়ে আকাশের দিকে দু হাত উঁচু করে বসে কি যেন বিড়বিড় করছিলেন সহকারী কোচ ইলিদিও ভালে। উদযাপনে যোগ দিয়েই জড়িয়ে ধরলেন বন্ধু ফার্নান্দো সান্তোসকে। সান্তোস ঘুরতেই আকাশের দিকে ইশারা করে শুধু একটি কথাই বললেন ইলিদিও; “ইউসেবিও! ইউসেবিও!!”...

     

    ***

     

    ১৯৬০ সালের মার্চ মাসের কথা। বন্ধুর সাথে দেখা করতে পর্তুগাল গেলেন কার্লোস বাউয়ার। ব্রাগার ‘মেলহোর বারবেরিয়া’ নামক সেলুনে প্রায়ই আড্ডা দিতেন দুই বন্ধু। বাউয়ারের বন্ধুটি হলেন বেনফিকার বিশ্বখ্যাত কোচ বেলা গুটম্যান। কুশলাদি বিনিময় শেষে বললেন, “মাসখানেক আগে মোজাম্বিক গিয়েছিলাম, বুঝলে? লরেন্স মার্কিদের খেলা দেখতে। কাচা হীরে দেখে এসেছি। ছেলেটা মাত্র ১৬ কি ১৭ সেকেন্ডে ১০০ মিটার দৌড়ায়”। বাউয়ারের কথায় চোখ চকচক করে উঠলো গুটম্যানের। আলাপচারিতা শেষেই গেলেন ক্লাব কর্তাদের কাছে। জানালেন, এই ছেলেকে চাই-ই চাই। কোচের বিরুদ্ধে যাওয়ার স্পর্ধা দেখালেন না বেনফিকার রাঘব-বোয়ালরা। কিন্তু ইউসেবিওকে দলে ভেড়াতে যে নাটকটা করতে হল বেনফিকাকে, তা হয়তো হালের জি-বাংলাতেও দুষ্কর।

     

    ***

     

    লরেন্সো মার্কিতে জন্মানো ইউসেবিও ছেলেবেলায় খেলতেন স্থানীয় এক ক্লাব‘ওস ব্রাজিলেইরোস’-এ (দ্যা ব্রাজিলীয়ান্স)। ইউসেবিও সহ দলের সবাই ছিলেন ব্রাজিলের সমর্থক। একেকজন খেলতেন একেক ব্রাজিলীয় কিংবদন্তীর ছদ্মনামে। অর্থাভাবে ভোগা কিশোররা খবরের কাগজগোলাকৃতি করে মোজার ভিতর ঢুকিয়ে সেটাকেই ব্যবহার করতেন বল হিসেবে। একটু বড় ইউসেবিও ট্রায়াল দিতে গেলেন ‘গ্রুপো দেস্পোর্টিভো’ তে, বেনফিকার একটি ক্লাবে। সেখান থেকে ডাক না পেয়ে চলে যান ‘স্পোর্টিং দে লরেন্সো মার্কি’তে। হীরে চিনতে ভুল করেনি স্পোর্টিং লিসবনের ছায়ায় বেড়ে ওঠা ক্লাবটি।

     

    ওদিকে বেনফিকার অবস্থাটা হল ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’ গোছের। বেনফিকা ও স্পো্টিংয়ের মধ্যে শুরু হয় এক মহাযুদ্ধ। যুদ্ধে অবশ্য জয়ী হয় বেনফিকাই। অবসরের পর এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “বেনফিকা আমাকে চাচ্ছিল মূল দলেই। সাথে ছিল বেতনও, যা স্পোর্টিং দিতে অপারগ ছিল। আর আমার পরিবারের সাথে কথা বলে সব পাকা করে ফেলেছিল। তিন বছরের জন্য আমাকে ১,০০০ ডলার দেবে বলেছিল। আমরা দ্বিগুণ চাইলে তাতেও রাজি হয়ে গিয়েছিল”।

     

    তবে ইউসেবিওকে নিয়ে নাটকীয়তা মাত্র শুরু! বিশ্বাসঘাতকতার অপমানে ইউসেবিওর পরিবারকে হুমকিও দিয়েছিল স্পোর্টিং। স্পোর্টিং-এর লোকজন তাকে অপহরণ করতে পারে- এই ভয়ে চুক্তি সম্পন্ন করেই ইউসেবিওকে পাঠিয়ে দেওয়া হল আলগার্ভ গ্রামে। ইউসেবিওকে ছদ্মনামও দেওয়া হয়েছিল, রুথ মালোসো। ইউসেবিও আলগার্ভ গ্রামে ছিলেন ১১ দিন, তার দলবল নিয়ে উত্তাল অবস্থা ঠান্ডা হওয়ার পর তাকে নিয়ে আসা হয় লিসবনে।

