• বাংলাদেশ-পাকিস্তান সিরিজ ২০১৫
  • " />

     

    দুদিনের খণ্ডযুদ্ধ, বাংলাদেশ ২, পাকিস্তান ৩

    দুদিনের খণ্ডযুদ্ধ, বাংলাদেশ ২, পাকিস্তান ৩    

    ধৈর্য ও মানসিকতার কঠিন এক পরীক্ষা টেস্ট ক্রিকেট, সেশনের খেলাও কি নয়? একেকটি সেশন ধরে ধরেই পরিণতির দিকে এগোতে থাকে খেলাটা, যেখানে দুটো দলেরই লক্ষ্য থাকে যত বেশি সেশনে সম্ভব আধিপত্য ধরে রাখা। বেশি সংখ্যক সেশনে প্রাধান্য বিস্তার করেও হেরে যাবার দৃষ্টান্ত যে একেবারে নেই, তা নয়, তবে সেরকম ঘটনা কালেভদ্রে ঘটতে দেখা যায় টেস্টাঙ্গিনায়। টেস্ট জেতার পূর্বশর্ত হিসেবে অধিক সংখ্যক সেশনে এগিয়ে থাকাটা তাই অনেকটা নিয়মের মধ্যেই ধরে নেন ক্রিকেটাররা।

     

    দুটো দিন পেরিয়ে গেল খুলনা টেস্টের, ছয়টা সেশন। দিনের হিসেব করে কালকের দিনটা বাংলাদেশের এবং আজকেরটা পাকিস্তানের বললে ভুল হয়তো হবে না, তবে অতি সরলীকরণ হয়ে যায়, পরিস্থিতিটাও ঠিক ফুটে ওঠে না এখানটায়। সেক্ষেত্রে, সেশন ধরে ধরে প্রকৃত চিত্রটা খোঁজার একটা চেষ্টা করা যেতে পারে-

     


     

    সেশন-১, প্রথম দিনঃ(বাংলাদেশ)

     

    স্কোয়াডের বেশিরভাগ সদস্য যখন পাঁচ মাস পর খেলতে নামছেন দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেট, বড় চ্যালেঞ্জটা ছিল টেস্ট মেজাজ ফিরিয়ে আনা, ম্যাচের প্রথম সেশনে সে লক্ষ্যে সফলই বলা যায় প্রথমে ব্যাট করা বাংলাদেশ দলকে। ওয়ানডেতে দেখানো আগ্রাসনটা তুলে রেখে পুরোদস্তুর টেস্ট মেজাজেই ব্যাট করছিলেন তামিম, ইয়াসির শাহর বলে শর্ট লেগে দেওয়া ক্যাচটাও মারবার প্রয়াস থেকে আসেনি। পুরো সেশনে ঐ একটা উইকেটই পড়েছে বাংলাদেশের, তাও মধ্যাহ্ন বিরতিতে যাবার ওভার তিনেক আগে। আরেক ওপেনার ইমরুলও ছিলেন খোলসের ভেতরেই, ১ উইকেটে ৬০ রান নিয়ে লাঞ্চে যাওয়া বাংলাদেশের অধীনেই ছিল ম্যাচের প্রথম সেশনটা।


     

    সেশন-২, প্রথম দিনঃ(বাংলাদেশ)

     

    ৩৫ রান নিয়ে লাঞ্চে যাওয়া ইমরুল এ সেশনের প্রথমভাগেই তুলে নেন ফিফটি, তবে ফিফটি তুলে নেবার পরের বলেই প্যাভিলিয়নে ফেরেন হাফিজের বলে ‘কট এন্ড বোল্ড’ হয়ে। অঘটন বলতে ওটুকুই, মুমিনুল ও মাহমুদুল্লাহ মিলে বাকিটা সময় শুধু নিরাপদেই পার করেননি, রীতিমত শাসন করেছেন পাকিস্তানী বোলারদের। ইনিংসের হালটা শক্ত করে ধরে রাখার পাশাপাশি দুজনেই খেলেছেন বেশ কিছু দৃষ্টিনন্দন শট। ৯০ রান আসে এ সেশন থেকে, ২ উইকেটে ১৫০ রান নিয়ে চা বিরতিতে যায় বাংলাদেশ। প্রথমটার মত এ সেশনটাও বাংলাদেশের বলে রায় দিতে খুব বেশি মানুষের আপত্তি থাকার কথা নয়।


