• বাংলাদেশ-পাকিস্তান সিরিজ ২০১৫
  • " />

     

    ২২ গজের সেলুলয়েডঃ এ শুধু প্রাপ্তির দিন!

    ২২ গজের সেলুলয়েডঃ এ শুধু প্রাপ্তির দিন!    

    ছবির পরে ছবি চলে নাকি তৈরী হয় সিনেমা। ক্রিকেট ম্যাচও তো তাই। টুকরো টুকরো অসংখ্য ছবি জন্ম নেয় যেখানে। ২২ গজ আর সবুজ ওই উদ্যানের ছবিগুলোকে যদি ধরা যেত সেলুলয়েডে!

    খুলনা টেস্টের চতুর্থ দিনে দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়ালো বাংলাদেশ। সেই দিনেরই কিছু ছবি-

     

     

    চার ছয়ে পগারপার

     

    জুলফিকার বাবরকে রিভার্স সুইপে চার মেরে ফিফটি করেছেন তামিম ইকবাল। পরের বলেই মেরেছেন ছয়। জুনাইদ খানকে টানা দুই চার মেরে করেছেন সেঞ্চুরি। ইমরুল ফিফটি করেছেন ইয়াসির শাহকে চার মেরে। তবে সেঞ্চুরি এসেছে অবশ্য সিঙ্গেলেই! তাতে কী, ইমরুল কায়েস যে ক্যারিয়ারের ১০০০ রান ছুঁয়েছেন ওই ইয়াসির শাহকেই ছয় মেরে!

     

    ইমরুল টেস্টে হাজার রান করা ১৩তম বাংলাদেশী।

     

     

    মানিকজোড় : প্রসঙ্গ ১ম উইকেট

     

    লর্ডস, ইংল্যান্ড। ২২৩ রানে পিছিয়ে থেকে তৃতীয় ইনিংসে নেমেছিল বাংলাদেশ (ফলোয়িং অন)। তামিম ইকবালের সেই বিখ্যাত সেঞ্চুরি, ইমরুল কায়েস করেছিলেন ৭৫। এবার তৃতীয় ইনিংসে দুজন নেমেছিলেন ২৯৬ রান পিছিয়ে থেকে। তৃতীয় ইনিংসে তাঁদের নিজেদেরই ১৮৫ রানের প্রথম উইকেট জুটির রেকর্ড ভাঙ্গলেন তাঁরা, এরপর ২২৪ রানের বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ ওপেনিং জুটি-ও। টেস্টে বাংলাদেশের দুইশ পেরোনো জুটি হলো পাঁচটি। এর তিনটিতে আছেন তামিম, তিনটিতে ইমরুল। আর দুজন একসাথে আছেন দুটি-তে।

     

     

    মানিকজোড়: প্রসঙ্গ যে কোন উইকেট

     

    দিনশেষে ২৭৩ রানে অবিচ্ছন্ন বাংলাদেশের দুই ওপেনার। আরও কতদূর যাবেন, জানা যাবে কাল, তবে দেশের হয়ে যে কোনো উইকেট জুটিতে সর্বোচ্চ ২৬৭ রানের জুটির রেকর্ডও ভেঙ্গে দিয়েছেন তাঁরা। এর আগের রেকর্ডটি ছিল ৫ম উইকেটে। ২০১৩ সালে গলের মাঠে শ্রীলংকার বিরুদ্ধে করেছিলেন মোহাম্মদ আশরাফুল ও মুশফিকুর রহিম।

     

     

    মানিকজোড়।৩ : যেখানে থেকে শেষ...

