• " />

     

    চোখের বালি যে ড্রকেও মনে রাখবে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াও!

    চোখের বালি যে ড্রকেও মনে রাখবে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াও!    

    প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াই করে যাবেন, কিন্ত বৃষ্টি? অ্যাশেজ দখলে নিতে যে টেস্টের ফলাফলে ইংল্যান্ডকে জয় লিখতেই হতো, সেই ম্যানচেষ্টার টেস্টে বৃষ্টি বড় আলোচনার বিষয় ছিল শুরুর আগে থেকেই। বৃষ্টির এই বাধা উতরাতে নিজেদের আগ্রাসী ক্রিকেটের গিয়ার আরেকটু উপরে তুলে নিতে আগ্রহী হবে কি না ইংল্যান্ড, সে প্রশ্নও এসেছিল স্টোকসের সামনে। বাজবল অধ্যায়ের সঙ্গে পরিচিতি থাকলে উত্তর অনুমান করা কষ্টের কিছু না। বেন স্টোকস বলেছিলেন, সেরকম কিছু করার প্রয়োজন পড়লে অবশ্যই করবেন, ফলাফলের জন্য যতটুকু দরকার সবটুকুই করবেন। 

    টেস্ট শেষে স্টোকস বলেছেন, যা করেছেন, এর চাইতে বেশি কিছু তাদের করার ছিল না। ব্যাটিং সহায়ক পিচে অস্ট্রেলিয়াকে ৩১৭ রানেই থামিয়ে ফেলা, এরপর ৫৯২ রান করা ৫.৪৯ রান রেটে, শেষে ৬৯ রানে এগিয়ে থেকে অজিদের ৫ উইকেট তুলে নেওয়া। তারপরও ড্র। স্টোকস হতাশ সে কারণে। হতাশ কামিন্সও, তবে ভিন্ন কারণে। 

    নিজের বোলিংয়ের ওপরই আসলে হতাশা ব্যক্ত করেছেন অজি অধিনায়ক। তিনের কম ইকোনমিতে পঞ্চাশের বেশি টেস্ট পার করে দেওয়া প্যাট কামিন্স ওভারপ্র‍তি রান খরচ করে যাচ্ছিলেন পাঁচের বেশি করে। উইকেট নিতে না পারার হতাশা তো ছিলই, রান আটকাতে না পারার হতাশাও কম ছিল কীসে! 

    ক্রলি যখন ব্যাটিংয়ে, অস্ট্রেলিয়ানরা যেন কোন উপায়ই খুঁজে পাচ্ছিলো না তাকে থামানোর। ক্রলির বরাবরই শট খেলতে পছন্দ। ড্রাইভ-করার-মতো-লেংথ হলেই তো ক্রলি বাউন্ডারি বের করেছেন দাপটের সহিত। অস্ট্রেলিয়া বাউন্ডারি বাঁচানোর চেষ্টায় আউটফিল্ডে ফিল্ডার ছড়িয়েছে। কিন্ত যখন স্টাম্প ও আউটসাইড অফ লাইনে বল করেছে, ক্রলি দুর্দান্তভাবে লেগ সাইডে সিঙ্গেল বের করে গেছেন। ডিপ পয়েন্টের সুবাদে অফ সাইডেও সিঙ্গেল পেয়েছেন হরহামেশা। হেডের পার্টটাইম স্পিনে শুরুতেই চড়াও হয়ে ৬ ওভারে ৪৮ রান এনেছিলেন৷ সে কারণে হেডকেও বেশিক্ষণ বোলিংয়ে রাখতে পারেননি কামিন্স। পেসাররা এসে বাউন্সার আক্রমণে তাকে থামানোর চেষ্টা করেছেন। তাতেও ক্রলি আত্মবিশ্বাসের সাথেই খেলে গেছেন।

    রুটও সেভাবেই ভুগিয়েছেন আসলে। রুট এই সিরিজেই কয়েকবার বাউন্সারে বিপদ ডেকে এনেছিলেন। এই টেস্টে তাকে অজিরা স্বাগত জানায় শর্ট বল দিয়েই। রুটও জবাব নিয়ে প্রস্তত, ইনিংসের শুরু পুলে চার দিয়ে। অজিদের বাউন্সার আক্রমণ রুটের কাছে পরাস্তই ঠেকেছে। আগ্রাসী মননে নামা রুট আর ক্রলি ভীষণ মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন অজিদের জন্য। কিছুক্ষণ পরপরই কামিন্স ফিল্ডসেটে পরিবর্তন, পরিকল্পনায় বদল আনছিলেন, কিছুই কাজে আসছিলো না। 

    দ্বিতীয় দিনে তো এক সেশনেই ইংল্যান্ড এনে ফেলেছিল ২৫ ওভারে ১৭৮ রান! অস্ট্রেলিয়া শুধু উইকেট নেওয়ার নেশায় রানের সুযোগ করে দিয়েছে, এমন না, রান বাঁচানোর চেষ্টার বিরুদ্ধে খেলেই এসেছে সে বিশাল রান। পুরো দিনটাই সব মিলিয়ে অজিদের জন্য হতাশায় মোড়ানো ছিল। এক দিনে ইংল্যান্ডের ৩৮৪ রান তুলে ফেলা চার উইকেটে, অস্ট্রেলিয়ার কোন দলকে এভাবে এত চাপের মধ্যে থাকতে কখনো কী দেখেছে ক্রিকেট বিশ্ব? 

