এ শুধু কুকের দিন...
পঞ্চম টেস্ট, ওভাল
চতুর্থ দিনশেষে
ইংল্যান্ড ১ম ইনিংস ৩৩২ (বাটলার ৮৯, কুক ৭১, জাদেজা ৪/৭৯, ইশান্ত ৩/৬২) ও ২য় ইনিংস ৪২৩/৮ ডিক্লে. (কুক ১৪৭, রুট ১২৫, বিহারি ৩/৩৭)
ভারত ১ম ইনিংস ২৯২ (জাদেজা ৮৬*, বিহারি৫৬, অ্যান্ডারসন ২/৫৪, মইন ২/৫০) ও ২য় ইনিংস* ৫৮/৩
ভারতের জয়ের জন্য ৭ উইকেটে ৪০৬ রান প্রয়োজন
যখন সময় থমকে দাঁড়ায়...
এদিন জো রুট ২৮ ইনিংস পর সেঞ্চুরি পেলেন, ক্যারিয়ারে ১৪তম। এদিন জেমস অ্যান্ডারসন বসলেন গ্লেন ম্যাকগ্রার পাশে, আর একটি উইকেট হলেই ইতিহাসের সেরা ফাস্ট বোলার হবেন তিনি উইকেটসংখ্যার দিক দিয়ে। রিচার্ড হ্যাডলিকে ছাড়িয়ে গেলেন স্টুয়ার্ট ব্রড। এদিন বিরাট কোহলি আউট হলেন প্রথম বলেই, চার বছর পর গোল্ডেন ডাক তার, ১২২ ইনিংসের ক্যারিয়ারে মাত্র তৃতীয়বার!
এদিন ইংল্যান্ড ৪-১ ব্যবধানে সিরিজ জিততে এগিয়ে গেল আরেকটু। ভারতের এখনও প্রয়োজন ৪০৬ রান, বাকি ৭ উইকেট। আর পুরো একটি দিন। তবে এসব তথ্য বা কথা ক্রিকেট ম্যাচের পুরষ্কার বিতরণীর সেই কথাগুলোর মতো- যেখানে “যারা ম্যাচসেরা বা সিরিজসেরা হতে পারতেন”- তাদের পারফরম্যান্সগুলো বলা হয়। মূল পুরষ্কারটা দেওয়া হয় আরেকজনকে, যিনি ছাপিয়ে গেছেন বাকি সবাইকে।
ওভালে আজ অ্যালেস্টার কুক ছাপিয়ে গেছেন সবাইকে। ক্যারিয়ারের শেষ ইনিংসে কুক যা করেছেন, তা শুধু রুপকথায় মানায়। যা ঠাঁই পায় ইতিহাসে!
আগের দিন ৪৬ রানে অপরাজিত ছিলেন। ওভাল আজ তার ফিফটির সময় উঠে দাঁড়ালো। প্রতিটি রানে উল্লাস করলো যেন। ৮৯ থেকে ৯০ রানে যেতে খেললেন ১৪ বল। যেন চাপা একটা উত্তেজনা, যেটার পারদ বাড়ছে শুধু। স্ট্রেইড ড্রাইভে চার মেরে ৯১ থেকে ৯৫- কুক আর রুপকথার দূরত্ব তখন পাঁচ রান।
এরপর সিঙ্গেল। ৯৬। জাদেজার শর্ট অব লেংথে থার্ডম্যানের দিকে আলতো করে খেললেন, জোর হলে একটি সিঙ্গেল পাবেন। ফিল্ডার বুমরাহর ওপর ভর করলো কিছু একটা। থ্রো করলেন নন-স্ট্রাইক প্রান্তে। যে থ্রো ধরার সাধ্য ছিল না কারও। ওভারথ্রো। ৫ রান। কুক, ১০১- তার শেষ ইনিংসে!
এরপর যেন ওভালকে কেউ থামাতে পারছিল না। চারপাশ ঘুরে কুক অভিনন্দনের জবাব দিলেন, মুখে লাজুক একটা হাসি নিয়ে। রুট করতালিতে মুখর, প্রতিটি ভারতীয় ফিল্ডার হাততালি দিচ্ছেন। ওভালের দর্শকদের কেউ থামাতে পারছে না। দীর্ঘ সময় ধরে করতালি দিয়ে যাওয়ার রেকর্ড যেন গড়বেন তারা!
