• " />

     

    ক্যারির বকেয়া-হেয়ারকাট, রবিনসন হু?, স্টাম্পিং-গেট, আউট-নট আউট: বিতর্কে জমজমাট অ্যাশেজ

    ক্যারির বকেয়া-হেয়ারকাট, রবিনসন হু?, স্টাম্পিং-গেট, আউট-নট আউট: বিতর্কে জমজমাট অ্যাশেজ    

    মাঠের খেলা নিয়ে তো উত্তেজনা থাকেই। অ্যাশেজের বেলায় মাঠের বাইরের বিষয়াদিও কম রোমাঞ্চকর নয়। দুই দেশের প্রতিদ্বন্দ্বিতা এমনই, মাঝেমধ্যে সীমা ছাড়িয়েই গেছেন দর্শকেরা। মাঠের খেলায় কিছু সিদ্ধান্তও কম আলোচনার জন্ম দেয়নি। সবমিলিয়ে এবারে মাঠ ও মাঠের বাইরের নানা ঘটনা ঘটেছে, যা আরও নাটকীয় করে তুলেছে এই অ্যাশেজকে। 

    ক্যারির হেয়ারকাট-বকেয়া

    হেডিংলিতে তৃতীয় টেস্টের আগে দ্য সান একটা খবর প্রকাশ করে। আগের টেস্টেই স্টাম্পিং কান্ডের পর যা আগুনে আরও ঘি ঢালে। খবরটার মূলে যে ছিলেন অ্যালেক্স ক্যারি। কয়েকজন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার এক সেলুনে গিয়ে চুল কেটেছিলেন। যাদের মধ্যে থাকা অ্যালেক্স ক্যারি চুল কেটে টাকা না দিয়েই চলে গিয়েছিলেন। ক্যাশ পেমেন্টই শুধু ছিল ওই সেলুনে, আর ক্যারির কাছে ক্যাশ ছিল না। পরে তিনি ব্যাংক ট্রান্সফারের মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করবেন, এমনটা নাকি বলে যান। ওই সেলুনের অ্যাডাম মাহমুদ নামের ব্যাক্তি এই গল্পই শোনান দ্য সানে। 

    খবরটা আরও ফলাও হয়ে ছড়াতে থাকে যখন স্যার এলিস্টার কুক সেটি রেডিও কমেন্ট্রিতে বলেন। টেস্টের প্রথম দিনে বিবিসিতে কুক শোনান সে গল্পের তার সংস্করণ। ওই সেলুনের নিয়মিত কাস্টমার কুক। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারদের চুল কাটার দিনে পরে তিনিও গিয়েছিলেন চুল কাটতে৷ সেখানে গিয়েই কথাবার্তার এক সময়ে অ্যাডাম মাহমুদ গল্প করেন, অস্ট্রেলিয়ান কয়েকজন ক্রিকেটার এসেছিল তার এখানে। ক্রিকেটের ভালো করে খোঁজখবর না রাখা অ্যাডামের বর্ণনায় যা বুঝতে পেরেছিলেন, তাতে মার্নাস লাবুশেন, উসমান খাওয়াজাদের নাম বলেন কুক। আর আরেকজন নাকি ছিলেন, যাকে ঠিক চিনতে পারেননি অ্যাডাম। অ্যালেক্স নাম শুধু বলেছিলেন, পরে কুক জানান অ্যালেক্স ক্যারি অস্ট্রেলিয়ার উইকেটকিপারের কথা। অ্যাডাম বলেন, সে এখনো টাকা পরিশোধ করেনি! কুক সে গল্প বর্ণনা শেষে বলেন, 'এটা সত্যি গল্প, আমি বানিয়ে বলছি না। তবে এখন হয়তো সে পাওনা মিটিয়ে দিয়েছে।'

    এরপর অস্ট্রেলিয়া ম্যানেজমেন্টের পক্ষ থেকে ঘোলা জল পরিস্কার করা হয় পুরোপুরি। জানানো হয়, অ্যালেক্স ক্যারি সেই জুনের পর আর চুলই কাটেননি। কমেন্ট্রিতে এসে এরপর কুকও ক্ষমা চেয়ে বলেছেন, 'ভুল পরিচয়ের ঘটনা ঘটে গেছে।' শেষমেশ ওই সেলুনের ব্যাক্তি তার টাকা ঠিকই পেয়েছিলেন। অন্য কোন ক্রিকেটারের সাথে অ্যালেক্স ক্যারিকে মিলিয়ে ফেলেছিলেন। তবে আর যাই হোক, তখন ইংলিশদের দুচোখের বিষ বনে যাওয়া ক্যারি বলেই খবরটা আরও চটকদার হয়ে গিয়েছিল!

