• " />

     

    বাউন্সারে বিরক্তি, বাউন্সারে বিনোদন

    বাউন্সারে বিরক্তি, বাউন্সারে বিনোদন    

    ব্যাটারদের গ্লাভসে, হেলমেটে, শরীরে- অ্যাশেজের দ্বিতীয় টেস্টে কতবার বল আঘাত করেছে, অনুমান করতে পারেন? পুরো ম্যাচ অনুসরণ করে থাকলেও সংখ্যাটা আপনাকে চমকেই দিতে পারে। ৬২ বার! 

    এই তথ্যও যদি আপনাকে চমকে দিতে যথাযথ কারণ না হয়, তাহলে জেনে রাখুন, ক্রিকভিজের তথ্যানুসারে ২০০৬ সাল থেকে আর কোন ম্যাচেই ব্যাটারের গ্লাভস, হেলমেট, শরীরে পেসারদের এত বল আঘাত হানেনি। সংখ্যাটা পঞ্চাশের বেশিই তো হয়েছে আর মাত্র এক ম্যাচে! ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যকার এক টেস্টে সংখ্যাটা ছিল ৫১।

    লর্ডস টেস্টে এত বেশি আঘাতকৃত বলের দেখা মিলল, ধরতেই পারছেন অধিকাংশই বাউন্সারের দরুণ। লর্ডসে তো আসলে বাউন্সারের বন্যাই হয়েছে! পুরো টেস্ট যদি আপনি দেখে থাকেন, তাহলে ম্যাচের প্রায় এক চতুর্থাংশ সময়েই আপনাকে শুধু বাউন্সারই দেখতে হয়েছে। খেলা হয়েছে মোট ৩৬০ ওভার ২ বল, সেখানে শর্ট বল হয়েছে ৮৪ ওভার। অর্থাৎ মোট ওভারের ২৩.৩২ শতাংশই ছিল শর্ট বল। 

    লর্ডসের ময়দানে দর্শকেরা একের পর এক বাউন্সার দেখেই গেছেন শুধু। কথাটা আক্ষরিক অর্থেই বলা। চতুর্থ দিনের দ্বিতীয় সেশনে ইংল্যান্ডের বোলিংয়ের যে পিচম্যাপ দেখিয়েছিল, সেখানে শর্ট লেংথে ফেলা বলের পার্সেন্টেজ ছিল ৯৮। তার মানে ওই সেশনে প্রত্যেক ১০০ বলে আপনাকে দেখতে হচ্ছিল ৯৮টি শর্ট বল! 

    ইএসপিএনক্রিকইনফো বলছে, দুদলের পেসাররা মিলে পুরো টেস্টে শর্ট লেংথে বল করেছে ৫০৪টি। ২০১৫ সাল থেকে হওয়া সব টেস্টের মধ্যে আর কোন টেস্টেই এত বেশি শর্ট বল করেনি পেসাররা। এর আগে যে ম্যাচে সবচেয়ে বেশি শর্ট বলের দেখা মিলেছে, সেটিতেও আছে বাংলাদেশ। ২০১৭ সালে ওয়েলিংটনে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সে টেস্টে অবশ্য সবমিলিয়ে শর্ট বল ৪২৬টির বেশি হয়নি।  

    একের পর এক বাউন্সার, দেখতে কেমন লাগে? হঠাৎ করে একটা বাউন্সার করলেন বোলার, সেই বাউন্সার তখন যেন সঙ্গে করে নিয়ে আসে উত্তেজনা। উত্তেজনা বাড়িয়ে দেওয়ারই এক রসদ এই বাউন্সার। আর সেটা যদি হয় অ্যাশেজের মঞ্চে! কিন্ত এত বাউন্সার কী বিরক্তিরও কারণ হয়ে উঠে না? 