     

    জিম্বাবুয়ের সঙ্গে চট্টগ্রামে গত নভেম্বরে শেষ টেস্ট খেলেছিল বাংলাদেশ। তামিম সেঞ্চুরি করেছিলেন, ইমরুল সেঞ্চুরি করেছিলেন। দুজন মিলে গড়েছিলেন দুইশ পেরোনো রানের জুটি (২২৪)।

     

    খুলনায় প্রথম ইনিংসে ৫২ রানের জুটি গড়েছিলেন দুজন, ইমরুল ফিফটি পেলেও তামিম করেছিলেন ২৫ রান।

     

    তবে দ্বিতীয় ইনিংসে পুষিয়ে দিলেন সব। তামিম আবারও করলেন সেঞ্চুরি, ইমরুল-ও করলেন। দুজন মিলে রেকর্ড ভেঙ্গে গড়লেন আবারও দুইশ পেরোনো জুটি। যা এখনও অবিচ্ছিন্ন। নতুন আর কোন ইতিহাস দেখবে কাল খুলনা, এই মানিকজোড়ের ব্যাটযুগল থেকে?

     

     

    সবার ওপরে তামিম

     

    কদিন আগেই ওয়ানডেতে বাংলাদেশের হয়ে প্রায় সবরকম ব্যাটিং রেকর্ড নিজের করে নিয়েছেন। সর্বোচ্চ রান, সেঞ্চুরি, ফিফটি, চার, ছয়। সেই পুরোনো তামিমকে খুঁজে পেয়েছিলেন যেন সবাই। অপেক্ষা ছিল লাল বলের, টেস্টের তামিম ইকবাল যে আরও বেশি রোমাঞ্চকর! প্রথম ইনিংসে ‘স্বভাববিরুদ্ধ’ খেলে হতাশ করলেন, নিজেও কি হলেন না!

     

    দ্বিতীয় ইনিংসে নামলেন সেই তামিম! খেললেন উইকেটের চারপাশে, ফ্রন্টফুটে, ব্যাকফুটে, ডাউন দ্য গ্রাউন্ডে এসে। খুলনায় নিজের ৭ম সেঞ্চুরি দিয়ে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ টেস্ট সেঞ্চুরির মালিকও হয়ে গেলেন তামিম ইকবাল। ছাড়িয়ে গেছেন মোহাম্মদ আশরাফুলকে (৬টি)। তবে সর্বোচ্চ রান, চারে তামিম দ্বিতীয়, ওপরে আছেন সাবেক অধিনায়ক ও বর্তমান নির্বাচক হাবিবুল বাশার।

     

     

    ইমরুল ভয়ঙ্কর

     

    ৫৮তম ওভারের ২য় বলে বাউন্সার দিলেন ওয়াহাব রিয়াজ। একটু বেসামাল হলেন, বল কাঁধে লেগে গেল সরফরাজের কাছে। পরের বলে আবার বাউন্সার, ইমরুল নিলেন সিংগেল। ৫ম বলে আবার স্ট্রাইকে এলেন। যেন আগে থেকেই জানতেন, আবারও বাউন্সার দিবেন রিয়াজ! লেগ স্ট্যাম্পের বাইরে সরে গেলেন, রিয়াজ ঠিকই বাউন্সার দিলেন। কায়েস লাফিয়ে উঠে বল পাঠালে থার্ড ম্যান দিয়ে! বাউন্ডারি।

     

    ৫৯তম ওভারের দ্বিতীয় বলে রিভার্স সুইপে দুই রান নিলেন ইমরুল। পরের বলটি বাবর করলেন অফ স্ট্যাম্পের বাইরে, ইমরুল এবার সুইপ করে মারলেন চার। পরের বলে আবার রিভার্স সুইপ, আবার দুই রান। পরের বলে সুইপ, এবার এক রান।

     

    রিয়াজের বাউন্সার সামলানো বা বাবরকে নিয়ে ছেলেখেলা, ইমরুল যাই করেছেন, হয়েছে ঠিক তাই-ই!

     

     

    অলরাউন্ডার মাহমুদুল্লাহ

     