    মাইকেল আথারটনের খেলা, আর খেলা দেখা-বলা৷ অস্ট্রেলিয়াকে কম দেখা হয়নি তার। আথারটন বলেছেন, কখনোই এতটা চাপে অস্ট্রেলিয়াকে দেখেননি। রিকি পন্টিংও নির্দিষ্ট করে এই দল নিয়ে বলেছিলেন যে এত চাপে কামিন্সের দলটা কখনোই পড়েনি। অধিনায়কত্ব অধ্যায়ে কামিন্স সুসময়ই আসলে পার করেছেন বেশি, এমন দুর্দশাময় দিনের সঙ্গে পরিচিতি সেদিনই ঘটেছে।

    পরদিনও থামেনি সেই দুর্দশা। যদিও চতুর্থ দিনে স্টোকস-ব্রুকদের লাগামছাড়া হতে দেননি অজি পেসাররা, তবে শেষে বেইরস্টো এসে ঠিকই তছনছ করে দিয়েছেন। জবাবহীন অস্ট্রেলিয়া যেন 'বাজবলের স্বাদ' পেয়েছিল। এই ইংল্যান্ড এমন কিছু করেছে এর আগেও, নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে, পাকিস্তানে গিয়ে, নিউজিল্যান্ডের মাটিতে। এই সিরিজেও দ্রুত রান তুলেছে ইংল্যান্ড, এজবাস্টনে চার শর কাছাকাছি মানের বড় স্কোরও গড়েছিল, কিন্ত সবসময়ই আসলে তারা এগিয়ে ছিল না খুব একটা, উইকেট নিয়ে ঠিকই লাগাম টেনে ধরেছিল অজিরা। কিন্ত ম্যানচেষ্টারে প্রথম ইনিংসে কামিন্সের মতে 'কিছু রান ফেলে আসা'র পর ৫৯২ রান দিয়ে ফেলা অস্ট্রেলিয়ার উপর দাপটেই বসে ছিল ইংল্যান্ড। পুরো সিরিজেই যেখানে বড় একটা সময় কোন দল এগিয়ে থাকেনি, সবসময় দুই পক্ষের দিকেই খেলা ছিল, সেখানে ইংল্যান্ডের এমন দাপট!

    কামিন্স, হেজলউড, স্টার্ক- দুর্দান্ত এই পেসত্রয়ীর বোলিং থেকেই তো রান এসেছে ৩৯২। এমন কিছুর অভিজ্ঞতা কী তাদের হয়েছে কখনো? হেজলউড বলেছেন, 'ভারতের বিপক্ষে কয়েকবার ফ্ল্যাট উইকেটে এরকম কিছুর সম্মুখীন হতে হয়েছে। এমন কিছু নতুন না আসলে, তবে এই রান রেটে অবশ্যই না।' উইকেট নিতে পারছেন না, সেরকম পরিস্থিতি প্রায়শই আসে টেস্ট ক্রিকেটে। কিন্ত রানও আটকাতে পারছেন না, তা আপনার চরম দুর্দিনেই কেবল আসতে পারে!

    প্রথম দুই ইনিংস শেষে ২৭৫ রানে পিছিয়ে থাকার পরও, শেষ দুই দিনে বৃষ্টিতে মাত্র ৩০ ওভার খেলা সক্ষম হওয়ায়, অস্ট্রেলিয়া পেয়েছে ড্র। ইংল্যান্ড অ্যাশেজের লড়াইয়ে টিকে থাকতে সে ফল চাইতো না নিশ্চয়ই, স্টোকসও বলেছেন তা হজম করা কঠিনই। এই ইংল্যান্ডের ফলাফলের খাতায় তো ড্রয়ের জায়গা বলতে গেলে শূন্য। সবসময়ই জয় অথবা হারের মন্ত্র জপে আসা 'বাজবল ইংল্যান্ড' ১৭তম টেস্টে এসেই প্রথম ড্রয়ের দেখা পেয়েছে। 

    ব্যাটে-বলের সমান লড়াই না হলেই যেহেতু ড্রয়ের সম্ভাবনা থাকে, ড্র সাধারণত বিরক্তিকরই হয় তাই। কতটি ড্র ম্যাচ আপনি মনে করতে পারেন, ভেবে দেখুন তো! এই ড্র যদিও অন্য সবের মতো নয়, স্মরণীয় হয়েই থাকবে। ইংল্যান্ডের দাপটের কারণে তো অবশ্যই৷ এই টেস্টে সাদা পোষাকের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া যে দেখা পেয়েছিল 'কখনোই এতটা চাপে না থাকার দিন’ও!