• " />

     

    কিউই, ডাচ, ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান: বহুজাতিক লোগান ফন বিকের ডাচ রূপকথা

    কিউই, ডাচ, ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান: বহুজাতিক লোগান ফন বিকের ডাচ রূপকথা    

    সুপার ওভারে ত্রিশ রান এনে নেদারল্যান্ডসের হয়ে যে লোগান ফন বিক ডাচ রুপকথা লিখলেন, তাকেই আপনি নিউজিল্যান্ডের জার্সিতে দেখতে পারেন। 

    ছোটবেলায় খেলার সাথী, যার সঙ্গে বল-ব্যাটের আনন্দে মেতে উঠার শুরু, তিনি এখন নিউজিল্যান্ড জাতীয় দলের হয়ে খেলেন, বাঁহাতি ব্যাটার হেনরি নিকোলসের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব বহু পুরনো। দুজনেরই বড় ভাইদের বন্ধুত্বের খাতিরে তাদেরও খাতিরানা। 

    লোগান ফন বিকের জন্ম ও বেড়ে উঠা নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চেই। স্কুল শেষে ঘর ছেড়ে যখন বেরিয়েছেন, তখন যেখানে উঠেছেন, সেখানে থাকতেন টম ল্যাথামও। তাদের সঙ্গে আরও এক সদস্য ছিলেন, ম্যাট হেনরি। নিউজিল্যান্ডের অধিনায়কত্ব করা ল্যাথাম, কিউই পেসার হেনরি, আর ফন বিক, তিনজনে মিলে একই ছাদের তলায় কাটিয়েছেন চার বছর। 

    পরে ক্রিকেটে ভালো সুযোগের সন্ধানে ক্রাইস্টচার্চ ছেড়ে ওয়েলিংটনে গিয়েছেন, সেখানে তার ছাদের তলায় সঙ্গী ছিলেন মাইকেল ব্রেসওয়েল। কিউই ডানহাতি অফস্পিনিং অলরাউন্ডারের সঙ্গে তার বসবাস বছর দুয়েক সময়ের। নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটারদের সঙ্গে শুধু সম্পর্কই নয়, তিনিও যে আসলে এক কিউই!

    নিউজিল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত, ক্যান্টারবেরির হয়ে দীর্ঘদিন খেলার পর এখনও ওয়েলিংটনের সাথে চুক্তিবদ্ধ তিনি। এইতো গতবছরেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, নিউজিল্যান্ডের জার্সি গায়ে চাপানোর স্বপ্ন এখনও তার মনে জীবিত। একসময় কিন্ত নিউজিল্যান্ডের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেনও খেলার মাঠে। খেলার মাঠে, কারণ, বাস্কেটবল ও ক্রিকেট, দুটিতেই যে তিনি নিউজিল্যান্ডের হয়ে খেলেছেন। অনুর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ে বাস্কেটবল ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশীপে নেমেছেন। ২০১০ সালের অনুর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপেও তো কিউইদের হয়ে লড়েছেন এই ফন বিক। ৬ ম্যাচ খেলে ৯টি উইকেটও নিয়েছিলেন। 

    দুই খেলার মধ্যে একটি বেছে নেওয়ার সময় যখন হয়েছে, ফন বিক ক্রিকেটেই মন দিয়েছেন। ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে জাতীয় দলে অভিষেকও হয়ে যায় ফন বিকের, তবে নেদারল্যান্ডসের হয়ে। বাবা তার ডাচ বংশোদ্ভূত ও নেদারল্যান্ডসের নাগরিক, সেই সুবাদে তিনিও ডাচদের হয়ে খেলার সুযোগ লুফে নেন। তবে একটা বাধা ছিল তার সামনে, এর আগেই যেহেতু নিউজিল্যান্ডের হয়ে অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে খেলেছেন তিনি, সেজন্য তাকে আরও তিন বছর অপেক্ষা করতে হতো অন্য কোন সহযোগী দেশের হয়ে খেলতে। ২০১৪ সালে তার অভিষেক হওয়ার আগেই অবশ্য সেসময়টা কেটে গিয়েছিল। তবে ফন বিক যা বললেন, সহযোগী দেশের পক্ষে আজ খেলেছেন, কালই খেলতে পারবেন পূর্ণ কোন সদস্যের হয়ে। তার মানে নেদারল্যান্ডসের হয়ে আজ নামলেন ফন বিক, কাল নিউজিল্যান্ডের জার্সিতে, এমনটাও সম্ভব তাহলে!

    ফন বিকের নানা কিন্ত দুই দেশের হয়েই জাতীয় দলে খেলেছেন। জন্ম ত্রিনিদাদ এন্ড টোব্যাগোতে, সামি গিলেন ১৯৫০-৫১ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে খেলেছেন পাঁচটি টেস্ট। এরপর পাড়ি জমিয়েছিলেন নিউজিল্যান্ডে। কী কাকতাল, সেখানে গিয়ে জন্মভূমির বিপক্ষে, অর্থাৎ উইন্ডিজদের বিপক্ষে ১৯৫৬ সালে কিউইদের প্রথম যে টেস্ট জয়, সেটিরই অংশ বনে গেছেন তিনি। ফন বিককে তাই বহুজাতিক বলাই যায়! তিনিও তো বলেন, 'আমি এখনও ডাচ, এখনও ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান, এখনও কিউই'! 

