• " />

     

    এক হাতের ‘হার্পূন’ : একজন সুজা ভাইয়ের গল্প

    এক হাতের ‘হার্পূন’ : একজন সুজা ভাইয়ের গল্প    

    গল্পটা ব্যক্তিগত। গল্পটা ক্রিকেটের। গল্পটা এখন বাংলাদেশের।

     

    গল্পটা সুজা ভাইয়ের।

     

     

    সুজাউল ইসলাম, আমাদের সুজা ভাই। প্রথম কবে দেখেছিলাম, মনে করতে পারি না এখন। পাড়ায় পাড়ায় খেলায় হবে হয়তো। অথবা স্কুলের খেলায়। বাঁহাতি বোলার। ব্যাটসম্যানও তাই। প্রথম দেখাতেই একটা ‘অস্বাভাবিকতা’ চোখে পড়ার কথা। সেভাবে পড়েনি। বয়সটা স্বাভাবিক-অস্বাভাবিকের তারতম্য করতে শেখায়নি তখনও হয়তো! সুজা ভাইকে এরপর অনেকবার দেখেছি। একসাথে খেলার কথা মনে পড়েনা, তবে তাঁদের খেলায় আম্পায়ারিং করেছি অসংখ্যবার। সুজা ভাই আমার কঠিনতম পরীক্ষা নিতেন। একই সঙ্গে উপহার দিতেন অন্যরকমের এক রোমাঞ্চ। নেন এখনও! দেন এখনও!

     

     

    কয়েকদিন আগেই বিরামপুর (দিনাজপুরের একটা থানা) গিয়েছিলাম। একটা টুর্নামেন্ট চলছে। যথারীতি দায়িত্ব, আম্পায়ারিং করতে হবে। এক ম্যাচের আগে শুনলাম, দলটা সুজা ভাইদের। তবে সেই পাড়ার দলটা নয়। খেলোয়াড় বাছাই পদ্ধতিতে দল গঠন করা হয়েছে, রাউন্ড রবিন লীগের এক টুর্নামেন্ট। সেরকমই একটা দলের দায়িত্ব সুজা ভাইয়ের। পড়াশুনা, পারিবারিক কারণে তিনিও আমার মতোই এলাকার বাইরে ছিলেন। তাঁর খেলা আর আমার আম্পায়ারিং, ব্যাটে বলে হয়নি অনেকদিন।

     

     

     

    তিনি অধিনায়ক, শুরুতে বোলিংয়ে এলেন না। খুব করে চাইছিলাম, আমি যেদিকে দাঁড়িয়েছি, সেই এন্ড থেকে যেন বোলিং করেন। কতদিন দেখি না, সুজা ভাইয়ের বোলিং। কতদিন সেই চিরচেনা চাপটা অনুভব করিনা, এই বুঝি পায়ে লাগলো বল! এই বুঝি সুজা ভাই আমার দিকে ঘুরে দুই পা মেলিয়ে দাঁড়ালেন, এক হাত উপরে তুলে আবেদন করলেন! বেশীরভাগ সময়েই আমি নিরুপায়, বেশীরভাগ আম্পায়ারেরই আঙ্গুল তোলা ছাড়া যে তখন উপায় নেই!

     

     

    একটা বলের কথা মনে পড়ছে। অন্য মাঠে, অন্য কোনো এক টুর্নামেন্টের ম্যাচে। অফস্ট্যাম্পের একটু বাইরে পড়া একটা বল, ভিতরে ঢুকলো নীচু হয়ে। পায়ে লাগলো ব্যাটসম্যানের। যথারীতি সুজা ভাইয়ের আবেদন, কিন্তু আমি নির্বিকার! একটু হাসি আনবার চেষ্টা করলাম, সুজা ভাই হতবাক! ‘এটা আউট দিলা না, ভাই!’- তাঁর মুখভঙ্গীর অনুবাদ তখন এমন! আমি হাতটা দেখিয়ে পেছনে ঘুরতে ইশারা করলাম, সুজা ভাই খেয়াল করেননি বিষয়টা। পা দিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি ব্যাটসম্যানের, বোল্ড হয়েছেন যে তিনি!

     

     

    সুজা ভাই আমার এন্ডে বোলিং করতে এলেন না। ‘ওভার কম্বিনেশন’ ঠিক রাখতে বিপরীত এন্ড থেকেই শেষ করলেন বোলিং। ব্যাটিংয়ে এর আগে দলের চরম দুরাবস্থায় হাল ধরেছিলেন। উইকেটও পেলেন। ম্যাচসেরাও হলেন। তবে আমার আফসোসটা রয়ে গেল। আমার ‘এন্ড’ থেকে সুজা ভাইয়ের সেই ‘স্কেল-মাপা’ বোলিং না দেখার আফসোস! ব্যাপার নাহ, ভবিষ্যত তো আছেই, অপেক্ষায়।

     

     

    সুজা ভাইও অপেক্ষায় ছিলেন। এবার গিয়েই শুনেছিলাম তথ্যটা। গতকাল এক সাংবাদিক ভাইয়ের বাসায় গিয়েছিলাম। বিসিবি সামনে ‘শারীরিক প্রতিবন্ধী’দের নিয়ে যে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে চলেছে, তার শুভেচ্ছাদূত মাশরাফি বিন মর্তুজা। এ নিয়েই মাশরাফির সাক্ষাৎকার। সেখানে বাংলাদেশ দলের সঙ্গে দাঁড়িয়ে মাশরাফি, এমন একটা ছবি। সেই ভাইয়ের কম্পিউটারের স্ক্রিনের ছবিটায় আমি সুজা ভাইকে খুঁজলাম। পেলাম না!