    টেস্ট ক্রিকেটের সৌন্দর্য ব্যাটারকে ঘিরে ধরা ফিল্ডসেট। ফিল্ডারদের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বাউন্ডারিতে রেখে একের পর এক বাউন্সার করে যাওয়া, সমর্থক না হলে দেখতে খুব কী আনন্দদায়ক? দুই দলই কিন্ত সে কৌশলেই মন দিয়েছিল। ইংল্যান্ড করেছে ৩০২ শর্ট বল, আর অস্ট্রেলিয়া সে লেংথে বল ফেলেছে ২০২টি।

    একেবারে বড়সড় দুর্বলতা কোন ব্যাটারের না থাকলে, সাধারণত বাউন্সার আক্রমণের প্রথম পথ হয় না। শেষের দিকের যেসব উপায়, তার মধ্যেই বাউন্সারকে ফেলা হয়। প্যাট কামিন্সের কথায়ও বুঝা গেল তাদের বাউন্সারের পথ বেছে নেওয়ার কারণ ছিল সেটিই। পিচে একেবারে সামান্য সময় ছাড়া সবসময়ই আসলে পেসাররা কোনও সহায়তা পাননি। ফ্ল্যাট পিচই প্রধান কারণ শর্ট বলের কৌশলে যাওয়ার, কামিন্স বলেছিলেন। 

    বাউন্সারের বন্যা নিয়ে ম্যাচ শেষে ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক অ্যান্ড্রু স্ট্রাউস বলেছিলেন, 'আমি  এসব দেখতে পছন্দ করি না। আসলে এটাকে কিছুটা ক্লান্তিকর মনে হয়। একটু অনুমানযোগ্য। বোলার বল ছাড়ার আগেই আপনি জানেন কোথায় বল পড়বে। আপনি শুধু দেখছেন ব্যাটসম্যান কী করে। এটা কিছুটা দ্বি-মাত্রিক আমার কাছে। তার মানে এটা নয় যে তা কার্যকরী নয়। তাদের মনোভাবে কোন দোষ দেখছি না, যা কার্যকরী, সে পথে আপনি যেতেই পারেন।' 

    মাইকেল হোল্ডিংয়ের কথায়ও উঠে এসেছে বিরক্তির কথা। সাবেক এই ক্যারিবিয়ান পেস কিংবদন্তি বলেন, 'এটা কাজে আসে, তবে কিছুটা বিরক্তিকরও হতে পারে। তারা মূলত যা করছে, তা হচ্ছে একটা টেস্ট ম্যাচ জেতার পথ বের করে নেওয়ার চেষ্টা।' বাউন্সারের বেড়াজাল বিরক্তির কারণ যেমন হয়ে গিয়েছিল একটা সময়, তেমনই বাউন্সারেই বিনোদন মিলেছে স্টোকসের ব্যাটে। দুর্দান্ত ম্যাচটিকে তাইতো দুর্দান্তভাবে দুই শব্দে এউইন মরগান ব্যাখা করতে পেরেছিলেন, খাঁটি বিনোদন বলে! 

    প্রথম ইনিংসে শর্ট বল অস্বস্তিতে ফেলেছিল বেন স্টোকসকে, কয়েকবার শরীরেও আঘাত হেনেছিল বাউন্সার। ইংল্যান্ডের বাকি ব্যাটাররা বাউন্সার আক্রমণের উত্তর আক্রমণেই দিতে চেয়েছেন, স্টোকস হেটেছিলেন উল্টো পথে। দ্বিতীয় ইনিংসেও সেভাবেই খেলে যাচ্ছিলেন, বাউন্সার এলে ছেড়ে দেওয়াতেই মন ছিল। 

    কিন্ত বেইরস্টো আউট হয়ে যাওয়ার পর, চার টেলএন্ডার যখন বাকি, স্টোকস বাউন্সারে বিনোদন পর্বের শুরু করলেন। তখনও একের পর এক বাউন্সারের পথে হেটেছে অস্ট্রেলিয়া, বাউন্ডারি মিছিলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফিল্ডাররা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেছেন। একটা সময় তো নয় ফিল্ডারই ছিলেন বাউন্ডারি বাঁচানোর কাজে ব্যস্ত। পঞ্চম দিনে লাঞ্চের পর থেকেই হাতে গোনা কয়েক বল ছাড়া সবসময়ই স্টোকসের বেলায় সব ফিল্ডারই অস্ট্রেলিয়া রেখেছিল বাউন্ডারিতে।