    স্টাম্পিং-গেট

    বেইরস্টো-ক্যারির সেই স্টাম্পিংয়ের ঘটনা তো এতটাই ডালপালা মেলেছে, আবার মনে করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজনই নেই। ঘটনা ঘটে দ্বিতীয় টেস্টে ৩৭১ রানের লক্ষ্যে ৫ উইকেট হারিয়ে ১৭৮ রানের দূরত্বে যখন ইংল্যান্ড ব্যাটিং করছে। ৫২তম ওভারের শেষ বলে ক্যামেরন গ্রিনের বাউন্সার ছেড়ে দিয়েই বেইরস্টো ক্রিজ ছেড়ে চলে যান। পেছনে তাকিয়ে পরে স্টাম্প ভাঙ্গা দেখে হতভম্বই হতে হয় বেইরস্টোকে। হাতে নেওয়ার পরপরই আসলে ক্যারি বল ছুড়ে মেরেছিলেন। তখনই তাই বল ডেড হয়ে গেছে বলার সুযোগ ছিল না। স্টোকস পরে জানিয়েছেন, আম্পায়ারদের সঙ্গে কথা বলে তিনি এটাই শুধু জানতে চেয়েছেন, বলটা যেহেতু ওভারের শেষ বল ছিল, ডেড কী ততক্ষণে হয়ে গিয়েছিল। আম্পায়ারদের মনে হয়নি তা, বেইরস্টো আউট তো হলেন, আগুনের হল্কা ছড়িয়ে যেতে লাগল ইংল্যান্ডের চারিদিকে! লর্ডস সমস্বরে আওয়াজ তুলে, 'সেম ওল্ড অজিস, অলওয়েজ চিটিং'!

    স্টোকস পরে সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, 'এভাবে কী আমি জিততে চাইতাম? না'। সুযোগ পেলে কী এভাবে স্টাম্পিং করবেন, তাতেও না-ই বলেছিলেন ইংল্যান্ড অধিনায়ক। ক্যারি অবশ্য বলেছিলেন সুযোগ পেলে আবারও এভাবে স্টাম্পিং করবেন। অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক কামিন্স নিয়মের ভিতরেই তা ছিল বলে তাতে দোষের কিছু দেখেননি। নিয়ম নিয়ে পরে বিস্তারিত ব্যাখাও দিয়েছিলেন আইসিসির এলিট প্যানেলের সাবেক আম্পায়ার সাইমন টফেল। বেইরস্টোর ভুলই আসলে দেখছিলেন ইংল্যান্ডের সাবেক ক্রিকেটাররাও। নাসের হুসেইন, এন্ড্রু স্ট্রাউস, মাইক আথারটনদের একই মত ছিল। তবে ইংলিশ সমর্থকদের চোখে অ্যালেক্স ক্যারি বনে গেছেন, 'চিটার'!

    সমর্থক বনাম ক্রিকেটার

    কখনো এমন লর্ডস দেখিনি। অইন মরগান, রিকি পন্টিংদের অবাক করেছিল সেদিনের বেপরোয়া লর্ডস। বেইরস্টোর ওই স্টাম্পিংয়ের পর লর্ডসে উপস্থিত প্রত্যেক সমর্থকের ভেতরেই হয়তো ক্রোধের আগুন দাউ দাউ করছিল। এর প্রমাণ মিলেছে পরে, লর্ডসের বিখ্যাত লংরুম হয়ে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটাররা যখন ড্রেসিংরুমের পথে, তখন খাওয়াজাকে দেখা যায় কারো সঙ্গে উত্তেজিত হতে। পরে জানা যায়, অস্ট্রেলিয়ানদের উদ্দেশ্যে সেখানে থাকা কয়েকজন কটুকথা বলেছিলেন। খাওয়াজার সঙ্গে ওয়ার্নারও সেসবে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পিছপা হন না। অথচ লংরুমে যে কেউই চাইলে প্রবেশাধিকার পান না, এমসিসির (মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব) সদস্যরাই থাকেন। 

    অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট পরে অফিসিয়ালি এর প্রতিবাদ জানিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করে। এরপর তিনজনকে নিষিদ্ধ করে দেয় লর্ডস। গ্যালারির কাছে গেলে তো দুয়ো আর কটুকথা শুনতেই হয়, সেটা অস্ট্রেলিয়ায় গেলে ইংলিশরাও মুখোমুখি হন। কিন্ত সেই স্টাম্পিং-গেটের পর কী পরিস্থিতি বেসামাল হয়ে গিয়েছিল? হয়তো। এ কারণেই বোধহয় খাওয়াজা পরে বলেছিলেন, 'আমার যদি পরিবার নিয়ে খেলা দেখার ইচ্ছা জাগে, এরকম পরিবেশে নিশ্চয়ই আমি তাদের নিয়ে যাব না।' 

    খাওয়াজার সঙ্গে সমর্থকের আরেকবার এরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। ওভালে টেস্টের তৃতীয় দিনের খেলা শেষে অজিরা ড্রেসিংরুমে ফিরছেন, এক সমর্থক তাদের উদ্দেশ্য করে বারবার বলে যান, 'বোরিং, বোরিং'। লাবুশেনের গায়ে লেগে যায় তা, লাবুশেন যাওয়ার পথে থেমে গিয়ে ওই সমর্থককে বলেন, 'কী বললে তুমি? আবার বলো।' খাওয়াজা সঙ্গে থেকে সে সমর্থককে বলছিলেন 'শান্ত হও।' খাওয়াজা-লাবুশেনের সঙ্গে মুখোমুখি কথার পর অবশ্য ওই দর্শক পরে আসা স্টার্ক, হেজলউডদের শুধু 'হাই' বলতেই থাকেন! 

    রবিনসন হু?

    ১৪১ রানে খাওয়াজাকে আউট করার পর আক্রমণাত্মক সেন্ড-অফ দেওয়ার পথে উত্তেজিত রবিনসন গালিও দিয়েছিলেন বলে খবর পাওয়া যায়। এরপর সংবাদ সম্মেলনে অস্ট্রেলিয়ানরা এটাকে কীভাবে নিবে প্রশ্ন করা হয়েছিল। রবিনসন উত্তর দিয়েছেন, কীভাবে নিবে তাতে তার কিছু যায় আসে না। সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ক্রিকেটারদেরও টেনে এনেছেন, 'আমরা সবাই দেখেছি রিকি পন্টিং ও অন্য অজিদের একই জিনিষ আমাদের সঙ্গে করতে’।

    অস্ট্রেলিয়ার সাবেক কয়েক ক্রিকেটার পরে ঝাঁঝালো প্রতিক্রিয়াই দিয়েছিলেন। ম্যাথু হেইডেন বলেন, 'সে ভুলে যাওয়ার মতো একজন ক্রিকেটার। একজন ফাস্ট বোলার যে কিনা ১২৪ (কিমি/ঘণ্টা) গতির বল করছে।' অস্ট্রেলিয়ার সাবেক উইকেটকিপার ইয়ান হিলির প্রতিক্রিয়া তো ছিল এমন, 'কে, ওলি রবিনসন?'!

    আউট-নট আউট

    শেষ টেস্টে স্টিভ স্মিথের এক নট-আউট নিয়ে হয়েছে তুমুল আলোচনা। দুই রান পূর্ণ করতে গিয়ে ডাইভ দেন স্মিথ। রিপ্লেতে দেখা যায়, বেইরস্টো আগেভাগে স্টাম্পে আঘাত করেছিলেন, এরপর বল গ্লাভসবন্দী করে স্টাম্প ভেঙ্গেছেন। তবে বল ছাড়া বেইরস্টোর স্টাম্প স্পর্শ করা ও বলসহ, এ দুটি অত্যন্ত সামান্য সময়ের মধ্যে হওয়াই বাধে জটিলতা। প্রথম আঘাতে স্টাম্প ভাঙ্গার আগেই যদিও বল হাতে এসেছিল বেইরস্টোর। কিন্ত বেল যখন পুরোপুরি উচ্ছেদ হয়, ততক্ষণে স্মিথ পৌঁছে যান ক্রিজে। থার্ড আম্পায়ার নিতিন মেনন তাই নট আউট সিদ্ধান্তই দেন। 

