• বাংলাদেশ-ওয়েস্ট ইন্ডিজ
  • " />

     

    কতোটা ভাল অলরাউন্ডার সাকিব? (পর্ব-১)

    কতোটা ভাল অলরাউন্ডার সাকিব? (পর্ব-১)    

    স্বত্ব- সামী হাসান


    চট্টগ্রাম টেস্টে সাকিব ফিরেছেন এক সিরিজ বিরতির পর, চোট থেকে পুরো ফিটনেসে ফিরেছেন কিনা নিশ্চিত ছিল না; তবে বোলিংয়ের প্রথম বলেই ফিরলেন স্বরূপে। শেই হোপকে বোল্ড করে ঢুকে গেলেন ক্রিকেটারদের অভিজাত একটি ক্লাবে। ‘ম্যাচের প্রথমদিন-উইকেট-পাওয়া-বামহাতি-বোলার’-ধরনের অতি-বিশেষায়িত ক্লাব নয়, বরং টেস্ট ক্রিকেটারের অভিজাত ও স্বল্পসংখ্যক সদস্যের এক তালিকা এটি। টেস্টে ৩০০০ রান ও ২০০ উইকেটের ডাবল-এর এই দলে চৌদ্দতম সদস্য মাত্র, প্রায় দেড়শ বছরের টেস্ট ইতিহাসে কয়েক হাজার ক্রিকেটারের মধ্য থেকে। এই তালিকার কষ্টিপাথরেই আরেকবার দেখা যাক সাকিবের অলরাউন্ডার সত্তাটিকে। এই যাচাইয়ের পুরোটিই সংখ্যানির্ভর পর্যবেক্ষণ, আর আমরা দুইটি ভাগে দুইটি প্রেক্ষাপট থেকে দেখবো এটি-

    প্রথমভাগ-  যোগফল। উদ্দেশ্য- ক্যারিয়ারের অর্জনের মোট সংখ্যাগুলো দেখা, অন্যান্য অলরাউন্ডারদের অর্জনের মাত্রায় সাকিবের অবস্থানটা জানা।
    দ্বিতীয়ভাগ- পরিক্রমণ। উদ্দেশ্য- ক্যারিয়ারের টাইমলাইন ধরে দেখা, অন্যান্য অলরাউন্ডারদের বেড়ে ওঠার ধারার সঙ্গে সাকিবের গতিপথটা জানা।

    প্রথম কথা, এই ডাবল-ক্লাবের তালিকাটি বেশ বৈচিত্রপূর্ণ, যার প্রতিষ্ঠাতা তর্কসাপেক্ষে সর্বকালের সেরা ক্রিকেটারদের একজন- গ্যারি সোবার্স। ১৯৭১ সালের এপ্রিলে ভারতের বিপক্ষে টেস্টে চার উইকেট পেয়ে এই ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। ততদিনে অবশ্য তার নামের পাশে ছিল ৭০০০-এর অধিক রান। প্রায় এক দশক পরে দুর্দান্ত এক বছর পার করার পর ১৯৮২ সালে সোবার্সের সঙ্গে যোগ দেন ইয়ান বোথাম। কপিল যুক্ত হন ১৯৮৫ সালে, ইমরান তার চার বছর পর, আর রিচার্ড হ্যাডলি এখানে যোগ দিয়ে ‘গ্রেট ফোর’-এর চক্র পূরণ করেন ১৯৯০ সালে। 

    এরপর প্রায় এক দশক নিরুত্তাপ ছিল এই তালিকা। সেটি আবার প্রাণ ফিরে পায় ২০০৪ সালে ক্রিস কেয়ার্নসের অন্তর্ভুক্তিতে। সে বছর যোগ দেন শন পোলক (৩০০ উইকেট নিয়ে)। দুই বছর পর পোলকের সতীর্থ জ্যাক ক্যালিস উইকেট প্রাপ্তিতে (সাথে আট হাজার রান নিয়ে) আর শেন ওয়ার্ন রান প্রাপ্তিতে (সাথে সাতশ-প্রায় উইকেট) এই ডাবল পূরণ করেন। এর দুই বছর পর, ২০০৮ সালে আরো তিনজন যোগ দেন এ তালিকায়- অ্যান্ড্রিউ ফ্লিনটফ, ড্যানিয়েল ভেট্টরি এবং চামিন্দা ভাস। 

    আবারও প্রায় দশ বছর এ তালিকায় কেউ ঢুকতে পারেননি, ২০১৮ সালে সেই খরা পূরণ করেছেন দুইজন- স্টুয়ার্ট ব্রড এবং সাকিব আল হাসান। 

