• " />

     

    অ্যাশেজ ২০২৩: দর্শনের দ্বন্দ্বে দর্শনীয় ক্রিকেট

    অ্যাশেজ ২০২৩: দর্শনের দ্বন্দ্বে দর্শনীয় ক্রিকেট    

    প্রথম বলেই চার, অ্যাশেজে রোমাঞ্চের আগাম বার্তা মিলেছিল তখনই। আরেকটা গুরত্বপূর্ণ বিষয়ও ঘটেছিল প্রথম বল মাঠে গড়ানোর আগেই। অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক শুরুর সে বলের আগে যে ফিল্ড সাজিয়েছিলেন, তাতে বাউন্ডারিতে ছিল দুজন, ফাইন লেগের সঙ্গে ডিপ ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টও রেখেছিলেন কামিন্স। পিচ কেমন আচরণ করবে, ব্যাটারদের মনোভাব কেমন হবে, সেসব নিয়ে ধারণা পাওয়ার আগেই প্যাট কামিন্সের এমন ফিল্ডসেট বিস্ময়করই ছিল আসলে। 

    তৃতীয় ওভার যেতে না যেতেই বাউন্ডারিতে ফিল্ডারের সংখ্যা আরেকজন বেড়ে গিয়ে তিনজন হয়৷ ন্যাথান লায়নও তার ওভার শুরু করেছিলেন চার ফিল্ডার বাইরে রেখে। দিনের প্রথম সেশনেই পরিস্কার হয়ে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার রক্ষণাত্মক কৌশল। অথচ অস্ট্রেলিয়ানদের আগ্রাসী মানসিকতার কথাই সকলে জানে! অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তি অধিনায়ক রিকি পন্টিংয়েরও এমন ফিল্ডসেট পছন্দ হয়নি। 

     

     

    অস্ট্রেলিয়ার এই কৌশল নিয়ে অ্যাশেজের শুরুর দিনে সব আলোচনাতেই বিস্ময়ের ছায়া ছিল৷ এই কৌশলে 'শকড' ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক অইন মরগান বলেছিলেন, 'আমি আসলে বিস্মিত হয়েছি তাদের ফিল্ড কতটা ডিফেন্সিভ ছিল তা দেখে। যা তারা এর আগে কখনো করেনি।’ ইংল্যান্ডের আরেক সাবেক অধিনায়ক স্যার এলিস্টার কুক তো দারুণভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন 'মনে হয়েছে কিছুটা আন-অস্ট্রেলিয়ান' বলে। কেভিন পিটারসনের মনে হয়েছিল, অস্ট্রেলিয়া শুরুতেই প্ল্যান-বি তে চলে গেছে। 

    এজবাস্টনের ফ্ল্যাট পিচে সে কৌশল পুরো সময়েই ধরে রেখেছে অস্ট্রেলিয়া। তাদের উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট, বাউন্ডারি বাঁচিয়ে যতটা আক্রমণ করা যায় ততটাই। তবে অনেক সময়ই তাদের শুধু বাউন্ডারি বাঁচানোর দিকেই মনযোগ দিতে হয়েছে। সাধারণত বাউন্সার আক্রমণে গেলে ফিল্ডার ছড়িয়ে রাখতে দেখা স্বাভাবিক, তবে দ্বিতীয় ইনিংসে জো রুট ব্যাটিংয়ের একটা সময়ে অস্ট্রেলিয়ার সাধারণ ফিল্ডসেটেই বাউন্ডারিতে চারজন ছিলেন। 

     

    প্রথম দিনেই সংবাদ সন্মেলনে এসে হেজলউড বলেছিলেন, বাউন্ডারি বাঁচিয়ে ওভারপ্রতি পাঁচ করে রান দিয়েও, নিয়মিত উইকেট নিতে পারলে তারা নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারবে। অস্ট্রেলিয়ার সে কৌশলের কারণে ইংল্যান্ডের ব্যাটাররা সহজে স্ট্রাইক বদলও করতে পারছিলেন, এটিতেই বিপত্তি ছিল পন্টিংয়ের, 'যদি স্কোরবোর্ডে রান যোগ হতেই থাকে, তাহলে ব্যাটসম্যান কখনোই চাপ অনুভব করবে না'।

    প্রথম টেস্টে অনেকবার ব্যাটসম্যান যখন নতুন ক্রিজে, তখনও আসলে অস্ট্রেলিয়া বাউন্ডারি বাঁচানোর চেষ্টায়ই মগ্ন ছিল। অস্ট্রেলিয়ানরা লড়বে আগুনের বিপরীতে আগুনে। সিরিজ শুরুর আগে বাজবলের স্রোত কোন কায়দায় আটকায় অজিরা, তা নিয়ে আগ্রহ ছিল সীমাহীন, সেখানে অস্ট্রেলিয়ানদের রক্ষণাত্মক কৌশল চমকে দেওয়ার মতোই ছিল। 'আন-অস্ট্রেলিয়ান' পন্থা নিয়ে সমালোচনা হয়েছেই, তবে শেষমেশ কামিন্স নৈপুণ্যে প্রথম টেস্টে ফলাফল, তাদেরই পক্ষে! 

