আড়ালে থাকা রুই কস্তা
১৯৭৭-এর এক ভরদুপুরের কথা। স্থানঃ লিসবনের এক ফুটসাল স্টেডিয়াম। লাস ভেগাস কুইকসিলভারদের হয়ে মৌসুম শেষে স্বদেশে ফিরেছেন ইউসেবিও। বেনফিকার তখনকার কোচ জন মর্টিমোরের নিমন্ত্রণে লিসবনের সেই স্টেডিয়ামে একদল শিশুর ফুটবলে হাতেখড়ি দেখতে গেলেন ‘দ্যা ব্ল্যাক প্যান্থার’। একঝাঁক অত্যুৎসাহী বাচ্চাকাচ্চাদের মাঝে একজনের পায়ের কারুকাজে নজর কাড়লো ইউসেবিওর। দীর্ঘক্ষণ খেললেনও শিশুটির সঙ্গে। যাবার বেলায় বন্ধু মর্টিমোরকে বলে গেলেন, “একেবারে কাঁচা সোনা এই ছেলে; একাডেমীতে নিয়ে নাও। ভবিষ্যতে বেনফিকার মশাল ওর হাতেই জ্বলবে”। মশকরা ভাবলেও বন্ধুর কথাটা ঠিকই রেখেছিলেন মর্টিমোর। ফলশ্রুতিতে বেনফিকার একাডেমীতে জায়গা হল পাঁচ বছরের কাঁধছোঁয়া চুলের এক শিশুর।
ভবিষ্যদ্ববাণীটা এভাবে ফলে যাবে- খুব সম্ভবত ভাবেননি ইউসেবিও নিজেও। লিসবনের সেই শিশুটি এরপর দাপিয়ে বেড়িয়েছে ইউরোপ। পায়ের জাদু আর বাবরি চুলের ঢেউয়ে সম্মোহিত করে রেখেছিলো ফুটবলবিশ্বকে। সমানে সমানে টেক্কা দিয়েছে জিদান, বাজ্জিওদের। নাম তার রুই কস্তা, পর্তুগালের সোনালী প্রজন্মের কথা উঠলেই যার নামটা এসে যায় আপনাআপনিই...
ওপরের কাহিনীটা শুনে মনে হতে পারে, পাদপ্রদীপের আলোটা যেন অধিকাংশ সময়েই ছিল রুই কস্তার ওপর। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য, ক্যারিয়ারজুড়েই কিছুটা ‘ব্রাত্য’ই থেকে গেছেন তিনি। ফিওরেন্তিনা, এসি মিলান, পর্তুগাল- তিন তিনটি ভিন্ন দলের সোনালী সময়ের সাক্ষী কস্তা। কিন্তু ভেবে দেখুন তো, ক’বার এই তিন দলের স্বর্ণযুগের কথা উঠতে গোড়াতেই এসেছে কস্তার নাম? এ নিয়ে অবশ্য কোনো খেদ নেই তার মনে। গত ইউরোর সময় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “লাইমলাইট, মিডিয়া কখনোই মোহাচ্ছন্ন করতে পারেনি আমাকে। দিনশেষে দলকে জেতানোর চিন্তাই লালন করে এসেছি আজীবন”।
পাদপ্রদীপের আলোয় তেমন না আসলেও রুই কস্তার সামর্থ্য ও অর্জন- উভয়ই প্রশ্নাতীত। জিদান, দেল পিয়েরোদের সমকক্ষ না হলেও নব্বইয়ের দশকে ইউরোপজোড়া প্রতাপ ছিল ‘ইল মায়েস্ত্রো’র। পর্তুগালের জার্সিতেও কম যাননি। ১৯৯১ সালে অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপ ফাইনালে কস্তার লক্ষ্যভেদেই ব্রাজিলকে শিরোপা ধরে রাখে পর্তুগাল। ঐ টুর্নামেন্টেই নজর কাড়েন তিনি। একদিকেবড় ক্লাবগুলোর লোভাতুর দৃষ্টি, অন্যদিকে অর্থনৈতিক দৈন্য- সব মিলিয়ে কস্তাকে ক্লাবে রাখাটাই এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় বেনফিকার জন্য। কিন্তু এতেও এতটুকু বিচলিত হননি কস্তা। একাধিক লোভনীয় প্রস্তাব (এমনকি ক্রুইফের বার্সাকেও) ফিরিয়ে দিয়ে থেকে গেছেন প্রাণপ্রিয় ক্লাবটিতেই।
’৯৪-সালে কস্তার জন্য ফিওরেন্তিনার ৬ মিলিয়নের প্রস্তাবে রাজি হয় বেনফিকা। কিন্তু শৈশবের ক্লাবটির প্রতি মায়াটা হারাননি কখনোই। যাবার বেলায় কথা দিয়েছিলেন; আবারো ফিরে আসবেন, ক্যারিয়ারের ইতি টানবেন এখানেই। ’৯৬-’৯৭ মৌসুমে বেনফিকার বিপক্ষে ফিওরেন্তিনার হয়ে এক প্রীতি ম্যাচে গোল করে বসেন কস্তা। গোলের পর কান্নাভেজা চোখে বেনফিকা সমর্থকদের কাছে করজোড়ে ক্ষমা চান। ম্যাচশেষে বেনফিকা সমর্থকদের উদ্দেশ্যে বলতে থাকেন ‘ভোলতার, ভোলতার’; বঙ্গানুবাদ করলে যার অর্থ দাঁড়ায় “ফিরে আসবো”...