    যোগফল

    কিছু অর্জনের মাহাত্ম্য থাকে তার সংখ্যার ভার ও ব্যাপ্তিতে (কোয়ান্টিটিভ), আবার কিছু অর্জন সংখ্যাতে দেখা না গেলেও মাত্রাগুণ অথবা তার বিশেষ-চরিত্রের জন্যও হয়ে ওঠে বিশাল । এই তালিকাতেই যেমন ক্রিকেটের বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য অলরাউন্ডারের নাম আসেনি প্রয়োজনীয় সংখ্যক রান বা উইকেটের অভাবে, হয়তো তার জন্য যে পরিমাণ ম্যাচ দরকার তারা তা পাননি। তবে তালিকাতে যারা আছেন, তাদের সবাই কম বেশি সংখ্যা আর মাত্রার দুটি দিকই লম্বা সময় ধরে নিশ্চিত করেই এসেছেন। 

    প্রথম অংশে সংখ্যার দিকে তাকানো যাক।

    ১.১

    পর্যাপ্ত ম্যাচ সংখ্যা বড় অর্জনের প্রথম শর্ত। আবার ফিটনেস, পারফরম্যান্স মিলিয়ে এ সংখ্যা বড় যোগ্যতার মাপকাঠিও। ‘অলরাউন্ড-জব’-এ দ্বিমুখী ভূমিকা রেখে এই কাজ করাটা আরও চ্যালেঞ্জিং। সে হিসেবে জ্যাক ক্যালিস বেশ এগিয়েই আছেন (১৬৬ ম্যাচ)। তারই সমসাময়িক শেন ওয়ার্ন আছেন এর পরপরই (১৪৫)। আশির দশক বিবেচনায় কপিল দেবের ১৩১ ম্যাচও বেশ উল্লেখযোগ্য অর্জন। সঙ্গে মিডিয়াম পেস বোলিং ও প্রধান বোলার হিসেবে ‘ওয়ার্কলোড’-ও বিবেচ্য তার ক্ষেত্রে। সমকালীন স্টুয়ার্ট ব্রডও ১২৪ ম্যাচ খেলে ফেলেছেন। ১০০-এর বেশি ম্যাচ খেলা অন্যান্যরা হচ্ছেন ভাস, ভেট্টরি, পোলক ও বোথাম। সাকিবের ম্যাচ অভিজ্ঞতা এ তালিকায় এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কম (৫৪)। 

     

     

    এই ডাবল-মাইলফলক অর্জনে সাকিবের ৫৪ ম্যাচের বিপরীতে বোথাম নিয়েছিলেন প্রায় সমানসংখ্যক ম্যাচ ৫৫টি ম্যাচ (বোথাম ৫৪-তম ম্যাচে মাত্র চার রান দূরে ছিলেন)। কেয়ার্নসের লেগেছিল ৫৮ ম্যাচ, আর ফ্লিনটফের ৬৯ ম্যাচ। ইমরান (৭৫-তম) আর কপিলের (৭৩-তম) প্রায় সমান ম্যাচে এই অর্জন, হ্যাডলি নিয়েছেন ৮৩তম ম্যাচে। শন পোলক আর সোবার্সের লেগেছিল ৮৭ ম্যাচ।

    ১.২

    এই তালিকায় সোবার্স আর ক্যালিস মূলত ব্যাটিং-প্রধান অলরাউন্ডার ছিলেন। ব্যাটসম্যানশিপ সংক্রান্ত ব্যাপারগুলোতে (ক্যারিয়ার রান, সেঞ্চুরি সংখ্যা, সর্বোচ্চ রান ইত্যাদিতে) তাই তাদের দাপট। অন্যদিকে শেন ওয়ার্ন ও চামিন্দা ভাস ছিলেন মূলত বোলার, লম্বা সময়ের ক্যারিয়ারে তাদের ব্যাটিং-পরিসংখ্যানও একটা সুশ্রী রূপ পেয়েছিল। আবার, ভেট্টোরি ও ব্রডের রূপান্তর যেন একে অন্যের বিপরীত- বোলারের ভূমিকা থেকে অলরাউন্ডারের ভূমিকায়। বোলিং-সংক্রান্ত পরিসংখ্যানে তাই শেন ওয়ার্ন অনেক এগিয়ে থাকেন। আশির দশকের বিখ্যাত চতুষ্টয়ের মধ্যে হ্যাডলির পরিসংখ্যানও বোলিং-প্রধান। অন্যদিকে কপিল দেবের লম্বা ক্যারিয়ারে বোলিং পরিসংখ্যান যেমন বোলিং-প্রধান ক্রিকেটারদের সঙ্গে পাল্লা দেয়, রানের হিসেবও বেশ ভারসাম্যপূর্ণ।

