রক্ষণে দরকার নতুন মুখ
টানা পাঁচ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ২০১৪-১৫ মৌসুমের ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের চ্যাম্পিয়ন হবার গৌরব অর্জন করলো চেলসি। কার্লো অ্যানচেলোত্তির অধীনে ২০১০ সালের চ্যাম্পিয়ন চেলসি দল গড়েছিল ইংলিশ দলগুলোর মধ্যে এক মৌসুমে সবচেয়ে বেশি গোল (১০৩) দেওয়ার রেকর্ড, যেই রেকর্ড এখনো অটুট। এবারের চ্যাম্পিয়ন চেলসি দলও করলো একটি নতুন রেকর্ড। ২০১৪ সালের ৩০ আগস্ট থেকে টানা ২৭৪ দিন শীর্ষস্থান দখলে রেখে ইংল্যান্ডের সেরা দল হবার কৃতিত্ব লাভ করলো চেলসি। এর আগের রেকর্ড ছিলো ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের, ১৯৯৩-৯৪ মৌসুমে রেড ডেভিলরা ২৬২ দিন শীর্ষস্থানে ছিলো।
২০১৩-১৪ মৌসুমে চেলসি অর্জন করেছিল ৩য় স্থান। চলুন, প্রথমেই ঐ মৌসুমের সাথে তুলনা করে দেখা যাক সদ্য সমাপ্ত এই মৌসুমটিকে।
মৌসুম |
২০১৩ – ১৪ |
২০১৪ - ১৫ |
পয়েন্ট |
৮২ |
৮৭ |
জয় |
২৫ |
২৬ |
পরাজয় |
৬ |
৩ |
ড্র |
৭ |
৯ |
গোল ব্যবধান |
+৪১ |
+৪৪ |
ছক থেকে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে চেলসির উন্নতি। একটি ম্যাচ বেশি জয় করার পাশাপাশি তারা ৩টি ম্যাচ কম হেরেছে। এসাথে এই মৌসুমে চেলসির শিরোপা জয়ের মূল একটি কারণ হচ্ছে শীর্ষদলগুলোর সাথে না হারা। শীর্ষ চার দলের বিপক্ষে চেলসি পেয়েছে তিনটিতে জয় আর বাকি পাঁচটিতে ড্র।
বিপক্ষ দল |
হোম |
অ্যাওয়ে |
আর্সেনাল |
জয় |
ড্র |
ম্যানচেস্টার সিটি |
ড্র |
ড্র |
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড |
জয় |
ড্র |
লিভারপুল |
ড্র |
জয় |
চেলসির এই উন্নতির নেপথ্যে ছিলেন ম্যানেজার হোসে মরিনহো। তিনি বুঝতে পারেন আগের মৌসুমে চেলসির ঘাটতিগুলো বুঝে নিয়ে কিনে আনেন দারুণ কিছু খেলোয়াড়। সেই সাথে পুরনো কিছু খেলোয়াড়ও আবার প্রমাণ করেন তাদের সামর্থ্য। চলুন, এক নজরে দেখে নেয়া যাক এই মৌসুমের আলো ছড়ানো তারকাদের :
১. এডেন হ্যাজার্ড
নাম |
এডেন হ্যাজার্ড |
ম্যাচ |
৩৮ |
গোল |
১৪ |
অ্যাসিস্ট |
৯ |
হলুদ কার্ড |
২ |
লাল কার্ড |
০ |
এই মৌসুমে প্রিমিয়ার লীগের সেরা খেলোয়াড় ছিলেন হ্যাজার্ড। শুধু জাদুকরী ড্রিবলিং আর অনবদ্য পাসিংয়ের জন্যই নয়, বিপদের সময়ে দলের রক্ষাকর্তার ভূমিকায় ছিলেন বেলজিয়ান এই উইঙ্গার। আর দলের প্রতি তার অবদানের জন্যই নির্বাচিত হয়েছেন “বার্কলেস প্রিমিয়ার লীগ বর্ষসেরা খেলোয়াড়”, “পিএফএ বর্ষসেরা খেলোয়াড়”, “চেলসি বর্ষসেরা খেলোয়াড়” হিসেবে। এই মৌসুমে ১৪ গোল আর ৯টি অ্যাসিস্ট ছাড়াও গোলের সুযোগ তৈরীর দিক দিয়েও তিনি এগিয়ে ছিলেন অন্য সবার থেকে। ৯৯টি গোলের সুযোগ তৈরী করেছেন তিনি। তিনি সেই সাথে ছিলেন প্রিমিয়ার লীগের সবচেয়ে বেশি ফাউলের শিকার হওয়া খেলোয়াড়। তাকে ফাউল করার কারণে ২৩ জন ভিন্ন ভিন্ন খেলোয়াড় দেখেছেন হলুদ কার্ড।
২. ডিয়েগো কস্তা
নাম |
ডিয়েগো কস্তা |
ম্যাচ |
২৬ |
গোল |
২০ |
অ্যাসিস্ট |
৩ |
হলুদ কার্ড |
৮ |
লাল কার্ড |
০ |