বেনফিকার দিনগুলো থেকেই পছন্দের পজিশন ছিল স্ট্রাইকারের ঠিক পেছনে, ‘নাম্বার টেন’ রোলটি। প্লেমেকার হিসেবে দেখিয়েছেন চমৎকার পারদর্শীতা। তবে রুই কস্তার সবচেয়ে বড় গুণ ছিল খেলার ধরনের সাথে দ্রুত খাপ খাইয়ে নেওয়া। চকিত টার্ন, ডিফেন্সচেরা লং পাসের পাশাপাশি দূরপাল্লার আগুনে শটে সমান পারদর্শী ছিলেন।
একাধিক গুণে গুণান্বিত রুই কস্তা খুব সম্ভবত ক্যারিয়ারের সেরা সময়টা কাটিয়েছেন ফিওরেন্তিনাতেই। ১৯৯৪-এ যখন আসলেন, তখন ফিওরেন্তিনার অবস্থা একেবারেই যাচ্ছেতাই। অবনমনের লজ্জা কাটিয়ে সিরি আ-তে ফিরলেও ক্লাব নিয়ে হতাশ ছিলেন সমর্থকরাই। এমন সময় আশার আলো হয়ে আসেন বাতিস্তুতা এবং কস্তা। এই দুই তারকায় ভর করেই মিলান, জুভেন্টাসেদের টেক্কা দিচ্ছিল ফিওরেন্তিনা। বলা হয়, রক্ষণাত্মক সিরি আ-কে আক্রণাত্মক ফুটবল শিখিয়েছিলেনরানিয়েরি, কস্তারা। ফলাফলটা আসে হাতেনাতেই। দীর্ঘ দু’দশকের শিরোপাখরা কাটিয়ে ইতালীয়ান কাপ জেতে ‘লা ভিওলা’রা। ঐ মৌসুমে ইতালীয়ান সুপারকাপটাও আসে কস্তাদের শিবিরে।
মাঠের মত মাঠের বাইরেও সমান জনপ্রিয় ছিলেন রুই কস্তা। ’০০-’০১ মৌসুমে ইতালীয়ান কাপের ফাইনাল শেষে মাঠে উদযাপনরত কস্তার কাছে ছুটে যায় এক ক্ষুদে সমর্থক। নিরাপত্তাকর্মীরা শিশুটিকে নিয়ে যাওয়ার সময়ই দৌড়ে শিশুটিকে তাদের থেকে ছিনিয়ে নেন কস্তা। কিছুক্ষণ পর রেখে আসেন তার বাবা-মা’র কাছে, দিয়ে আসেন নিজের জার্সিটিও। ফিওরেন্তিনা সমর্থকদের সাথে এমনই এক আত্মিক সম্পর্ক ছিল কস্তার।
পরবর্তী মৌসুমে রানিয়েরি চলে গেলেও ফাতিহ তেরিমের অধীনে চলতে থাকে ফিওরেন্তিনার বিপ্লব। তুরষ্কের এই কোচের অধীনেই আসে ফিওরেন্তিনার ইতিহাসের অন্যতম সেরা পারফরম্যান্স। ‘০০-‘০১ মৌসুমে মালদিনি, শেভেচেঙ্কোদের মিলানকে ৪-০ গোলে বিধ্বস্ত করেনকস্তারা। ঐ ম্যাচে কস্তা এতটাই বিধ্বংসী ছিলেন যে ম্যাচশেষে মিলান অধিনায়ক মালদিনি এসে তাকে অভিনন্দন জানিয়ে জার্সি বদল করে যান।ফ্লোরেন্সে সেদিন নিজ দলকে অপদস্থ হতে দেখেছিলেন মিলান মালিক সিলভিও বার্লুসকোনি। মৌসুম শেষে কোচ তেরিমের পাশাপাশি ৪৪ মিলিয়নের বিনিময়ে কস্তাকেও মিলানে নিয়ে আসেন বার্লুসকোনি। ‘রোজ্জোনেরি’দের হয়ে কস্তা জিতে নেন পরম অরাধ্য চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ও ‘স্কুডেট্টো’। কস্তা, পিরলো, গাত্তুসো, সিডর্ফদের নিয়ে সাজানো তৎকালীন মিলানের মধ্যমাঠ ছিল ইউরোপের ত্রাস।মিলান ক্যারিয়ারের শেষদিকে ইনজুরি, ফর্মহীনতার পাশাপাশি কাকার আগমনে শেষটা ঠিক স্মরণীয় করে রাখতে পারেননি কস্তা।