     

    অন্য দুইজন বোথাম ও ইমরানের ক্যারিয়ার-অর্জন নিখাদ অলরাউন্ড, দ্বিতীয় পর্বে আমরা দেখবো সময়ের সঙ্গে এই দুইয়ের ব্যাটিং ও বোলিংয়ের ভারসাম্য কিভাবে এগিয়েছে। তবে বোথাম অন্য সবার চেয়ে এগিয়ে আছেন সেঞ্চুরি আর ক্যাচিং-এর অসাধারণ প্যাকেজে। ক্যাচ নেওয়াতে ক্যালিস রানের (তেরো হাজার) মতই অদ্বিতীয়, এখানেও তার ডাবল। তার মতই স্লিপ-পজিশনে বাকী প্রতিদ্বন্দ্বী ওয়ার্ন এবং সোবার্স যথাক্রমে দ্বিতীয় ও চতুর্থ। এই চারজনের সঙ্গে বাকিদের পার্থক্য উল্লেখযোগ্য। 

     

    স্বল্পতম ম্যাচ নিয়েও বেশ কয়েকটি ফিগারে সাকিবের উপস্থিতি অবশ্য লক্ষণীয়। ক্যারিয়ার-সর্বোচ্চতে সাকিব ব্যাটসম্যানদের কাতারেই আছেন, আবার ৫-উইকেট নেওয়ার দৌড়েও ভালই এগিয়েছেন। তবে সেঞ্চুরির সংখ্যায় তিনি পিছিয়ে, ফিল্ডার হিসেবে দলের অন্যতম সেরাদের একজন হয়েও ফিল্ডিং-পজিশনের কারণে ক্যাচসংখ্যাও বেশ কম। 

    ১.৩

    রাডার-গ্রাফটা (চিত্র-৬) বেশ মানানসই এই অলরাউন্ডারের আলোচনায়। একজন ক্রিকেটারের বহুমাত্রিকতাগুলো একই চিত্রে চলে আসে এভাবে। কার পারফরম্যান্স কত বেশি ভারসাম্যপূর্ণ অথবা নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে কতো বেশি ফোকাসড, তা বোঝা যায়। এর মধ্যে সাকিবের গ্রাফটি একটু মজার- সংখ্যায় মাঝামাঝি অবস্থান করলেও, বিভিন্ন মাপকাঠিতে যা বেশ সমতা রেখেই চলেছে – ‘অলরাউন্ড জব’-এর মতই “অল-‘রাউন্ড’” আকৃতি ধরেই!

     

     

    একজন অলরাউন্ডারের ক্যারিয়ারজুড়ে অলরাউন্ড-সত্ত্বা যাচাইয়ের সবচেয়ে মোক্ষম মাপকাঠি হচ্ছে তার ব্যাটিং বোলিং গড়ের তুলনা। এটা এককালীন কিছু না করে বরং সমষ্টিগত ও তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে। ওপরে উল্লেখিত রান, উইকেট, সর্বোচ্চ স্কোর, ৫-উইকেট এর তথ্যগুলোর মতই এই গড়ও সাক্ষ্য দেয় সোবার্স, ক্যালিসদের ব্যাটসম্যানশিপ আর ভাস, ওয়ার্ন, ব্রডদের বোলারশিপের। বিশেষ করে সোবার্স ও ক্যালিসের ক্ষেত্রে তাদের ৫০-এর বেশি ব্যাটিং গড় বোঝায়- শুধুমাত্র ব্যাটসম্যান হিসেবেও তারা অন্য উচ্চতায়। সাকিব এবং ইমরানের ব্যাটিং গড় চল্লিশ না ছাড়ালেও অন্য অলরাউন্ডারদের তুলনায় বেশ খানিকটা এগিয়েই। বোথামের সেঞ্চুরি সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ার পরও গড়ে ইমরানের চেয়ে তিনি পিছিয়ে, ব্যাটিং পজিশন ও অপরাজিত ইনিংসের ভূমিকাও থাকতে পারে অবশ্য এখানে। সে হিসেবে টপ-অর্ডারে নিয়মিত ব্যাটিং করেও এই গড় ধরে রাখাটা সাকিবের ক্ষেত্রে বেশ উল্লেখযোগ্য ব্যাপার।