    ১৫৫ রানের ইনিংসে ১১৮ রানই স্টোকস করেছেন লেগ সাইডে, বেশিরভাগই এসেছে ওইসব শর্ট বলে। স্টোকসের ৯টি চারের মধ্যে ছয়টিই তো এসেছে শর্ট বলে। ৯টি ছয়ের মধ্যেও পাঁচটিই এসেছে অজিদের শর্ট লেংথের বলে। শর্ট বলে উপযুক্ত শট পুল, আর স্টোকসের প্রায় ৪৫ শতাংশ রানই পুল শট থেকে এসেছে। ১৫৫ রানে পুলে ৬৯ রান, এটিই আসলে বলে দেয় শর্ট বলে কতটা বিনোদন পেয়েছে ইংলিশ দর্শকেরা।

    ব্যাপারটা যেন এমন হয়ে গিয়েছিল, অস্ট্রেলিয়ার বোলাররা আসবেন, শর্ট লেংথে বল ফেলবেন, স্টোকস ব্যাট চালাবেন, লেগ সাইডে আপনি শুধু খুঁজবেন বল গ্যাপ খুঁজে পেল কিনা। একটা সময় যে স্টোকস ছিলেন ১২৯ বলে ৬৪ রানে, সেই স্টোকস এরপর মুহূর্তেই যেন পৌঁছে গেলেন সেঞ্চুরিতে, মুহূর্তেই যেন ইংল্যান্ডের চোখেও জয় ভেসে উঠেছিল।

    লাঞ্চের আগে আগে যে তুফানই উঠেছিল লর্ডসে। সেই ১২৯ বলে ৬৪ রানে থাকা স্টোকস লাঞ্চের আগের শেষ ১৮ বলে করেন ৪৪ রান। লাঞ্চের পর অজিরা সে ঝড় থামাতে সক্ষম হয়, তবে সব ফিল্ডার বাউন্ডারিতে থাকলেও স্টোকস ঠিকই বাউন্ডারি খুঁজে নিয়েছেন মাঝেমধ্যে, একটা সময় তাই ১৪৭ রানে পৌঁছে যান ১৮৪ বলেই। শেষমেশ ৭০ রানের প্রয়োজনে দলকে রেখে স্টোকসের বিদায় হয়েছে যে বলে, সেটিও ওই শর্ট লেংথে করা বলই। 

    স্টোকসই কেবল আউট হননি এই শর্ট বলে। প্রত্যেক ইনিংসেই কেউ না কেউ শর্ট বলের শিকার বনেছেন। প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ার ন্যাথান লায়নই একমাত্র। পরের ইনিংসে ইংলিশ পাঁচ ব্যাটার। তৃতীয় ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ার ছয়জন, শেষ ইনিংসে ইংল্যান্ডেরও ছয়জন। সবমিলিয়ে ৪০ উইকেটের ১৮টিই পড়েছে শর্ট বলে। ক্রিকইনফোর তথ্যমতে, শেষ আট বছরে যা যৌথভাবে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০১৫ সালে নিউজিল্যান্ড ও শ্রীলংকার এক টেস্টে ১৮টি উইকেট পড়েছিল শর্ট বলে। 

    লর্ডস টেস্টে শর্ট বলে দুদলেরই সফলতা মিলেছে তা ঠিক। বাউন্সারের মিছিল বিরক্তিরও কারণ হয়ে গিয়েছিল বটে। কিন্ত বেন স্টোকস নামের একজন যে আছেন, যিনি বিনোদন দিতে জানেন। বিরক্তির বাউন্সারেও, খাঁটি বিনোদন।