    দ্বিতীয় টেস্টেও অস্ট্রেলিয়া চলেছে মোটামুটি একই পথে। তবে সেখানে দেখা গিয়েছিল বাউন্সারের বন্যা। বাউন্সারে বিরক্তির শেষে যদিও মিলেছে বাউন্সারে বিনোদনও। আর বাউন্সারের ক্ষেত্রে এভাবে পাঁচ ফিল্ডার বাইরে রেখে আক্রমণ অস্বাভাবিক কিছু না।

     

    পিচ যখন পেসারদের জন্য সহায়ক ছিল, যেমন হেডিংলিতে মুভমেন্ট মিলেছে যথেষ্ট। তখন আবার অস্ট্রেলিয়া আক্রমণাত্মক ফিল্ড সাজিয়েই বোলিং করেছে। ব্যাটারদের জন্য রান করা কঠিন নাকি সহজ হচ্ছে, সেটির উপরই বলা যায় নির্ভর করেছে অস্ট্রেলিয়ার ফিল্ডসেট। 

    তবে বাকি সব টেস্টেই আসলে কামিন্সকে রক্ষণাত্মক কৌশলেই এগিয়ে যেতে হয়েছে। এই যেমন দেখুন, নিচের ছবিটায় ছয়জন বাউন্ডারিতে, সেসময় অবশ্য ম্যানচেষ্টারে বেইরস্টো-তান্ডব চলছিল।

     

    মোদ্ধাকথা, সময় বুঝে মাঝেমধ্যে আক্রমণাত্মক হয়েছে, তবে হেডিংলি টেস্ট বাদ দিলে সিরিজজুড়েই আসলে অস্ট্রেলিয়া ডিফেন্সিভ ফিল্ডসেটেই মন দিয়েছে। ওভালে শেষ টেস্টের প্রথম ইনিংসে পঞ্চম ওভারের খেলা যখন চলছে, তখনকার ফিল্ডসেট দেখুন তো নিচের ছবিতে! অস্ট্রেলিয়া আসলে এভাবেই চালিয়ে গেছে, ব্যাটাররা যত আক্রমণাত্মক হয়েছেন, ততই ফিল্ডার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখেছে। 

     

     

    দ্বিতীয় ইনিংসে অবশ্য আক্রমণাত্মক ফিল্ডসেটে ইংলিশ ব্যাটারদের বিপক্ষে খেললে কী হতে পারে, সেটি টের পাওয়া গেছে। শুরুর কয়েক ওভারে কোনমতেই যেন বাউন্ডারি আটকাতে সক্ষম হচ্ছিল না অজিরা, কিছুটা খারাপ বোলিংয়েরও যাতে অবদান ছিল অবশ্য। 

     

    অস্ট্রেলিয়ার ট্যাকটিকস সরল রুপে ছিল এমন- দ্রুত রান করতে চাও, আমরা রান করতে দিব না, বাউন্ডারি আটকানোই হবে তাতে প্রথম পদক্ষেপ, শক্তির জায়গায় আঘাত যদি করি আমাদের পাওনা উইকেটও মিলবে। সে কৌশলকে আপনি যে চোখেই দেখুন না কেন, পুরো সিরিজে আসলে অস্ট্রেলিয়া এভাবে ইংল্যান্ডকে বেঁধে রাখতে সক্ষম হয়েছিল বলাই যায়। ইংল্যান্ডের ব্যাটিং ইনিংসের দৈর্ঘ্য যে নব্বই ওভারের উপরে যায়নি একবারের বেশি। নাগালের বাইরে ইংলিশরা শুধু গিয়েছিল ম্যানচেস্টারে। বেশি আক্রমণাত্মক হতে গেলে হয়তো ইংল্যান্ড আরও নাগালের বাইরে যেত! কিন্ত অস্ট্রেলিয়া কী মাঝেমধ্যে বেশি রক্ষণাত্মক হয়ে গিয়েছিল, সে প্রশ্নও ফেলে দেওয়া যায় না। তবে যে ফলাফল সব, তা বলছে দুদলই সমান। 