    স্বাভাবিকভাবেই বোলিং গড়কে আবার দেখতে হবে উল্টোভাবে, গ্রাফটা যত ছোট থাকে তত ভাল। সে হিসেবে পুরোদস্তুর বোলার হয়েও ভাস আর ওয়ার্ন বেশ পিছিয়ে আছেন হ্যাডলির চেয়ে। হ্যাডলি এক্ষেত্রে শীর্ষ পারফরমার, ইমরান আর পোলকও বেশ কাছেই আছেন তার। সাকিবের বোলিং গড় একটু বেশিই এক্ষেত্রে, তবে ফ্লিনটফ, ভেট্টরির মত বোলারদের চেয়ে অবশ্য তা কম। 

    ১.৪

    ব্যাটিং ও বোলিং গড়ের পার্থক্যকে ধরা হয় অলরাউন্ডার হিসেবে একজন কেমন বহুমাত্রিক, সেটা বুঝার মাপকাঠি হিসেবে। এক্ষেত্রে তত্ত্বটা হচ্ছে, উইকেটপ্রতি কম রান খরচ আর ম্যাচপ্রতি বেশি রান করাটাই যোগ্যতার পরিচয়; ফলে ব্যাটিং গড় ও বোলিং গড়ের পার্থক্য যত বেশি, অলরাউন্ডারের যোগ্যতা বাড়বে ততই বেশি। ব্যাটিংয়ে ঈর্ষণীয় গড়ের কারণে সোবার্স আর ক্যালিসের জন্য এই কাজটা যেন তুলনামূলক সহজ হয়ে গেছে, ভদ্রস্থ বোলিং গড় নিয়ে তাদের এই স্কোরটি যথাক্রমে ২৩.৭৪ এবং ২২.৭১, অন্যদের চেয়ে যা প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি।

     

     

    ইমরান আছেন এই শীর্ষ-লাইন আর গড়-লাইনের মাঝামাঝি। ১৪.৮৮ পার্থক্য মূলত এসেছে বেশ ভাল বোলিং গড় ও ভাল ব্যাটিং গড়ের কারণে। সবচেয়ে ভাল বোলিং গড় নিয়েও হ্যাডলি চতুর্থ ভাগে (৪.৮৬), ব্যাটিং গড় ত্রিশের নিচে হওয়ায়। কপিলের ক্ষেত্রে এই স্কোর (১.৪) আরো দুর্বল, দুটো গড়ই মাঝামাঝিতে তার, আর পার্থক্যটাও কম। বোথাম (৫.১৪) আছেন হ্যাডলির একটু আগে, ব্যাটিংয়ের অর্জন বোলিংয়ে কমে যাওয়াতে। কেয়ার্নস (৪.১৩)-এর অবস্থাও তাই। 

     

     

    এক্ষেত্রে মাইনাস-স্কোর বোলার পরিচয়টিই তুলে ধরে, তাই ওয়ার্ন ও ভাসের লম্বা মাইনাস-স্কোর বেশ অনুমেয়ই। ব্রড অলরাউন্ডারের চেয়ে তার বোলার সত্তার দিকেই ঝুঁকেছেন বেশি, তালিকায় সবচেয়ে লম্বা মাইনাস স্কোরটি সেটাই জানান দেয়। তবে কিছুটা আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে প্রতিশ্রুতিশীল হয়েও ফ্লিনটফের এই স্কোরে মাইনাস স্কোরে এতো পেছনে পড়া, সঙ্গে ভেট্টরির বোলার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরুর পরেও বোলিং গড়ে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়াটা। 

    অন্যদিকে সাকিব বেশ ভাল ব্যাটিং (৩৯.২৩, দলে তৃতীয়-সর্বোচ্চ) আর ভদ্রস্থ বোলিং গড় এবং পোলক বেশ ভাল বোলিং গড় (২৩.১১) আর বেশ ভদ্রস্থ ব্যাটিং গড় (২৩.১১, পোলক ৩৯ ইনিংসে অপরাজিত ছিলেন) নিয়ে তৃতীয় ভাগে আছেন। তাদের স্কোরগুলো (৭.৭৭ এবং ৯.১৯ যথাক্রমে) তাদের অলরাউন্ড সামর্থ্যের পরিচায়ক। তবে সাকিবকে এক্ষেত্রে এগিয়ে রাখা যায়, পোলকের ব্যাটিং গড়ে তার ২৫ শতাংশ ইনিংসে অপরাজিত থাকার (বিপরীতে সাকিবের মাত্র ৬ শতাংশ) বিচার করলে। ক্যারিয়ার-গড় হিসেব করলেও সাকিব কিংবদন্তি অলরাউন্ডার হওয়ার দৌড়ে বেশ ভালভাবেই আছেন।


    *পরিসংখ্যান ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম টেস্ট পর্যন্ত 


    পর্ব-২ পড়ুন এখানে