• " />

     

    আড়ালেই থাকেন যে ‘সেরা’

    আড়ালেই থাকেন যে ‘সেরা’    

    ২৯৯ রানে তখন ট্রিপল সেঞ্চুরির কীর্তির সামনে দাঁড়িয়ে তিনি। বোলার মুত্তিয়া মুরালিধরন। তিনটা বল ডট গেল, একটু নার্ভাস কি হয়ে পড়লেন? হওয়াটাই স্বাভাবিক। ট্রিপল সেঞ্চুরি তিনি করলেন, মুত্তিয়া মুরালিধরনকে রিভার্স সুইপ করে! আসলেই কি ‘নার্ভাস’ ছিলেন ইউনুস!

     

    মাঠের বাইরে যা কিছুই ঘটুক, মাঠের ভিতরে ইউনুস খান এমনই। ‘আড়ালে’ থাকলেও যিনি আলো কেড়ে নেন প্রায়ই! অথবা যাঁর ওপরেই থাকা উচিৎ অনেক অনেক ‘আলো’! 

     

    সুইপ করতে ভালবাসেন বেশ, এশিয়ার আর সব সেরা ব্যাটসম্যানদের মতো ‘বটম হ্যান্ড’ শক্তিশালী অনেক। ইমরান খানের ভক্ত ইউনুস পেশোয়ার থেকে করাচিতে এসেছিলেন ছোট থাকতেই। জিমখানা ক্লাবে নজরে আসেন রশীদ লতিফ ও সাঈদ আনোয়ারের।

     

    টেস্ট অভিষেক হলো ২০০০ সালে, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে দ্বিতীয় ইনিংসে করলেন সেঞ্চুরি। ম্যাচ হারলো পাকিস্তান। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি,এমন নয়। চিরায়ত পাকিস্তানের নিয়ম মেনে বোর্ডের সাথে দ্বন্দ্ব কদিন পরপরই চরমে পৌঁছায়। নিষিদ্ধ করা হয়,আজীবন পর্যন্ত। ‘ডামি অধিনায়ক হব না’বলে আবার অধিনায়কত্ব নেন না। কিছুটা জোর করেই দায়িত্ব দেয়া হয়। শেষ পর্যন্ত যখন পাকাপাকিভাবে দায়িত্ব পেলেন, প্রথম টেস্টেই সেই ট্রিপল সেঞ্চুরি করলেন। সে টেস্টই হয়ে আছে পাকিস্তানের মাটিতে শেষ ‘পূর্ণাঙ্গ’ টেস্ট। পরের ম্যাচেই লাহোর আক্রমণের ঘটনা ঘটল, পাকিস্তান থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট নির্বাসনে গেল। তারপর ২০০৯ টি-২০ বিশ্বকপে পাকিস্তানকে ট্রফি এনে দিলেন, আরেকজন ‘খান’-এর নেতৃত্বে পাকিস্তান পেল আরেকটা আইসিসির বড় ট্রফির স্বাদ। সে ম্যাচেই ঘোষণা দিলেন, আন্তর্জাতিক টি-২০ থেকে অবসরের (পরে অবশ্য দল থেকে বাদ পড়ে ফিরে এসে সব ফরম্যাটেই খেলেছেন)।

     

    এরপর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে পাকিস্তান সেমিফাইনালে গেল। হাতের চোট নিয়ে খেলে একটা গুরুত্বপূর্ন ক্যাচ ফেলে দিলেন, পাকিস্তান হেরে বিদায় নিল। ‘ফিক্সিং’এর গুঞ্জন উঠলো, পিসিবি তাঁকে নেতৃত্ব থেকে বাদ দিল। তারপর ইউসুফের নেতৃত্বে জয়হীন অস্ট্রেলিয়া সফর শেষে তাঁর সঙ্গে আজীবন নিষিদ্ধ করা হলো ইউনুস খানকেও। ইউনুস খান নাকি ‘শৃংখলা’ ভঙ্গের অভিযোগে ‘অভিযুক্ত’! ইউসুফ নেই, ইউনুস নেই, আফ্রিদিকে দেয়া হলো নেতৃত্ব। এক টেস্ট খেলে টেস্ট থেকেই অবসর নিলেন আফ্রিদি! সালমান বাট হলেন অধিনায়ক, ইংল্যান্ডের সঙ্গে সিরিজে স্পট ফিক্সিংয়ের দায়ে নিষিদ্ধ হলেন মোহাম্মদ আসিফ ও মোহাম্মদ আমীরের সঙ্গে। টেলিগ্রাফ ‘অভিযোগ’ তুললো, জুয়াড়ি আজহার মাজিদের সঙ্গে নাকি যোগাযোগ ছিল ইউনুসেরও। ইউনুস তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে চাইলেন, টেলিগ্রাফ ‘ভুল’ স্বীকার করে নিল। ইউনুসের নাম নাকি চলে এসেছিল ‘ভুলক্রমে’।

     

