• " />

     

    গোলাপী বলের দিবারাত্রির কাব্য

    গোলাপী বলের দিবারাত্রির কাব্য    

     

    অন্যলোকেও কি সূর্য ওঠে? অস্ত যায়? চাঁদটা কি বাড়ে কমে, পৃথিবীর মতো করে? যদি হয়, ২৭ নভেম্বর দিনটাতেও কি হবে এমন? ফিলিপ হিউজ কি দেখবেন, পৃথিবীর বুকে আঁধার নেমে আসার পরও ক্রিকেটের কীর্তন- অ্যাডিলেড ওভালের সবুজ চত্বরে! সেই অ্যাডিলেড ওভাল, যা ছিল তাঁর শেষ হোম ভেন্যু। সেই অ্যাডিলেড ওভাল, বছরখানেক আগে যেখানে দাঁড়িয়ে আকাশপানে ব্যাট তুলেছিলেন মাইকেল ক্লার্ক, ডেভিড ওয়ার্নার, স্টিভেন স্মিথরা! হিউজি হয়তো ওপর থেকে দেখেছিলেন, শেষবেলায় ‘৪০৮’ নম্বরাঙ্কিত লেখাটা ঘিরে অস্ট্রেলিয়ানদের উল্লাস! এ সব কিছুর উৎসই যে ছিলেন তিনি, আর ছিল সেই ২৭ নভেম্বর! এদিনই যে এইলোক ছেড়ে অন্যলোকে পাড়ি জমিয়েছিলেন ফিলিপ জোয়েল হিউজ। অস্ট্রেলিয়ার ‘৪০৮’ নম্বর টেস্ট ক্রিকেটার। ক্রিকেট বিশ্বকে একটা ধাক্কা দিয়েছিলেন, আবার অদ্ভূত এক একত্বের বন্ধনেও যেন জড়িয়েছিলেন!

     

    দেখতে দেখতে বছরটাই কেটে গেল। আরেকটি ২৭ নভেম্বর যখন দরজায় কড়া নাড়ছে, ক্রিকেটবিশ্ব প্রস্তুত হচ্ছে। অ্যাডিলেড ওভাল প্রস্তুত হচ্ছে। প্রস্তুত হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া। হ্যাঁ, হিউজিকে স্মরণ করা হবে অবশ্যই। তার প্রস্তুতিও আছে। আর আছে ইতিহাসে প্রবেশের প্রস্তুতি! এদিনই যে টেস্ট ক্রিকেট দেখবে নতুন এক দিগন্তরেখা। অথবা বিশ্ব দেখবে টেস্টের নতুন এক রূপ! ইতিহাস-দরজার কড়া নাড়তেই তাই এতো আয়োজন!

     

    ১৩৮ বছর আগে, এমসিজিতে অস্ট্রেলিয়া যখন ইংল্যান্ডের সঙ্গে ইতিহাসের প্রথম টেস্ট খেলতে নেমেছিল, তা ছিল ‘টাইমলেস’। ওভার ছিল চার বলের। এরপর ‘টাইমলেস’ টেস্টকে সময়ের লাগাম পড়ানো হয়েছে, ওভার আট বলের হয়েছে, নেমে এসেছে আবার ছয় বলে। ক্রিকেট-সংস্করণে এসেছে সীমিত ওভার, টি-টোয়েন্টি। সাদা বল, রঙ্গীন পোশাক, টেলিভিশন আম্পায়ার, ডিসিশন রিভিউ। ফ্লাড লাইটের কৃত্রিম আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছে ক্রিকেট!