     

    সেশন-৩, প্রথম দিনঃ(ড্র)

     

    এ সেশনের মাঝামাঝি সময়ে ব্যক্তিগত ৪৯ রানে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন রিয়াদ, দিনের বাকি তখনও ১৬ ওভারের মত। সময়টুকু সাকিবকে সাথে নিয়ে প্রায় কাটিয়েই দিয়েছিলেন টেস্ট ক্রিকেটে ব্র্যাডম্যানীয় সুবাতাস ছড়াতে শুরু করা মুমিনুল, যেটা সম্ভব হলে হয়তো এই সেশনটাকেও বাংলাদেশের প্রাধান্যধন্য বলে দেয়া যেত নির্দ্বিধায়। তবে দিনের খেলা শেষ হবার মাত্র এক বল আগে জুলফিকার বাবরের একটি ‘টার্নিং বল’-এ অপমৃত্যু ঘটে সেঞ্চুরির কাছাকাছি থাকা(৮০) ইনিংসটার। ২ উইকেট, ৮৬ রান- সেশনটাকে আসলে এগিয়ে রাখা যাচ্ছে না কোন দলের পক্ষেই।


     

    সেশন-১, দ্বিতীয় দিনঃ(পাকিস্তান)

     

    ৪ উইকেটে ২৩৬ রান নিয়ে সেশন শুরু করা বাংলাদেশ দলের জন্য চারশোর্ধ্ব কোন সংগ্রহকে দৃষ্টির খুব কাছাকাছি কিছু মনে হচ্ছিল না? দিনশুরুর ওভার চারেকের মধ্যে লেগ-স্লিপে ক্যাচ দিয়ে সাকিব ফিরে গেলেও অসম্ভব হয়ে পড়েনি চারশোর লক্ষ্যটা। বরং অভিষিক্ত সৌম্যকে সঙ্গী করে অধিনায়ক মুশফিক সে পথে মসৃণ গতিতেই এগিয়ে নিচ্ছিলেন দলের ইনিংসটাকে, এ সময় সৌম্যকে খেলতে দেখা যায় বেশ কিছু আগ্রাসী শটও। গোলটা বাধে লাঞ্চে যাবার আগে আগে। চার ওভারের ব্যবধানে সৌম্য, মুশফিক ও তাইজুলকে হারায় বাংলাদেশ, পাকিস্তানী স্পিনারদের কথাও বলতে হয় আলাদা করে। শুরুতে টার্নের ফাঁদে ফেলে সাকিবকে ফিরিয়েছিলেন জুলফিকার, সৌম্যকে বিভ্রান্ত করেন হাফিজ। আর সেশনের শেষ দিকে মুশফিক ও তাইজুলকে ঘূর্ণি জাদুতে রীতিমত বোকা বানান লেগ স্পিনার ইয়াসির শাহ। ৮৯ রানের বিনিময়ে ৪ উইকেট তুলে নিয়ে তর্কাতীতভাবে সেশনটা জিতে নিয়েছে পাকিস্তান।


     

    সেশন-২, দ্বিতীয় দিনঃ(পাকিস্তান)

     