     

    অভিষেকেই হ্যাটট্রিক করলেও প্রথম মৌসুমটা তেমন একটা ভাল কাটেনি ‘ব্ল্যাক প্যান্থার' এর। পেলের সান্তোসের বিপক্ষে একটি প্রীতি ম্যাচ খেলেছিল ইউসেবিওর বেনফিকা। প্রথমার্ধ শেষে ৪-০ গোলে পিছিয়ে পড়ায় ইউসেবিওকে নামিয়ে দেন গুটম্যান। ঐ ম্যাচেও হ্যাটট্রিক করেন তিনি। ম্যাচটা বেনফিকা ৬-৩ ব্যবধানে হারলেও ঠিকই নজর কেড়েছিলেন ইউসেবিও। পরদিনই এসে পড়েন ফ্রেঞ্চ ম্যাগাজিন লেকিপের এর প্রচ্ছদেই।

     

     

    পরবর্তী মৌসুম থেকে বেলা গুটম্যানের আস্থার প্রতিদান দিতে থাকেন ইউসেবিও। পেশাদারি ক্যারিয়ারে নিজের প্রথম পূর্ণ মৌসুমেই জিতে নেন ইউরোপীয়ান কাপ। ফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদকে ৫-৩ গোলে হারায় বেনফিকা, ইউসেবিও করেন জোড়া গোল। ম্যাচ শেষে শৈশবের নায়ক ফেরেঙ্ক পুসকাসের সাথে জার্সি বদলের সৌভাগ্য হয় ‘ও রেই’ (দ্যা কিং) এর। একই মৌসুমে ব্যালন ডি’অরের দৌড়ে হন দ্বিতীয়।

     

    পর্তুগালের হয়েও ক্যারিয়ারজুড়ে ছিলেন দুর্দান্ত। ষাটের দশকে খেললেও ম্যাচপ্রতি গোলগড় ছিল ১-এরও বেশি! ’৬৬-এর বিশ্বকাপটা ছিল তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে হতাশাজনক সময়। ২ হ্যাটট্রিক সহ পুরো টুর্নামেন্টে ৯ গোল করেন তিনি। দোর্দন্ড প্রতাপে সেমিতে আসার পথে হারায় ‘৬২ বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিলকেও। কোয়ার্টারে উত্তর কোরিয়ার বিপক্ষে ২৫ মিনিটেই ৩-০ গোলে পিছিয়ে পড়েছিল পর্তুগীজরা। এমতাবস্থায় কোচ ইউসেবিওকে নামিয়ে দেন ৩০ মিনিটেই। ম্যাচটা পর্তুগাল জেতে ৫-৩ গোলে, ইউসেবিও লক্ষ্যভেদ করেন চার চারবার। সেবার উত্তর কোরিয়ার অধিনায়ক ছিলেন পাক সিউং-জিন। ২০১১ সালে মৃত্যুর আগে শেষ সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমার মনে হয় না পেলে, গারিঞ্চারাও এমন কিছু করতে পারতো। ঈশ্বরতুল্য এক অতিমানবের কাছে সেদিন হারতে হয়েছিল আমাদের”।

     

    সেমিতে প্রতিপক্ষ স্বাগতিক ইংল্যান্ড। নিজেদের দেশে হওয়ায় কিছুটা অনৈতিক সুবিধা নেয় ইংলিশরা। ম্যাচটি হওয়ার কথা ছিল লিভারপুল শহরের গুডিসন স্টেডিয়ামে। ম্যাচের আগের দিন ভেন্যু বদলে ওয়েম্বলিতে নেয় ইংল্যান্ড। এর কারণ ছিল, গ্রুপপর্ব ও কোয়ার্টারের ম্যাচগুলো এই মাঠেই খেলেছিল পর্তুগাল। কিন্তু ইংলিশদের ছলচাতুরিতে ম্যাচের আগেরদিন লিভারপুল থেকে লন্ডনে আসতে হয় পর্তুগাল দলকে। ভ্রমণক্লান্তি ও নানাবিধ কারণে ওই ম্যাচে ঠিকঠাক খেলতেই পারলেন না ইউসেবিও। পুরো ম্যাচেই নবি স্টাইলসের পকেটবন্দী ছিলেন ‘দ্যা ব্ল্যাক প্যান্থার’। গোলও করেছিলেন ইউসেবিও, টুর্নামেন্টে ঐ ম্যাচের আগে টানা সাত সাতটি ক্লিনশীট রেখেছিল ইংলিশরা। পেনাল্টি থেকেই গোল করেই ব্যাঙ্কসকে স্যালুট জানান ইউসেবিও। স্যার ববি চার্লটনের জোড়া গোলে ২-১ ব্যবধানে জিতে ফাইনালে চলে যায় স্বাগতিকরাই। তীরে এসে স্বপ্নভঙ্গ হয় ইউসেবিওদের, পর্তুগালের ইতিহাসে ম্যাচটা হয়ে থাকে “অশ্রুতে লেখা ম্যাচ” হিসেবে।

