• আইপিএল
  • " />

     

    ক্রিকেটার না হলে কুলি হতেন যিনি

    ক্রিকেটার না হলে কুলি হতেন যিনি    

    পরিবারের ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’ অবস্থা। বাবা সামান্য একজন কুলি, মা  স্টেশনের পাশে ছোট্ট একটা দোকান চালান। পাঁচ ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসারের ঘানি টানতে হিমশিম খান দুজনই। এর মাঝে বড় ছেলেকে পেয়ে বসেছে ক্রিকেটের ‘নেশা’। কই ছেলেটা বাবাকে সাহায্য করবে, তা না; সকাল নেই, রাত নেই, শুধুই ক্রিকেট আর ক্রিকেট! পরিবার, পাড়া প্রতিবেশী কেউই ব্যাপারটা ভালো চোখে দেখেননি। বাধা এসেছে, কটু কথাও শুনতে হয়েছে; কিন্তু ছেলেটা দমে যায়নি। সেই ক্রিকেট খেলেই ছেলেটা আজ ‘কোটিপতি’। গতকাল আইপিএলে থাংগারাসু নটরজনকে ৩ কোটি রুপিকে কিনে নিয়েছে কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব।

     

    ৩ কোটি রুপি! যেখানে পরিবারের দৈনিক আয় ৩০০ রুপিরও কম, সেখানে নটরজনের কোটিপতি হওয়াটা রীতিমত কল্পনাতীত ব্যাপার। ছোটবেলা থেকেই বন্ধুদের সাথে পাড়ার মাঠ দাপিয়ে বেড়াতেন। বাবার বকাঝকায় মাঝে মাঝে কুলির কাজও করেছেন। কিন্তু মনটা পড়ে থাকতো ওই ২২ গজেই। এলাকাভিত্তিক টেনিস বলের টুর্নামেন্টগুলোতে অংশ নিতেন। অনেক সময় বাড়িতে না জানিয়েই চলে যেতেন খেলার জন্য! এসব নিয়ে বহুবার বাক বিতণ্ডাও হয়েছে। বড় বোন বারবার বুঝিয়েছেন, ক্রিকেট খেলে কিচ্ছু হবে না; চাকরি খুঁজতে হবে। কিন্তু খুব একটা পড়াশুনা না জানা ছেলেকে কে ভালো চাকরি দেবে? তাহলে কি মানুষের জিনিসপত্রের বোঝা টেনেই পার করে দিতে হবে জীবনটা? কেউ কি তাঁকে এই কষ্টের জীবন থেকে দূরে নিয়ে যেতে পারবে না?

     

     

    নাহ। মানুষের বোঝা টানাটা তাঁর ভাগ্যে লেখা ছিল না। তাঁর জীবনে আলোকবর্তিকা হাতে হাজির হন চেন্নাইয়ের জয়প্রকাশ নামের এক ক্রিকেটার। বামহাতি নটরজনের বোলিং কৌশলে মুগ্ধ হয়ে নিজের সাথে চেন্নাই দিয়ে যান তিনি। ছেলে কোথায় যাবে, কী করবে; এসব ভেবে নটরজনের পরিবার প্রথমে রাজি হয়নি। তবে জয়প্রকাশ তাঁদের অভয় দেন, “আমি আপনাদের ছেলের পূর্ণ দায়িত্ব নিচ্ছি। তাঁকে নিয়ে কোনো চিন্তাই করবেন না। সে একদিন অনেক বড় কিছু করবে।” চেন্নাইয়ে এসে ধীরে ধীরে নিজের প্রতিভার আরও বিকাশ ঘটান। তাঁর ‘কাটার’ বলের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে স্থানীয় ক্রিকেটারদের মাঝে। ২০১৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিপক্ষে তামিল নাড়ুর হয়ে রঞ্জি ট্রফির অভিষেক হয়।

     

    অভিষেকের পর ৯ ম্যাচে নিয়েছেন ২৭ উইকেট। এরই মাঝে বাংলাদেশের মুস্তাফিজের সাথে তাঁর তুলনা করা শুরু হয়ে গিয়েছে। ‘কাটার মাস্টার’ মুস্তাফিজের মতো তাঁর বল বুঝতেও হিমশিম খেতে হয় অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানদেরও। অনেক পরিশ্রমের ফসল হিসেবেই আইপিএলে ডাক পেয়েছেন। নটরজন এসবের পুরো কৃতিত্বটাই ‘গুরু’ জয়প্রকাশকে দিতে চান, “আমি আজ যা, সবই তাঁর কল্যাণে। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি আমার ওপর ভরসা রেখেছেন। ক্রিকেটার না হলে আজ আমি কুলিই হতাম। আইপিএলের ওই খবরটা পাওয়ার পর তাঁর সাথেই প্রথম কথা হয়। তিনি তো কেঁদেই ফেলেছেন এসব শুনে। আমি তাঁর কাছে আজীবনের জন্য ঋণী।”

     

     

    ছোটবেলাটা কেটেছে দারিদ্রের ভেতর। আজীবন মা বাবাকে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি করতে দেখেছেন। তবে এখন থেকে তাঁদেরকে বিশ্রাম দিতে চান নটরজন, “আমার প্রথম কাজ হবে মা বাবাকে নিজেদের কাজ থেকে দূরে সরিয়ে আনা। তাঁদের তো বহুবার বলছি এসব, কিন্তু তাঁরা আমার কথা শুনতেনই না! আমাদের ঘরটা খুব ছোট, অনেকজন মিলে থাকতে কষ্ট হয়। নতুন একটা ঘর বানাবো। বাবার নেওয়া ঋণগুলো শোধ করতে হবে। আমার ভাইবোনদের আরও পড়ালেখা করাতে চাই। তাঁরা ইঞ্জিনিয়ার ও চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট হতে চায়। আইপিএলের এই টাকা আমার অনেক কাজে দেবে।”


    আইপিএলে বরাবরই টাকার ঝনঝনানি। কোটি কোটি টাকায় ক্রিকেটারদের দলে ভেড়ান মালিকরা। এক মাসের এই টুর্নামেন্টে খেলতে এসে সবাই ‘বাড়তি কামাই’ করে নিয়ে যায়। অনেকেই বলেন, আইপিএল ক্রিকেটের ‘বাণিজ্যকরণ’ ছাড়া আর কিছুই নয়! হতে পারে এটা ‘নিছক বিনোদন’। কিন্তু এই ‘বিনোদন’ই নটরজনের জীবনে এনেছে আশার আলো। মানুষের বোঝা নয়, ভারতের ক্রিকেটের দায়িত্বটা নিজের কাঁধে নিতে চাওয়ার স্বপ্নে বিভোর এই তরুণের কাছে আইপিএল তো শুধুই ‘বিনোদন’ নয়…