     

    ২১৮৮ নম্বর টেস্টটি হবে ছয় বলের ওভারের, পাঁচদিনের। আর ১৩৮ বছরের মধ্যে প্রথমবার, লাল ছাড়া অন্য কোনো বলে খেলা হবে টেস্ট। হবে দিবা রাত্রির! ‘রেড-চেরি’ এর জায়গায় থাকবে ‘গোলাপী-মুক্তো’! নতুন ‘গোলাপী’ বলে কি সুইং থাকবে লাল বলের মতো? টেকসই কি হবে? স্পিনারদের জন্য কেমন হবে তা? প্রশ্ন অনেক। উত্তর খুঁজতে অপেক্ষা করতে হবে। অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ড ২০১৫ সালের ২৭ নভেম্বর নামবে সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে। 

     

    অ্যাডিলেডের পিচে ঘাস রাখা হয়েছে নিয়মিত-র চেয়ে একটু বেশী। গোলাপী বল দ্রুতই নরম হয়ে যায়, এ কথা মাথায় রেখে। ২০০৯ সালে এমসিসির সভায় যে প্রস্তাবনা রাখা হয়েছিল, ছয় বছর পর, প্রায় তিন বছরের প্রস্তুতিতে তা আলোর মুখ দেখছে। রোমাঞ্চিত অস্ট্রেলিয়া, রোমাঞ্চিত নিউজিল্যান্ড, রোমাঞ্চিত অ্যাডিলেড। টেস্ট ক্রিকেট কি রোমাঞ্চিত?

     

    শত বছরের ঐতিহ্য ভেঙ্গে নামতে হচ্ছে, বরং বলা ভাল, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে খোলনলচেটা বদলাতে হচ্ছে টেস্ট ক্রিকেটকে। দর্শক, টেলিভিশন ‘ভিউ’ মাথায় রেখে টেস্ট নামছে ভিন্ন আঙ্গিকে।

     

    প্রথম সেশনের পরের বিরতিটাই এতদিন ছিল সবচেয়ে বড়, এবার প্রথম বিরতিটা হবে ‘চা-বিরতি’, বিশ মিনিটের। দ্বিতীয় সেশনের পর হবে ‘ডিনার-ব্রেক’, চল্লিশ মিনিট। খেলা শুরু হবে স্থানীয় সময় দুপুর ২.৩০-টায়, শেষ হবে রাত ৯.৩০-টায়। অনেক পরিবর্তনে তাই হারিয়ে যাবে অনেক পুরোনোও। থাকবে না সেই আলো-আঁধারির শেষবেলার রোমাঞ্চ, থাকবে না সকালের মৃদু রোদ বা মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়ার সঙ্গে বলের সুইংয়ের সম্পর্কের কাঁটাছেড়া সেভাবে!

     

    তবুও ব্যাট আর বলের সেই চিরন্তন লড়াই থাকবে। তবুও পাঁচ উইকেট বা সেঞ্চুরি উদযাপিত হবে আগের মতো করেই! কাভার ড্রাইভের রোমাঞ্চ থাকবে তবুও। টেস্টই থাকবে ক্রিকেটের শিখর! তা হোক দিনের আলোয়, রাতের আঁধার-আকাশের নীচের কৃত্রিম আলোয়। 

     

    দিবা-রাত্রির টেস্টও হয়তো টিকবে। অথবা হারিয়ে যাবে কালের গহীনে। নিউজিল্যান্ড অবশ্য এরই মাঝে বাংলাদেশের সঙ্গে আগামী বছর দিবা-রাত্রির টেস্ট খেলার কথা ভাবছে। আবার দিবা-রাত্রির টেস্ট মানেই শত বছরের পুরোনো সেই টেস্ট ম্যাচ হারিয়ে যাওয়া নয়। যদি শেষ পর্যন্ত এটি না-ই টিকে, তাহলে না হয় গাওয়া হবে ঐতিহ্যেরই জয়গান আরেকবার!

     

    তবে আপাতত ‘নতুনের’ রোমাঞ্চে রোমাঞ্চিত হওয়াই যায়! কে জানে অন্যলোকেও হয়তো রোমাঞ্চিত হচ্ছেন ফিলিপ হিউজ। গোলাপী বলের রোমাঞ্চে!

    ভাল থাকুন ফিলিপ হিউজ।

    ভাল থাকুক টেস্ট ক্রিকেট!