লাস্যময় জীবন, মোটা অঙ্কের বেতন- কোনোটিই কস্তার নাড়ির টান ভোলাতে পারেনি। মিলানে পাঁচ বছর থেকে ফিরে যান প্রিয় ক্লাবে। ছেড়ে দেন বাৎসরিক ৪.৬ মিলিয়ন ইউরোর লোভনীয় বেতন। অবশেষে ২৫ মে, ২০০৬ সালে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। কানায় কানায় পূর্ণ স্তাদিও দা লুজ উষ্ণ অভ্যর্থনায় পুনরায় বরণ করে নেয় নিজেদের সন্তানকে। প্রত্যাবর্তনের পর প্রথম ম্যাচেই লক্ষ্যভেদ করেন কস্তা। ১১ মে, ২০০৮ সালে ভিতোরিয়ার বিপক্ষে শেষবারের মত মাঠে নামেন কস্তা। ৮৬ মিনিটে যখন কোচ কামাচো তাকে তুলে নিচ্ছিলেন, সমগ্র এস্তাদিও দা লুজ তখন দাঁড়িয়ে অশ্রুসজল নয়নে বিদায় জানায় তাদের কিংবদন্তীকে। অবসরের দুদিন পরই বেনফিকার স্পোর্টিং ডিরেক্টরের দায়িত্ব নেন কস্তা। আইমার, সাভিওলা, ডি মারিয়াদের বেনফিকাতে ভেড়ানোর মূল কৃতিত্বটা তারই। তার অধীনেই সুদীর্ঘ পাঁচ বছর পর লিগ জেতে বেনফিকা।
আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারেও কস্তা ছিলেন সমুজ্জ্বল। পর্তুগালের ইতিহাসের ৭ম সর্বোচ্চ গোল তার (৯৪ ম্যাচে ২৬ গোল)। ইউরো ’০০-তে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২-০ তে পিছিয়ে পড়েও ৩-২ গোলে জিতেছিল পর্তুগাল। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ’০৪ ইউরোতে তার দুর্দান্ত গোলটি নিয়ে কথা হয় আজো। তিনটি গোলই এসেছিল কস্তার অ্যাসিস্ট থেকেই। পর্তুগালের হয়ে ’৯৩-এ অভিষেকের পর ইউরো ’০৪ ফাইনালে হার দিয়ে ইতি টানতে হয় তাকে। গ্রীসের বিপক্ষে ফাইনালে বিস্ময়কর হারের পর রোনালদোর পাশাপাশি কস্তার কান্না আজো পর্তুগীজ সমর্থকদের নাড়া দেয়।
ক্যারিয়ারজুড়েই নিজের কাজটা করে গেছেন নীরবে-নিভৃতে। আলোচনার কেন্দ্রে কখনোই ছিলেন না বলতে গেলে। কেতাবী পরিসংখ্যান দিয়ে তাকে বিচার করা হবে বোকামি। লাইমলাইটের অভাবে তার সামর্থ্যের সবটুকু বুঝতে পারেননি অনেকেই। দলের স্বার্থকেই সবসময় দেখেছেন বড় করে, দলের অনুরোধে ঢেঁকিও গিলেছেন একাধিকবার। বেনফিকা, ফিওরেন্তিনা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন ক্লাবগুলোর আর্থিক দৈন্যের কারণে। মিলান ছেড়েছিলেন দশ বছর আগে বেনফিকাকে দেওয়া কথা রাখতে। ফুটবলারদের তিনি দেখিয়েছিলেন, দলের হয়ে সম্ভাব্য সবকিছু করতে প্রস্তুত থাকলেই নিজস্ব কিংবদন্তী গড়ে তোলা যায়, আনুষঙ্গিক কিছুর প্রয়োজন পড়ে না। সর্বকালের সেরাদের তালিকা করলে কস্তার নামটা আসবে অনেক পরে, কারো কারো তালিকায় হয়তো আসবেও না। কিন্তু এসবে কুছ পরোয়া নেই কস্তার। অবশ্য পর্তুগাল, ইতালীতে যার নাম জিদান, বাজ্জিও, নুনো গোমেজদের কাতারে উচ্চারিত হয়, এসব খুচরো অর্জনে তার কীইবা আসে যায়...