এই মৌসুম শুরুর আগে স্পেনের হয়ে হতাশাজনক এক বিশ্বকাপ কাটানো কস্তার দিকে সমালোচকদের ছিলো কড়া দৃষ্টি। কিন্তু সমালোচকদের বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দারুণ এক মৌসুম কাটালেন কস্তা। প্রথম পাঁচ ম্যাচের প্রতিটিতেই গোল করে নিজের জাত চেনান কস্তা। কিন্তু । গত মৌসুমে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের হয়ে শেষের দিকে পাওয়া হ্যামস্ট্রিং ইনজুরি আর রগচটে স্বভাবের কারণে পাওয়া নিষেধাজ্ঞার কারণে এই মৌসুমে নিজের পুরোটা দিতে পারেননি তিনি। এই মৌসুমে মাত্র ২৬ ম্যাচ খেলে করেন ২০টি গোল।
৩. সেস্ক ফ্যাব্রিগাস
নাম |
সেস্ক ফ্যাব্রিগাস |
ম্যাচ |
৩৫ |
গোল |
৩ |
অ্যাসিস্ট |
১৮ |
হলুদ কার্ড |
১১ |
লাল কার্ড |
১ |
এই মৌসুমে চেলসির আরেকজন সুপারস্টার হচ্ছেন স্প্যানিশ এই মিডফিল্ডার। চেলসির প্রতিদ্বন্দ্বী আর্সেনালের হয়ে প্রিমিয়ার লীগে খেলেছেন ৮ বছর, ছিলেন আর্সেনালের অধিনায়কও। এই মৌসুমের শুরুতে মরিনহো বার্সেলোনা থেকে চেলসিতে কিনে আনেন এই মিডফিল্ড মায়েস্ত্রোকে। নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়েছেন প্রথম মৌসুমেই। এই মৌসুমে ১৮টি গোল করিয়েছেন তিনি, যা প্রিমিয়ার লীগে সর্বোচ্চ। শুধু তাই নয়, তার অসাধারণ পাসিং আর মাঝমাঠের বল নিয়ন্ত্রণ চেলসির শিরোপা জয়ের লড়াইয়ে কাজ করেছে জ্বালানী হিসেবে। প্রিমিয়ার লীগে এই মৌসুমে সবচেয়ে বেশিবার বল 'টাচ' করেছেন সেস্ক ফ্যাব্রিগাস। এছাড়াও গোলের সুযোগ তৈরীর দিক দিয়ে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় সেরা (৯১টি)।
৪. জন টেরি
চেলসি অধিনায়ক জন টেরিকে অনেকেই ফেলে দিয়েছিলেন বাতিলের খাতায়। কিন্তু গত মৌসুমের শুরুতে হোসে মরিনহোর আগমন যেন নতুন এক টেরির জন্ম দিয়েছে। নিজের ক্যারিয়ারের সেরা সময় পার করছেন তিনি। ৩৪ বছর বয়সী এই ডিফেন্ডার এই মৌসুমে খেলেছেন সব ম্যাচের প্রতিটা মিনিট; সাবেক ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ডিফেন্ডার গ্যারী পেলিস্টারের পর ২য় খেলোয়াড় হিসেবে এই কৃতিত্ব অর্জন করেছেন টেরি। এছাড়াও বাকি সব ডিফেন্ডারদের থেকে অন্য একদিক দিয়ে এগিয়ে থেকেছেন চেলসি অধিনায়ক। এই মৌসুমে তিনি ক্যারিয়ারের ৩৯তম গোল করে প্রিমিয়ার লীগের সর্বোচ্চ গোলদাতা ডিফেন্ডার হবার রেকর্ড গড়েন।
৫. নেমানিয়া ম্যাটিচ
এই মৌসুমে চেলসির সাফল্যের এক অন্যতম হাতিয়ার ছিলেন ম্যাটিচ। ডিফেন্সিভ মিডফিল্ড ভূমিকায় তিনি ছিলেন এই মৌসুমে প্রিমিয়ার লীগের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়। এর প্রমাণ, এই মৌসুমে তার ১০১টি ট্যাকেল, যা প্রিমিয়ার লীগেই সর্বোচ্চ। তিনি চেলসি মিডফিল্ডে থেকে চেলসি ডিফেন্ডারদের একটু বাড়তি নিরাপত্তা দিয়েছেন আর মাঝে মাঝে আক্রমণেও করেছেন দারুণ সাহায্য।
এছাড়াও উইলিয়ান, রামিরেস, কার্ট জুমা, ইভানোভিচ, লোয়িক রেমি-রা দলের প্রয়োজনে সাহায্য করেছেন। ডিয়েগো কস্তার অনুপস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু গোল করে দলকে শীর্ষস্থান ধরে রাখতে সাহায্য করেন রেমি।
হতাশ করেছেন যারা
এই মৌসুমে চেলসির সব খেলোয়াড়ই যে ভালোভাবে মন মাতাতে পেরেছেন তা কিন্তু নয়। কিছু খেলোয়াড় রয়েছেন যাদের উপর নেমে আসতে পারে খড়গ, চেলসি ছেড়ে পাড়ি জমাতে হতে পারে অন্য ক্লাবের উদ্দেশ্যে।