    অন্যদিকে ইংল্যান্ড কাপ্তান বেন স্টোকস প্রায় সবসময়ই আগ্রাসী ফিল্ডসেটে বোলিং করানোর চেষ্টা করেছেন। মাঝেমধ্যে বাউন্সার আক্রমণের সময়, কিংবা টেইলএন্ডারকে স্ট্রাইকে আনার জন্য ফিল্ডার ছড়িয়ে রেখেছেন। এর বাইরে আক্রমণাত্মকই ছিলেন, রান যখন হাতে ছিল বেশি, তখন তো আরও বেশি আগ্রাসী। এজবাস্টনে যেমন দেখা মিলেছিল, আক্রমণাত্মক ফিল্ডসেটের নানা উদ্ভাবনী প্রদর্শনী। অবশ্য স্টোকসের ক্ষেত্রে সুবিধা হয়েছে, অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটারদের টেস্ট মানসিকতায় খেলার ধরন। 

     

     

    অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটাররা সিরিজজুড়ে রান করেছে ৩.৩৫ রান রেটে। অস্ট্রেলিয়ার দুর্দান্ত বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে ইংল্যান্ডের 'বাজবল' পেরে উঠবে তো? সে সংশয় নিশ্চয়ই দূর করে দিয়েছে ইংল্যান্ড ওভারপ্রতি ৪.৭৪ রান করে এনে। টেস্টের দীর্ঘ ইতিহাসে অন্তত চার টেস্টের সিরিজে কোন দল এত বেশি রান রেটে ব্যাট করতে পারেনি৷ আর অজি পেসাররা ওভারপ্রতি রান দিল কত করে? ৪.৬৫, যা আবার কমপক্ষে চার টেস্টের সিরিজে পেসারদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে খরুচে। 

    দুই দলের রান রেটের পার্থক্যটা ১.৩৯, কমপক্ষে চার টেস্টের সিরিজে দুদলের রান রেটে এত বেশি পার্থক্য এর আগে কখনোই দেখা যায়নি। এই রান রেটের তফাতই পরিস্কারভাবে দুই দলের খেলার স্টাইলে ভিন্নতা বুঝিয়ে দিচ্ছে। সেই ভিন্নতা ফুটে উঠেছিল স্ট্রাইক রেটেও। ইংল্যান্ড খেলেছে ৭৪.১৪ স্ট্রাইক রেটে, আর অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রে তা ৫১.১৯। তবে ইংল্যান্ডের ব্যাটাররা ৩৪.৩৫ গড়ে রান পেয়েছে তো, অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং গড় ছিল ২৯.৯৪। 

    রান রেট আর স্ট্রাইক রেট, দুই দলের খেলার দুরকম ধরনের কথা স্পষ্টতই বলছে। তবে স্টাইলের সেই ভিন্নতা আসলে ভালো করেই টের পাওয়া গিয়েছিল, বোলিং ইনিংসে অস্ট্রেলিয়াকে দেখে। টেস্টের প্রত্যেক ইনিংসেই আসলে দেখা মিলেছিল, দুটি ভিন্ন স্টাইলের লড়াই। অস্ট্রেলিয়া তাদের মনোভাব থেকে দূরে সরেনি, অ্যাশেজ শেষ করেছে একই স্টাইলে খেলে। প্রথম দুই ম্যাচে হারের পর সমালোচনার ঝড় বয়ে গেলেও ইংল্যান্ডও তাই করেছে। ব্রেন্ডন ম্যাককালাম যেমন বলছিলেন, 'খেলার দুই ধরন এবং তাতে পূর্ণ বিশ্বাস। আমার মনে হয় দুই দলই তাদের স্টাইলে বিশ্বাস রেখে খেলে গেছে, যে কারণে একটা দারুণ হেভিওয়েট লড়াই তৈরি হল।’

    দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের স্টাইল, ট্যাকটিকসে বিশ্বাসী দুটি দল লড়ছে সমানতালে। এতেই বেড়ে গিয়েছিল এই অ্যাশেজের সৌন্দর্য। অস্ট্রেলিয়াও এতটা রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে খেলে না সাধারণত। সামনেই হয়তো ভিন্ন প্রতিপক্ষের সঙ্গে কোন সিরিজে বিপরীত কৌশল রপ্ত করবে। তাই এটিকে আসলে ঠিক দর্শনের আদলে ফেলা যায় না। তবে এ সিরিজ শুধু বিবেচনায় নিলে, দর্শনের দ্বন্দই হয়েছে বলা যায়। আর সে দর্শনের দ্বন্দেই তো দেখা মিলেছে দর্শনীয় ক্রিকেট।