    কমপক্ষে একটি বেল স্টাম্পের দুই খাঁজ থেকে উঠলেই তবে স্টাম্প ভেঙ্গেছে ধরা হয়। এখানে যখন স্মিথের ব্যাট ক্রিজের ভেতরে, তখনও বেলের একপাশ দেখা যাচ্ছে খাঁজেই আছে। 

    এর মিনিট পয়তাল্লিশ পর স্কাই ক্রিকেটে 'আউট' যুক্তি নিয়ে হাজির হন ইয়ান ওয়ার্ড। নতুন আরেকটি এঙ্গেলে দেখান তিনি, বল হাতে চলে আসার আগে বেইরস্টোর প্রথম আঘাতে তখনও বেল পড়েনি। তাই বল হাতে নিয়ে যখন স্টাম্প ভাঙ্গছেন বেইরস্টো, সেটিই আসবে বিবেচনায়। এখন সেই নতুন এঙ্গেলে তিনি দেখান, স্মিথ ক্রিজে পৌঁছানোর আগেই মিডল স্টাম্প পেছনে চলে যায়, অর্থাৎ তাতে কোন বেল ছিল না, আর অন্য এঙ্গেলে দেখা যাচ্ছিল অফ স্টাম্পের বেলও উঠানো অবস্থায়। তাহলে তো আউট! 

    কিন্ত নতুন সেই এঙ্গেলটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় নিতিন মেনন পাননি। ইয়ান ওয়ার্ড সাথে সাথেই তাই বলেন, চল্লিশের বেশি মিনিট বারবার নানান এঙ্গেলে অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের দুজন করে ক্যাপ্টেন (পন্টিং, টেলর, নাসের, আথারটন) সঙ্গে করে নিয়েও তারা সবাই একই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি। যেখানে কয়েক মিনিটের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিতে হয় আম্পায়ারদের। মাইক আথারটন, মাইকেল বুচারদের তাই মত ছিল, নিতিন মেনন সঠিক সিদ্ধান্তটাই দিয়েছেন, সেটি নট-আউট!

    নতুন বল, পুরনো বল

    ওভাল টেস্টে চতুর্থদিনে শেষ ইনিংসের ৩৭ ওভারের সময়ে খাওয়াজার হেলমেটে উডের বল আঘাত হানে। এরপর বলের আকৃতি নষ্ট হওয়ায় বল পরিবর্তন করেন আম্পায়াররা। আগেরদিন যেখানে বলতে গেলে ‘জিরো মুভমেন্ট’ ছিল, সেখানে পঞ্চমদিনে মেঘলা আকাশের নিচে সুইং ও সিম মুভমেন্ট কমেন্ট্রিতে থাকা রিকি পন্টিংকে বেশ অবাক করেছিল। পরে তো ক্ষোভ উগরেও দিয়েছিলেন ‘ইনভেস্টিগেশন’ হওয়া উচিত পর্যন্ত বলে। পন্টিং বলেছিলেন, ‘আমি বুঝেই উঠতে পারছি না, দুজন আন্তর্জাতিক আম্পায়ার, যাঁরা এর আগে অনেকবার এ কাজ করেছেন, তাঁরা এমন ভুল কীভাবে করেন। এটা এ ম্যাচে বিশাল একটি মুহূর্ত। আমার মনে হয়, এটি খতিয়ে দেখা উচিত—বক্সে কাছাকাছি কন্ডিশনের বল ছিল কি না, নাকি আম্পায়াররা যেকোনো একটা তুলে নিয়ে ভেবেছেন যে তাতেই চলবে।’

    ম্যাচশেষে উসমান খাওয়াজাও এ ব্যাপারে বলেছেন বিস্তারিত, ‘আমি তখনই কুমারকে (ধর্মসেনা) গিয়ে বলেছি, “এ বল মোটেও আগে যেটি দিয়ে খেলছিলাম, সেটির মতো নয়।” আজ (গতকাল) জোয়েলকে প্রশ্ন করি, “আমরা এখন এ বল কীভাবে ব্যবহার করছি? এটা বেশ নতুন।” জবাবে তিনি বলেন, “বাক্সে আর কিছু ছিল না।”’ অস্ট্রেলিয়ান ওপেনার আরও বলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে ক্রিকেটে মাঝেমধ্যে এসবের মুখোমুখি হতে হয়। হয়তো ন্যায্য মনে হয় না, কিন্তু আশা করি, আইসিসি এটি থেকে শিখবে এবং বল বদলানোর প্রক্রিয়ার দিকে নজর দেবে।’