     

     

    ফিরে এসে লেখাটা পড়ার জন্য খুলেছি। আবার ছবিটার দিকে তাকালাম। সেখানে বসে আছেন সুজা ভাই! যে বিজ্ঞাপনটা বানানো হয়েছে, তাতেও আছেন তিনি! ভিডিওটার শেষের দিকে মাশরাফি বলছেন, ‘মাঠ মাতাতে আসছে, বিসিবি ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড ক্রিকেট টিম। ওদের সাথে থাকুন।’ বাংলাদেশ দল সমস্বরে হাত তুলে চিৎকার করে উঠলো, ‘আমরাও পারি।’

     

     

    হ্যাঁ, সুজা ভাইও আছেন সেখানে। বাঁহাত তুলে তিনিও গলা মেলালেন। সেই চিরচেনা বাঁহাত। যে হাতের ভেলকি আমি দেখেছি কত অসংখ্যবার। যে হাত থেকে বেড়িয়ে যাওয়া বল আমাকে রোমাঞ্চ যুগিয়েছে। যে হাতের ব্যাটিং আমি মুগ্ধ নয়নে দেখেছি। হ্যাঁ, এক হাতেরই ব্যাটিং। সুজা ভাইয়ের অন্য হাতটা চলতি ভাষায় ‘প্রায় অচল’! ব্যাট গ্রিপিংয়ে সে হাতটা শুধু ‘নিয়মরক্ষার’ জন্যই ব্যবহার করেন তিনি!

     

     

    প্রথম দেখাতেই এই অস্বাভাবিকতা নজরে পড়ার কথা। তবে সুজা ভাইয়ের খেলা দেখে এই ‘অস্বাভাবিকতা’ ভুলে যাবেন যে কেউ। আমার হয়তো নজরে পড়েনি তখন। অথবা আমিও হয়তো ভুলে গিয়েছি এভাবে। তবে যতদিনে বুঝতে শিখেছি সব, সুজা ভাইকে এ নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়নি কখনও। সবকিছু যে জিজ্ঞাসা করতে নেই!

     

     

    অভিনন্দন জানাতে ফোন দিয়েছিলাম। নিয়ম রক্ষার্থেই জিজ্ঞাসা করলাম, চিনতে পারছেন কিনা', জিজ্ঞাসা করাতে হাসি দিলেন। ‘কী যে বলো ভাইয়া! তোমার মেসেজ দেখতেছিলাম।’ সুজা ভাই বিসিবির ‘ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড টিম’-এর ১৫ সদস্যের দলে আছেন। আশা করি খেলবেন। ২ তারিখে মাতাবেন মিরপুর শের-ই-বাংলার ওই সবুজ চত্বর! যে বাঁহাতের ভেলকি দেখেছি এতদিন শুধু আমরা, এবার দেখবে বাংলাদেশ। দেখবে বিশ্ব। নবাব মনসুর আলী খান পতৌদির নাম সুজা ভাই নিশ্চয়ই শুনেছেন। চাইলে সুজা ভাই তাঁর জীবন থেকে অনুপ্রেরণা খুঁজতে পারেন। কিন্তু সুজা ভাই নিজেই তো এক অনন্য অনুপ্রেরণার নাম!

     

     

     

    ফোনে কথা বলার শেষের দিকে বললেন, ‘২ তারিখ চলে আসিও, মিরপুরে। এই একটিই ম্যাচ সেখানে, বাকীগুলো বিকেএসপিতে। আর দোয়া করিও, বাংলাদেশ দলের জন্য।’ একবারও ‘আমাদের জন্য বা আমাদের দলের জন্য’ বললেন না। বলবেনই বা কেন, তিনি যে এখন বাংলাদেশের প্রতিনিধি। মাশরাফি যাঁদের ‘আসল বীর’ বলেন, তিনিও তাঁদের একজন! যে দলের জন্য সুজা ভাই দোয়া চান, সে দলেই আছেন আরও ১৪ জন সুজা ভাই। ক্যাম্পে আছেন আরও ৫ জন।

     

     

    আমি নিশ্চিত, সুজা ভাইয়ের মতো তাঁদেরকে নিয়েও লেখা হবে। আরও অনেকদিন পর ক্রিকেটের ওয়েবসাইটগুলোতে হয়তো সুজা ভাইদেরও ‘প্রোফাইল’ থাকবে। সুজা ভাইদের খেলা দেখতে হাজির হবে হাজার হাজার দর্শক। সমস্বরে চিৎকার উঠবে, ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ বলে! ঠিক যেভাবে সুজা ভাই তাঁর ছেলেকে ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ বলে চিৎকার করা শেখান। সে ভিডিও ফেসবুকে আপলোড দেন এই বলে, ‘আমি গর্বিত, আমার বেটা (ছেলে) বাংলাদেশী!’

     

     

    আমরাও গর্বিত সুজা ভাই। আপনাকে নিয়ে, আপনাদের নিয়ে।

     

     

    গল্পটা যে শেষ নয় সুজা ভাই।

     

     

    শুরু মাত্র!

     

     

     

    (ছবিটি সুজাউল ইসলামের ফেসবুক প্রোফাইল থেকে নেওয়া)