     

    ’৬৬ বিশ্বকাপের তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচটি ছিল ঐ আসরের অন্যতম বড় আকর্ষণ। পর্তুগাল বনাম সোভিয়েত ইউনিয়ন। ইউসেবিও বনাম লেভ ইয়াশিন। ‘দ্যা ব্ল্যাক প্যান্থার’ বনাম ‘দ্যা ব্ল্যাক স্পাইডার’। ম্যাচে ১২ মিনিটে পেনাল্টি থেকে লেভ ইয়াশিনকে পরাস্ত করেন ইউসেবিও। গোলের পরপরই ব্যাঙ্কসের মত ইয়াশিনকেও স্যালুট জানান ‘কালো চিতা’। আজো ‘স্পোর্টসম্যানশিপ’-এর অন্যতম উদাহরণ হয়ে আছে এই ম্যাচটি।

     

    ক্যারিয়ারে গোল, সম্মাননা- কোনোটিরই কমতি হয়নি ইউসেবিওর। বেনফিকাতে ১৫ বছরে ৭১৫ ম্যাচে গোল করেছিলেন ৭২৭টি, তাও সেই ষাটের দশকে! ‘ঈগল’দের হয়ে ১১টি লিগ শিরোপা, ৫টি পর্তুগীজ কাপ, ১টি ইউরোপীয়ান কাপ, ৯টি লিসবন কাপ জিতেছিলেন। ১৯৬৫ সালে জিতেছিলেন ব্যালন ডি’অর, ’৬২ এবং ’৬৬ তে হয়েছিলেন রানার আপ। ’৬৮ এবং ’৭৩-এ জিতেছিলেন ইউরোপীয়ান গোল্ডেন বুট। পর্তুগীজ লিগে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলেন ৭ বার। ’৬৩ রবং ’৬৭-তে জায়গা করে নিয়েছিলেন ফিফার বর্ষসেরা একাদশে। ইউরোপীয়ান কাপের সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলেন তিনবার।’৬৬ বিশ্বকাপে জিতেছিলেন গোল্ডেন বুট, ব্রোঞ্জ বল। জায়গা পেয়েছিলেন বিশ্বকাপের ‘ড্রিম টীম’-এও। ’৯৪-এ জিতেছিলেন ‘ফিফা অর্ডার অফ মেরিট’। পর্তুগালের হয়ে ৬৪ ম্যাচে করেছিলেন ৪১ গোল, যা অক্ষুণ্ন ছিল প্রায় দশক তিনেক। ফুটবল বিশ্লেষক, খেলোয়াড়, কোচ- সবার মতেই ইউসেবিও ছিলেন সময়ের চেয়েও অনেক এগিয়ে থাকা এক তারকা। একবিংশ শতাব্দীর আদর্শ স্ট্রাইকারের সব গুণাগুণ ছিল তাঁর মধ্যে।

     

    কিন্তু, এতসব কিছুর পরও পর্তুগালের হয়ে আন্তর্জাতিক শিরোপা না জেতাটাই সবচেয়ে পোড়াতো তাঁকে। রোনালদোর অধিনায়কত্বে যখন পর্তুগাল অবশেষে কোনো আন্তর্জাতিক শিরোপা স্বাদ পেল, তার বছর দুয়েক আগেই ইউসেবিও পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে।

     

    মোজাম্বিকে ইউসেবিওর বাড়ির পাশেই ছিল এক সাগর। তাদের এক প্রতিবেশী ছিলেন, মার্থা আগুস্তো নাম। শতবর্ষী এই বৃদ্ধা বলতেন, সাগরের পাড়ে বসে তিনি প্রায়ই হারিয়ে যেতেন সেদিনগুলোর স্মৃতিতে, যখন ইউসেবিও মোজা, সংবাদপত্র দিয়ে বানানো বলে দাপিয়ে বেড়াতেন ডাঙ্গায়। ২০১৪ সালে যেদিন চিরতরে চলে যান, ওই দিনের মত বৃষ্টিপাত মোজাম্বিকে বিগত ৫-৬ বছরের মধ্যে হয়নি। প্রকৃতিও যেন বাঁধভাঙা জলেই বিদায় দিয়েছিল “কালো চিতাকে”।