    চারশোর আশাটা ফুরিয়ে গিয়েছিল আগেই, এই সেশনে বাংলাদেশের লক্ষ্য ছিল যতটা সম্ভব এগিয়ে নেওয়া স্কোরটাকে, সে উদ্দেশ্যও ফলপ্রসূ হয়নি। একমাত্র স্বীকৃত ব্যাটসম্যান শুভাগত হোম যেন দর্শক হয়েই অপরাজিত ছিলেন, অন্যপ্রান্তে দ্রুতই উইকেট বিলিয়ে দিলেন শেষ দুই ব্যাটসম্যান শহীদ ও রুবেল। লাঞ্চের পর মাত্র তিন ওভার টিকতে পেরেছিল বাংলাদেশ। ৩৩২ রানের জবাবে পাকিস্তান ব্যাটিংয়ে নামার পর সেশনটা দেখল দু-দুটো সফল রিভিউয়ের আবেদন, দুটোই ‘কট বিহাইন্ড’-এর ব্যাপার। প্রথমটা করেছিলেন হাফিজ, চতুর্থ ওভারে। তাইজুলের বলটা তাঁর ব্যাট ছুঁয়ে উইকেটরক্ষকের কাছে গিয়েছে মনে করে আউট দেন শ্রীলঙ্কান আম্পায়ার র‍্যানমোর মার্টিনেজ, তবে রিভিউতে দেখা যায় ব্যাট পার হবার সময় বল ও ব্যাটের মাঝে ছিল যথেষ্ট ফাঁক, সঙ্গত কারণেই মাঠের আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন টিভি আম্পায়ার পল রেইফেল। পরের সিদ্ধান্তটা পরিবর্তন হয় বাংলাদেশ দলের পক্ষে। বোলার, ফিল্ডার, আম্পায়ার এক্ষেত্রেও একই, শুধু ব্যাটসম্যান ছিলেন সামি আসলাম। মার্টিনেজ আউট না দিলে সঙ্গে সঙ্গে রিভিউ চান মুশফিক, যেখানে দেখা যায় তাইজুলের বলটা সামির গ্লাভসে লেগে জমা হয় মুশফিকের গ্লাভসে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই উইকেটটিই ঐ সেশনে, পরে যেটা হয়ে দাঁড়ায় পুরো দিনেই, বাংলাদেশের বোলারদের একমাত্র সাফল্য। ৭ রানে ২ উইকেট নেয়ার পর ৮৪ রান এল মাত্র ১ উইকেট হারিয়ে, এই সেশনটাও পাকিস্তানের বলতে আপত্তি আছে কারো?



     

    সেশন-৩, দ্বিতীয় দিনঃ(পাকিস্তান)

     

    এটাকে বলা যায় এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ দলের জন্য সবচেয়ে হতাশার সেশন। বল করা হল ৩৩ ওভার, ৪.৩৩ গড়ে প্রতিপক্ষের স্কোরবোর্ডে জমা হল ১৪৩ রান, উইকেটের চেহারা দেখা গেল না। সুযোগ যে একেবারে আসেনি, তা নয়। তবে উইকেটের পেছনে একবার সাকিবের বলে ও একবার শহীদের বলে, দু-দুবার আজহার আলির ক্যাচ ফেলেছেন মুশফিক, দ্বিতীয়টি ধরতে গিয়ে তো চোটই পেয়ে বসলেন হাতে। দিনের বাকি সময় গ্লাভস হাতে দায়িত্ব পালন করেন ইমরুল। এরপর আরও একবার রান-আউটের হাত থেকে বেঁচে যান আজহার। এদিকে বাংলাদেশী বোলারদের উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপন করে মোহাম্মদ হাফিজ তুলে নেন ক্যারিয়ারের অষ্টম টেস্ট সেঞ্চুরি। ১৩৭ রানে অপরাজিত হাফিজ ও ৬৫ রানে অপরাজিত আজহার আলিতে সওয়ার পাকিস্তানকে এই সেশনে জয়ী বলা যায় নির্দ্বিধায়।


     

    ছোট ছোট খণ্ডযুদ্ধ একত্রে মিশেই গড়ে তোলে বিশাল কোন লড়াই, ঠিক তেমনি সেশনের এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জয় পরাজয়ই হয়তো দিনশেষে নির্ধারক হয়ে দাঁড়াবে গোটা টেস্টটার। আপাতত মোটা দাগে বাংলাদেশ-২, পাকিস্তান-৩ হয়তো লেখাই যায়। ছবি-সৌজন্যঃএএফপি