    মুশফিকের রহিমের অনুপস্থিতিতে তামিমকেই শুধু অধিনায়কত্ব করতে হয়নি, ৩৭তম ওভার থেকে উইকেটকিপিং করতে হয়েছে ইমরুল কায়েসকে। ১২০ ওভার উইকেটকিপিং করে শেষে ক্লান্ত তখন ইমরুল, তার ওপর করতে হবে ওপেনিং। এবার কিপিং গ্লাভস তুলে নিলেন মাহমুদুল্লাহ। তাইজুলের ৪৭তম ওভারের চতুর্থ বলটি ডাউন দ্য গ্রাউন্ডে এসে মারতে চাইলেন জুলফিকার বাবর। মিস করলেন। প্যাডে লেগে উইকেটের পেছনে গেল বল, ধরতে পারলেন না মাহমুদুল্লাহও। প্যাডে লাগলো তাঁরও, তবে প্যাড থেকে এসে লাগলো আবার স্ট্যাম্পে! মনে করিয়ে দিলো, ২০০০ সালে বাংলাদেশের প্রথম টেস্টে পাইলটের ইনজুরিতে উইকেটের পেছনে দাঁড়ানো শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুতের করা প্রায় একই রকম এক ডিসমিসালের কথা। দুর্জয়ের বলে সাবা করিম স্টাম্পড হয়েছিলেন সেবার। 

     

    ফিল্ডার হিসেবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশী ক্যাচ তাঁর, এবার মাহমুদুল্লাহর নামের পাশে যোগ হলো একটি স্ট্যাম্পিং! মাহমুদুল্লাহ আবার এই ইনিংসে চার ওভার বলও করেছিলেন!

     

     

    এবং তাইজুল

     

    ৪৬.৪ ওভার বোলিং করে মেডেন পেয়েছেন মাত্র চারটি। ক্যারিয়ারের সবচেয়ে খরুচে বোলিংও করলেন এই ইনিংসেই। তাতে কী, তাইজুল ইসলাম মনে রাখবেন তাঁর ছয় উইকেটকেই! ছয় ম্যাচে তৃতীয়বারের মতো ইনিংসে পাঁচ উইকেট পেলেন এই বাঁহাতি স্পিনার।  

     

     

    এ এক নতুন বাংলাদেশ

     

    প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশের রানরেট ছিল ২.৭৬। এই ইনিংসে ৪.৪৭! প্রথম ইনিংসে ছয় ছিল না একটিও, এ ইনিংসে এখন পর্যন্ত হয়েছে ৭টি ছয়! প্রথম ইনিংসে তামিম ও ইমরুলের স্ট্রাইক রেট ছিল ৩৩.৭৮ ও ৩৯.২৩। এ ইনিংসে ৭৫.৪০, ৭১.৩০! প্রথম ইনিংসে সেঞ্চুরি নেই একটিও, এই ইনিংসে দুই ওপেনারই করেছেন সেঞ্চুরি! প্রথম ইনিংসে পাকিস্তানের কোনো বোলারেরই ইকোনমি ৩.০৯ পেরোয়নি, আর এ ইনিংসে সবচেয়ে ভাল ইকোনমি ৩.৭৫! ‘শম্বুকগতির’ আক্রমণ নয়, বাংলাদেশ যে নিজের খেলাটা খেললেই ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টির ‘মোমেন্টাম’ ধরে রাখতে পারে, দেখা গেল আরেকবার।

     

    শিক্ষা শুধু খারাপ দিন থেকে নয়, ভাল দিন থেকেও কিন্তু নেওয়া যায়!

     

     

    ক্লান্তি ছাপিয়ে প্রাপ্তি

     

    ইমরুল কায়েস উইকেটকিপিং করেছে প্রায় ১২০ ওভার। আর তামিম ইকবালও অধিনায়কত্ব করেছেন প্রায় সে সময়জুড়েই! মুশফিকুর রহিমের চোট দুজনকেই দিয়েছিল বাড়তি দায়িত্ব। পরে দুজন মিলে ব্যাটিং করেছেন ৬১ ওভার। তার ওপর প্রচন্ড গরম, ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন দুজনই। একবার ইমরুল তো আরেকবার তামিম, শুশ্রুষা দরকার পড়েছিল দুজনেরই। একসময় তো দুজনই একসঙ্গে নিচ্ছিলেন!

     

    তবে দিনশেষে পাকিস্তানী খেলোয়াড়দের অভিনন্দন আর সতীর্থদের ‘গার্ড অব অনার’-এ ক্লান্তি মুছে যাওয়ার কথা তামিম-ইমরুলের।

     

    তাঁদের ব্যাটেই যে নতুন স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ!