এক যে ছিল ভয়ঙ্কর সুন্দর
একটা চুইংগাম। একটা ক্যাপ। একটা স্ল্যাজেনজার। ইউটিউবের অনেকগুলো ভিডিও ক্লিপ। একজন ভিভ রিচার্ডস। এবং একটা আক্ষেপ।
ভিভের বয়স কতো হবে, ছয়-সাত। টি-টোয়েন্টির মস্ত ভক্ত। তার কাছে ক্রিকেট মানেই টি-টোয়েন্টি। দুনিয়াজোড়া যতো লিগ হয়, বসে বসে দেখে টেলিভিশনে। ডাগ-আউটে মাঝে মাঝেই ক্যামেরা যায়, বসে থাকা মানুষগুলোর প্রতিক্রিয়া দেখাতে। হয়তো এক টেকো, মুখে অল্প দাড়ির এক মানুষকে ভিভ দেখেছে। হয়তো বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছে, ‘এই লোকটাকে অনেক জায়গায় দেখি। কে বলো তো?’
বাবা হয়তো মুচকি হেসেছেন। বলেছেন, তিনিও ভিভ। আইজাক ভিভিয়ান আলেকজান্ডার রিচার্ডস।
****
ভিভ রিচার্ডসের নাম প্রথম কবে শুনেছিলাম? সাঈদ আনোয়ার যেবার তাঁর সর্বোচ্চ ওয়ানডে রানের রেকর্ডটা ভাঙলেন, বোধহয় সেবার। ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে আগের ফাইনালগুলোর সংক্ষিপ্ত হাইলাইটস দেখিয়েছিল। সেবারই প্রথম ভিভের ব্যাটিং দেখে থাকবো। ইউটিউব নাগালে আসতে তো তখনও ঢের দেরী।
মোহাম্মদ ইউসুফ এক পঞ্জিকাবর্ষে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড গড়লেন, ২০০৬ সালে। কার রেকর্ড ভাঙ্গলেন? ভিভ রিচার্ডস। এইতো সেদিন এসে ব্রেন্ডন ম্যাককালাম গড়লেন দ্রুততম টেস্ট সেঞ্চুরির রেকর্ড। কার রেকর্ড ভাঙলেন? ভিভ রিচার্ডসেরই তো! (মিসবাহ-উল-হক তাতে ভাগ বসিয়েছিলেন তারও কদিন আগে।)
শেন ওয়ার্ন বোলিংয়ে, ব্যাটিংয়ে ভিভ রিচার্ডস! যদি দেখা যেতো। এক বন্ধু প্রায়ই আক্ষেপ করতো। ঘুরে ফিরে, ভিভের কথা উঠলেই সে বলবে এ কথা। একদিন পেয়ে গেল একটা ভিডিও। ইউটিউবে অবশ্যই। এক প্রদর্শনী ম্যাচে বোলিং করছেন শেন ওয়ার্ন। সানগ্লাস পরা, ক্যাপটা উল্টো করে পরা। ব্যাটিংয়ে ভিভ, সেই স্ট্যান্স!
হ্যাঁ, সেই স্ট্যান্স। এই ইউটিউবেই দেখা। চুইংগাম চাবানো। হাতে স্ল্যাজেনজার। একটু পর পর দুই হাত দিয়ে ব্যাটটা ঝাঁকি দিয়ে যেন ওজন মাপেন! অথবা কথা বলেন। ব্যাটের সাথেই। তাঁর ব্যাট অবশ্য তাঁর হয়েই কথা বলতো।
ভাবলেশহীন তিনি হেঁটে আসছেন উইকেটের দিকে। গার্ড নেন। একটু এগিয়ে পিচটা ঠিক করেন ব্যাট দিয়ে খুটিয়ে খুটিয়ে। একবার হাঁটতে হাঁটতে অর্ধেক পার হয়েও অনেকদূর এগিয়ে গেলেন পিচের। ইয়ান বোথাম তখনও প্রায় সেখানেই দাঁড়ানো! এর আগের শর্ট বলটা যে ওইরকম অঞ্চলেই পড়েছিল! ভিভের ব্যাটের সংস্পর্শে এসে বলগুলো অবশ্য যেতো দূর-দূরাঞ্চলে!