    'কিউই' লোগান ফন বিক অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে

    ডাচদের হয়ে যে ইতিহাস লিখেছেন, সেটিতে নেদারল্যান্ডসের ক্রিকেটে অমরত্ব নিশ্চিত তার। ৩৭৫ রানের লক্ষ্যটাও তাড়া করে ফেলা সম্ভব, তেজা নিদামারানু ও স্কট এডওয়ার্ডসের ব্যাটে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল ডাচ ডাগআউট। কিন্ত শেষের দিকে উইকেট হারিয়ে যখন আট নাম্বার ব্যাটার হিসেবে নেমে ফন বিক প্রথম বলটা খেলবেন, তখন তাদের প্রয়োজন ৪ ওভারে ৪৮ রান। দুর্দান্তভাবে খেলে ১৪ বলে ২৮ রানের ইনিংসে ফন বিক খেলা নিয়ে গিয়েছিলেন একেবারে হাতের নাগালেই। কিন্ত ১ বলে ১ রানের সমীকরণ নিয়ে শুরু হওয়া বলটার শেষ হল ফন বিকের আউটে। 

    সুপার ওভারে এরপর যা করলেন, সেটি ফন বিকের ভাষায় 'ব্যাখা করতে পারার মত না'! শুধু রেকর্ড বলেই তাই হয়তো বুঝানো যাচ্ছে না। এখন হয়তো জেসন হোল্ডারকে আপনি গুণায় ধরতে নাও পারেন, তবে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান অভিজ্ঞ এই বোলার কী আর এত ফেলনা কেউ! সেই হোল্ডারকেই পাড়ার বোলারই বানিয়ে ছাড়লেন ফন বিক। এক ওভারে তিন চার, তিন ছয়ে ৩০ রান। সুপার ওভারে কোন দলই যেখানে এর আগে সর্বোচ্চ ২৫ রান আনতে পেরেছিল, সেখানে এক ব্যাটারের একার ৩০ রান এনে ফেলার যে রেকর্ড, সেটি বলে দেওয়ার জন্য রেকর্ডবুক ঘাটারও আসলে খুব প্রয়োজন নেই! ওখানেই থামলেন না, পরে আবার বোলিংয়ে এসেও পাঁচ বলে ৮ রান দিয়ে ফন বিকের শিকার বরাদ্দ দুটি উইকেট। 

    এই যে স্বপ্নের দিন কাটালেন, অথচ তিনি হয়তো সেসবে শামিলই হতে পারতেন না। নেদারল্যান্ডসের অনেক ক্রিকেটারই কাউন্টি ক্রিকেটে চুক্তিবদ্ধ থাকায় এই কোয়ালিফায়ারে খেলছেন না। তাদের মধ্যে আছেন কলিন আকারম্যান, ফ্রেড ক্লাসেন, পল ফন মিকারান, যারা ব্যস্ত আছেন ব্লাস্টে। লোগান ফন বিকের যদি কাউন্টি চুক্তি থাকত, তবে…সহযোগী দেশের বাস্তবতাই এমন, তাদের দেশের চেয়ে কাউন্টি চুক্তিতেই যে জীবন পার করা সহজ হয়! 

    নিউজিল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেটেই যেমন ওয়েলিংটনের সঙ্গে চুক্তি আছে লোগান ফন বিকের। এর আগে সেকারণে নেদারল্যান্ডসের খেলা ছাড়তেও হয়েছিল তাকে। ছয় মাসের সে চুক্তির বাইরের সময়ে তিনি খেলেন নেদারল্যান্ডসের ক্রিকেটে, পাশাপাশি পার্ট-টাইম চাকরিও নাকি করেন। আবার নিউজিল্যান্ডে খেলার সময়েও থাকেন পার্ট-টাইম চাকরিতে ব্যস্ত। সহযোগী দেশের ক্রিকেটারদের বেলায় এসব গল্প আর ব্যতিক্রমী কিছু নয়! তবে ফন বিকের নানান মোড়কে রঙিন গল্পটায় উজ্জ্বল এক অধ্যায়ই যোগ হয়েছে হারারেতে। 

    ইতিহাস লেখার পরে বলেছিলেন, ১৩-১৪ বছর ধরে ক্রিকেট খেলছেন, এমন পরিস্থিতিতে পড়েছেন অনেকবারই, তবে ব্যর্থ হয়েছেন বারবার। একটা কথা নাকি মেনে চলেন তিনি, সাতবার পড়ো, অষ্টমবার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাও। ফন বিক উইন্ডিজদের বিপক্ষে সে পরিস্থিতিতে পেরেছেন। বলেছেন, এমন কিছুর জন্য আরও ১৩-১৪ বছর যদি অপেক্ষাও করতে হয়, আপত্তি থাকবে না! 

    আসলে ফন বিক যা করেছেন, সেই অপেক্ষার ব্যাপ্তি বাড়তেই থাকবে, হয়তো এমন দিনের দেখা পাওয়া সম্ভব হবে না। তবে তার সে 'সব পাওয়ার' দিনে নি:সন্দেহে এখন কোথাও না কোথাও থেকে গর্ব করছেন- টম ল্যাথাম, হেনরি নিকলস, ম্যাট হেনরি কিংবা মাইকেল ব্রেসওয়েল! এমন একজনের হাত ধরেই যে ডাচ রুপকথার জন্ম হয়েছে, তিনি কিউই, আবার ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানও! এই উদযাপন তাই কেবলই নেদারল্যান্ডসের নয়।

    আচ্ছা, জাতীয় দলের কতটা কাছাকাছি আপনি, সেটার ইঙ্গিত তো নিশ্চয়ই দিতে পারে 'এ' দল। নিউজিল্যান্ড 'এ' দলের হয়ে গতবছরই ভারত সফর করে গেছেন লোগান ফন বিক…