১. হুয়ান কুয়াদ্রাদো
এই বছরের জানুয়ারী মাসে ইতালিয়ান ক্লাব ফিওরেন্টিনা থেকে চেলসি ২৬ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে কিনে আনে এই কলম্বিয়ান উইঙ্গারকে। দারুণ গতি আর ড্রিবলিং স্কিলের জন্য নাম কামানো এই উইঙ্গার কলম্বিয়ার হয়ে বেশ ভালো একটি বিশ্বকাপ কাটান। কিন্তু চেলসিতে আসার পর তার প্রতিভার প্রতি সুবিচার করতে পারেননি তিনি। ১২ ম্যাচ খেলে এই মৌসুমে কোন গোল বা অ্যাসিস্ট ছিল না তাঁর।
২. অস্কার
সদ্য শেষ হওয়া মৌসুমের শুরুটা করেছিলেন দারুণভাবে। বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ গোল আর অ্যাসিস্ট করে দলকে সাহায্যও করেন দারুণভাবে। কিন্তু ২০১৫ এর ফেব্রুয়ারী মাস থেকে ফর্মের ঘাটতিতে ভুগতে থাকেন অস্কার। যার ফলস্বরূপ ব্রাজিলের ২০১৫ কোপা আমেরিকার দলেও ঠাঁই হয়নি তার। এই মৌসুমে ৩০ ম্যাচ খেলে করেন ৬ গোল আর ৮ অ্যাসিস্ট। বাজারে গুঞ্জন আছে জুভেন্টাস তাকে কিনতে আগ্রহী।
দলবদলের হাওয়া
মৌসুমের শেষে সব ক্লাবই ব্যস্ত হয়ে ওঠে যেইসব জায়গায় ঘাটতি রয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে নতুন কিছু খেলোয়াড় দলে ভেড়ানোর। আর দলটা যদি হয় চেলসি আর ম্যানেজার হোসে মরিনহো তবে তো কথাই নেই। দেখে নেয়া যাক কোন পজিশনগুলোতে মরিনহো যোগ করতে পারেন নতুন মুখ-
- রক্ষণভাগ
এই মৌসুমে চেলসির ডিফেন্সে ছিলো খেলোয়াড় ঘাটতি। মাত্র ছয়জন ডিফেন্ডার নিয়ে পুরো মৌসুম পার করে দেন মরিনহো। অধিনায়ক জন টেরি এই মৌসুমে লীগের প্রতিটি ম্যাচের প্রতিটি মিনিট খেলেছেন। সেই সাথে রাইট ব্যাক ইভানোভিচও খেলেছেন প্রতিটি ম্যাচ। সেন্টার ব্যাক পজিশনে টেরি আর ক্যাহিলের বিকল্প হিসেবে ছিলেন ২০ বছর বয়সী কুর্ট জুমা। তাই চেলসি রাইট ব্যাক আর সেন্টার ব্যাক পজিশনে কিনতে পারে নতুন খেলোয়াড়। এর মধ্যে শোনা যাচ্ছে রিয়াল মাদ্রিদ সেন্টার ব্যাক রাফায়েল ভারানে আর সাউদ্যাম্পটন রাইট ব্যাক নাথান ক্লাইনের নাম।
- মধ্যমাঠ
চেলসি মিডফিল্ড অনেক ভালো খেললেও মরিনহো দলের প্রয়োজনে কিনতে পারেন নতুন খেলোয়াড়। এই দলবদলের বাজারে অন্যতম আরাধ্য খেলোয়াড় হচ্ছেন পল পগবা। জুভেন্টাসের এই মিডফিল্ডারকে কেনার জন্য ইউরোপের বড় সব ক্লাবই আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তাই তাকে চেলসিতে আনা এতো সহজ হবে না। তবে চেলসি মিডফিল্ডার অস্কারের প্রতি জুভেন্টাসের আগ্রহের কারণে যেকোন কিছু হয়েও যেতে পারে।
- আক্রমণভাগ
এই মৌসুমে চেলসির অ্যাটাক ছিলো দারুণ সাবলীল। ডিয়েগো কস্তা, লোয়িক রেমি আর চেলসি কিংবদন্তি দিদিয়ের দ্রগবার সাথে মাঠের দুই প্রান্ত থেকে এডেন হ্যাজার্ড আর উইলিয়ানের সমন্বয়ে বেশ ভালো মৌসুম কাটায় চেলসি। কিন্তু দ্রগবাকে ইতোমধ্যেই বিদায় জানিয়ে দেয়ায় আর কুয়াদ্রাদো নিজের সেরাটা না দেখাতে পারায় আক্রমণে মরিনহো যে এইবার টাকা ঢালবেন তা মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যায়। গত মৌসুমে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে খেলা র্যাদামেল ফ্যালকাও আর অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের অ্যান্তোয়িনে গ্রিজম্যানের নাম শোনা যাচ্ছে বেশ।