আম্পায়ার কুমার ধর্মসেনা এসে কুককে কী যেন বললেন। ওভাল থামছে না। কুক আরেকবার ব্যাট তুললেন, তাদের শান্ত করতে! এরপর ঘাড় খানিকটা কুঁচকে অতি বিনয়ে যেন বলার চেষ্টা করলেন- এবার থামেন প্লিজ! তারা থামলেন। ‘দীর্ঘ’ অপেক্ষার পর, জাদেজা তার বোলিং শুরু করার পরই শুধু।
ওভালে ইংল্যান্ড-ভারতের রোমাঞ্চকর সিরিজের শেষ টেস্টের চতুর্থ দিন চলছে- যেন মনেই নেই তখন কারও! রুটের সঙ্গে কুকের জুটিটা বাড়ছেই শুধু, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তাই লিডও!
কুকের সেঞ্চুরির মুহুর্ত..
কুক থামলেন ১৪৭ রানে। এর আগের বলেই ১২৫ রান করে হনুমা বিহারির প্রথম টেস্ট উইকেটে পরিণত হয়েছেন ইংলিশ অধিনায়ক। রুট এদিন সিরিজে নিজের সেরা ব্যাটিংটা করেছেন, ছিলেন আত্মবিশ্বাসী, তার শটে ছিল প্রত্যয়। এতদিন শুধু চেয়ে চেয়ে প্রতিপক্ষ অধিনায়ক কোহলির ব্যাটিং দেখেছেন, আজ দেখালেন নিজে কিছু।
পরের বলেই বিহারিকে কাট করতে গিয়ে পান্টের হাতে ধরা পড়লেন কুক। ক্যারিয়ারে শেষবারের মতো! ওভাল উঠে দাঁড়াল আবার। মাঠের যে কোণাতেই থাকুন না কেন, ছুটে এলেন সব ভারতীয় ফিল্ডার। একে একে করমর্দন করলেন সবাই, প্রতিপক্ষ ভুলে, ম্যাচের অবস্থা ভুলে তারা তখন সবাই ক্রিকেটের প্রতিনিধি। বিদায় জানাতে ব্যস্ত ক্রিকেটের অসাধারণ এক দূতকে!
ইংল্যান্ডের লিড বাড়লো। বেইরস্টো ফিরলেন, বাটলার ফিরলেন। স্টোকস ৩৭ করলেন। কারানের উইকেট যাওয়ার পর ৪৬৩ রানের লিড যথেষ্ট মনে হলো রুটের কাছে। ইনিংস ঘোষণা করলেন। ইশান্ত শর্মা চোট পেয়ে এদিন মাঠের বাইরে ছিলেন, বিহারি হ্যাটট্রিকের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন- বোলিংয়ে অদ্ভুত এক দিনই কাটিয়েছে ভারত।
এরপর অ্যান্ডারসনের পালা। ব্রডের পালা। আপনি এলবিডব্লিউর ভক্ত হয়ে থাকলে শিখর ধাওয়ান ও চেতেশ্বর পুজারার উইকেট দুটি দেবে চোখের প্রশান্তি। আর পছন্দ না করলে আপনাকে হতে হবে দারুণ বিরক্ত। কোহলি আরেকবার অফস্টাম্পের বাইরের বলে খোঁচা মেরে কট-বিহাইন্ড, ব্রডের বলে। অ্যান্ডারসনের আর পাওয়া হলো না কোহলির উইকেট!
বিদায়, শেফ!
এরপরই যেন বদলে গেল সব। ২ রানে ৩ উইকেট হারানো ভারত যেন নতুন করে শুরু করল রাহুল ও রাহানের ব্যাটিংয়ে। রাহুল প্রথমে মরিয়া কিছু শট খেললেন, এরপর পেলেন পুরো নিয়ন্ত্রণ। ৪৬ রানে দিনশেষে থাকলেন অপরাজিত। আরেকপাশে রাহানে ৪৭ বলে ১০ রানে অপরাজিত।
মইন আলির শেষ বলটা রাহানের ব্যাট-প্যাডে লেগে ক্যাচের মতো উঠে গেল শর্ট লেগে। সামনে ঝুঁকেও ক্যাচের নাগাল পেলেন না কুক। ওভাল চিৎকার করে উঠল আরেকবার।
দিনশেষের ব্যাটিংয়ের স্বস্তি ভুলে রাহানে হাত বাড়ালেন কুকের দিকে। এরপর বাকি সবাই। আবার উঠে দাঁড়ালো ওভাল। শুধু ইংল্যান্ড দল না, রাহানে-রাহুলও দাঁড়িয়ে থাকলেন। আগে যাবেন কুক, তারপর বাকি সবাই।
কুক ড্রেসিংরুমের সিঁড়িয়ে বেয়ে আড়াল হলেন। গোটা দিনের সারাংশটা যেন ধারাভাষ্যে তুলে ধরলেন মাইকেল হোল্ডিং- “অ্যালেস্টার কুক মাঠ ছেড়েছেন। আপনারা যেতে পারেন।”