কোনো ক্যাপশনের দরকার নেই!
পিচের চারদিকে শুধু একটু সবুজ। তা বাদে চারপাশে ধূ ধূ করছে ধূসর! ঘাস নাকি মাটি, ভিডিওতে বুঝার উপায় নেই। সেবার নাকি ইংলিশ গ্রীষ্ম এতোটাই দীর্ঘ আর তীব্র ছিল। মাঠের দিকে চোখ আটকে যেতেই পারে, তবে ক্ষণিকের জন্য। চোখ যে আসলে আটকাবে মাঠের মাঝখানের ওই মানুষটার তান্ডবলীলায়! সেই পরিচিত আবয়বের মানুষটা।
অথবা অ্যান্টিগার সেই ইনিংসটা। ঘরের মাঠে, ঘরের ছেলে করলেন টেস্টের তখনকার দ্রুততম সেঞ্চুরিটা। গ্রাহাম গুচ এগিয়ে এসে ইয়ান বোথামের সাথে কথা বলছেন। বোথাম যেন ইশারা করছেন, ফিল্ডার রাখতেই হলে রাখো ওই দ্বিতীয় তলায়। বল সেখানে গেছে, সেখানেই যাবে!
ইউটিউবেও একেকজন বোলারের মুখভঙ্গি আর প্রতিক্রিয়া দেখে বোঝা যায়, ভিভ কতোটা ভয়ঙ্কর ছিলেন। ভিভ কতোটা প্রভাববিস্তারী ছিলেন। কতোটা ক্ষমতা ছিল তাঁর, বোলারদেরকে নিয়ে খেলার! কতো অসম্ভব শট তিনি খেলতেন কী অবলীলায়! তিনি যেন নিয়ে বসতেন পশরা। সুন্দরতম ব্যাটিংয়ের পশরা। যা বোলারদের কাছে ঠেকতো ভয়ঙ্করতম হয়ে!
যেমন পশরা সাজানো ছিল তাঁর সেই ১৮৯ রানের অপরাজিত ইনিংসটায়! যেবার ভিভ একাই দলের প্রায় ৬৯ শতাংশ রান করেছিলেন! বোথামের সেই হাসি, রিচার্ডস একটু আগেই ফ্লিকে চার মেরেছেন তাঁকে! রিচার্ডসের বোথামের দিকে এগিয়ে যাওয়া, দুজনের খুনসুটি। কিংবা একটু পর পর মাইকেল হোল্ডিংয়ের ওপাশ থেকে ছুটে আসা। সতীর্থকে অভিনন্দন জানাতে জানাতেই হয়তো সেদিন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন ‘হুইস্পারিং ডেথ’!
ইউটিউবে দেখা ভিভকে বর্ণনা করতে গেলে ক্লান্তই হতে হবে। ইউটিউবে দেখা ভিভকে বর্ণনা করতে গেলে আঁকড়ে ধরবে আক্ষেপ।
****
ব্যাটিংয়ের আধিপত্য, বাউন্ডারির পসরা দেখতে ইউটিউবে যাও, ভিভ। ভয়ঙ্কর সুন্দর ক্রিকেট দেখতে যাও। টাইপ করো নিজের নামটা। যে সম্রাটকে দেখবে, তাঁর ইয়া বড় আকারের ব্যাট লাগতো না। আর্মগার্ড লাগতো না। হেলমেট লাগতো না।
লাগতো একটা চুইংগাম। একটা ক্যাপ। একটা স্ল্যাজেনজার।
একজন ভিভ রিচার্ডসকে দেখবে তুমি তখন। যাঁর নামে তোমার নাম রেখেছিল তোমার বাবা।
তাঁর ব্যাটিং টেলিভিশনে সরাসরি দেখতে না পেরে একটা আক্ষেপ আঁকড়ে ধরবে, তোমাকেও!