    এরপর ফিরে এলেন ইউনুস। দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে চতুর্থ ইনিংসে ম্যাচ বাঁচানো সেঞ্চুরি করলেন। চতুর্থ ইনিংসে তাঁর রেকর্ডসংখ্যক ৫টি সেঞ্চুরী আছে, এখনও খেলছেন এমন খেলোয়াড়দের মধ্যে চতুর্থ ইনিংসে সবচেয়ে বেশী গড়ও তারই। বাকী তিন ইনিংসেও গড় ঈর্ষনীয়, প্রথম ইনিংসে ৫৪.৮৭, দ্বিতীয় ইনিংসে ৫৪.৮৪, তৃতীয় ইনিংসে ৪৮.৭০। একসময় ডন ব্র্যাডম্যান ও রবার্ট সাটক্লিফের পর ইতিহাসের একমাত্র ব্যাটসম্যান হিসেবে সব ইনিংসেই গড় ছিল ৫০ এর ওপরে।

     

    ফর্ম কিংবা ‘শৃংখলা’জনিত কারণে বাদ পড়ে ফিরে এসেছেন কয়েকবার, তবে সিরিজের মাঝখানে স্বজন হারিয়ে ফিরে যেতে হয়েছে তাঁকে, বেশ কয়েকবার।

     

    ২০০৫ এ অস্ট্রেলিয়া সফর থেকে ফিরে এসেছিলেন বাবার মৃত্যুতে। সেবছর ডিসেম্বরে ইংল্যান্ড থেকে ফিরতে হয়েছিল বড় ভাই শরীফের মৃত্যুতে। এই ভাইয়ের কাছেই ইউনুসের ক্রিকেটের হাতেখড়ি। পরের বছর আবার আঘাত পান ইউনুস, এবার মারা যান আরেক ভাই ফরমান। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে তখন ম্যাচ চলছে, ব্যাটিং শেষেই এ খবর পেয়েছিলেন। আবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ইউনুসের সবচেয়ে বড় ভাইয়ের মৃত্যু তাঁকে ফিরে আনে ২০১১ সালের সফরের মাঝপথ থেকেই। গত বছর ভাতিজার মৃত্যুতে ফিরে যান শ্রীলংকা সফর থেকে। এক ওয়ানডে খেলেই চলে গিয়েছিলেন, তারপর অস্ট্রেলিয়া সিরিজের ওয়ানডে দল থেকে বাদ দেয়া হয়েছিল তাঁকে। ইউনুস ‘অভিমান’ করে বলেছিলেন, তাঁকে যেন পাকিস্তানের আর কোন দলেই বিবেচনা করা না হয়। নির্বাচকেরা শোনেননি,ইউনুসও খেলছেন।

     

    অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে সে সিরিজে টানা তিন সেঞ্চুরি করেছিলেন, পাকিস্তানের হয়ে সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির রেকর্ডটা তখনই তাঁর হয়ে গিয়েছিল। আজ মঈন আলীকে ছয় মেরে জাভেদ মিঁয়াদাদকে টপকে হয়ে গেলেন পাকিস্তানের সর্বোচ্চ টেস্ট রানের মালিক।

     

    পরিসংখ্যান বলবে, পাকিস্তানের ইতিহাসের সেরা ব্যাটসম্যান তিনি। পরিসংখ্যানকে পাশ কাটিয়ে ‘সেরা’দের একজন হিসেবেই বিবেচনা করা হবে কি থিয়েরি হেনরির এই ভক্তকে (তাঁর সই করা জার্সি সংগ্রহে আছে ইউনুসের)! করা হোক বা না হোক, তাতে বোধহয় ইউনুসের তেমন কিছু যায় আসে না। অনেকবারই যে বলে এসেছেন, তাঁর কাছে ‘দলই প্রথম, দলই শেষ’। সে কারণেই হয়তো, ১৯৯ এ রানআউট হয়েও সঙ্গী ব্যাটসম্যানকে প্রতিক্রিয়া দেখান না, ২৯৯ রানে দাঁড়িয়ে রিভার্স সুইপ খেলেন। পরপর দুই ম্যাচে ডাক মেরে পরের ম্যাচে অফ দা মার্কে গিয়েই ব্যাট উঁচিয়ে ধরেন (সে ম্যাচ অবশ্য সেঞ্চুরিও করেছিলেন)। অতিরিক্ত ফিল্ডার হয়ে এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশী ক্যাচ ধরার রেকর্ড করেন, আবার তিনিই তাঁর দেশের হয়ে প্রথম ১০০ ক্যাচ নেন। আর সবাই যখন ‘আইসিএল’-র টাকার কাছে হার মানেন, তখন বলে বসেন, “আমি আমার দেশের সঙ্গে প্রতারণা করতে পারিনা।”

     

    হয়তো পাকিস্তানের হয়ে খেলবেন আরো অনেক দিন, কিংবা আবার বাদ পড়বেন 'অদ্ভুত' কোন কারনে। ফিরে আসবেন, সেঞ্চুরি করবেন, দলকে বাঁচাবেন পরাজয় থেকে। অথবা আউট হবেন শুন্য রানে। থাকবেন নীরবে, নিভৃতে। ইতিহাস বলবে, পাকিস্তানকে বড় দুটি ট্রফি জিতিয়েছিলেন দুইজন ‘খান’, একজন সব আলো কেড়ে নিতে পারতেন, আরেকজন থাকতেন আড়ালেই!

     

    তবে যাই ঘটুক, ইউনুসের কাছে সবার আগে থাকবে দল, থাকবে ক্রিকেট, থাকবে ব্যাটিং।

     

    মোহাম্মদ ইউনুস খান যে আর দশজনের থেকে একটু 'আলাদা'!

     

     


     

    আরো পড়ুনঃ ওয়াকারকে "আপদ" বলেছিলেন শেহজাদ!