• কোপা আমেরিকা
  • " />

     

    ট্যাকটিক্যাল বিশ্লেষণ: ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা, কে জিতবে, কেন জিতবে?

    ট্যাকটিক্যাল বিশ্লেষণ: ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা, কে জিতবে, কেন জিতবে?    

    কোপা আমেরিকার সেমিফাইনালে মুখোমুখি হচ্ছে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। দুই দলের কোচ কোন ফর্মেশনে দল নামাবেন? কেমন হবে তাদের খেলার ধরন? ব্রাজিল নাকি আর্জেন্টিনা কারা এগিয়ে আছে?


    তিতের ব্রাজিল সাধারণত ৪-২-৩-১ ফর্মেশন অনুসরণ করে। মিডিফিল্ডে আর্থার ও কাসেমিরো ডাবল পিভটের ভূমিকায় থাকলেও, কাসেমিরো মূলত হোল্ডিং মিডফিল্ডার। আর্থার মিডফিল্ডে প্লে মেকার হিসেবে খেলেন। আর ফিলিপ কুতিনিয়ো আক্রমণে মূল উৎস। এবারের কোপা আমেরিকায় ব্রাজিলের খেলায় শুরু থেকেই একটা ব্যাপার স্পষ্ট, গোল করতে চায় দলটা। ম্যাচের শুরু থেকেই হাফস্পেস ধরে আক্রমণে ওঠার চেষ্টা করেন এভারটন ও গ্যাব্রিয়েল হেসুস। আর রবার্তো ফিরমিনো যে কোনো গোছানো দলের রক্ষণই ভেঙে দিতেই সিদ্ধহস্ত। তবে গোলের সামনে ব্রাজিলের সমস্যার কারণ এটাই। লিভারপুলের আক্রমণ ভাগে সালাহ-মানেরা যেমন ন্যারো অ্যাটাকে ওঠেন, ব্রাজিল এক্ষেত্রে একটু ভিন্ন। বিশেষ করে হেসুসের দুর্বলতা এক্ষেত্রে স্পষ্ট। হাফস্পেসে থেকে ন্যারো অ্যাটাকে ওঠা হেসুসের ধার না কমলেও, ওয়াইড স্পেস ধরে আক্রমণে দুর্বল তিনি। রাইট সাইডে দানি আলভেজের সঙ্গে কম্বিনেশন প্লে এখনও সেভাবে ওঠেনি হেসুসের।

    আর্জেন্টিনার রক্ষণে অন্তত এইদিকটাকে শক্ত বলা যায়। নিকোলাস টালিয়াফিকো মনোযোগী লেফটব্যাক। ব্রাজিলের আক্রমণের ডানদিক দিয়ে টালিফিকোর সঙ্গী বড়সড় ভুল না করলে ওই প্রান্ত দিয়ে ব্রাজিলের সাফল্য পাওয়ার সম্ভাবনা অন্তত কাগজে কলমে কম। তবে টালিয়াফিকোরও দুর্বলতা আছে।

    ব্রাজিলের দুই সেন্টারব্যাক থিয়াগো সিলভা ও মার্কিনহোস বল প্লেয়িং ডিফেন্ডার। বিল্ড আপের সময় ব্রাজিলের ডিফেন্স থাকে হাই লাইনে। আর আর্থার ও কাসেমিরো এই দুই সেন্টারব্যাকের সঙ্গে মিডফিল্ডে একটা বক্সের মতো তৈরি করে ডিফেন্সিভ স্ট্যাবিলিটি বাড়ান। তাই সিলভা বা মার্কিনহোস হাফ স্পেসে বল পাঠাতে পারেন। সেগুলো সাধারণত লং বলই হয়। উচ্চতা কম হওয়ায় টালিয়াফিকো এদিক থেকে পিছিয়ে আছেন এদিক থেকে।


    আরও পড়ুনঃ কিক অফের আগেঃ সেমিফাইনাল যখন ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার


    আর্জেন্টিনার রক্ষণের ডানদিক নিয়েই যত সমস্যা। চার ম্যাচে তিনজন খেলেছেন রাইটব্যাক হিসেবে। আগের ম্যাচে হুয়ান ফয়েথ রক্ষণে তেমন ভুল করেননি। ফয়েথ মূলত সেন্টারব্যাক। শিফটেড রাইটব্যাক পজিশনে তাকে খেলালে আর্জেন্টিনার রক্ষণে ভরসা বাড়ে আরেকটু। আর ওই প্রান্তে খেলা এভারটন কাট করে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেন। এবারের কোপায় দুর্দান্ত দুইটি গোল করেছেন প্রায় একইভাবে। ইনজুরির কারণে ফিলিপে লুইজ না খেললে সেটা শাপেবরও হতে পারে ব্রাজিলের জন্য। লুইজের রিপ্লেসমেন্ট অ্যালেক্স সান্দ্রো তার মতো রক্ষণে বেশি মনোযোগী না হলেও আক্রমণে বেশি ধারালো। ফয়েথ রাইটব্যাক না হওয়ায় ওই প্রান্ত ধরে আর্জেন্টিনার আক্রমণে তার সাহায্য করার সক্ষমতা নিয়ে সংশয় থেকে যায়। তাই সান্দ্রো-এভারটন মিলে আক্রমণের বামদিকে ব্রাজিল ভালো কিছুর আশা করতেই পারে। 

     

     

    আর্জেন্টিনার দুই সেন্টারব্যাক নিকোলাস অটামেন্ডি ও জার্মান পেতজেলা- কেউই নির্ভরতার প্রতীক হয়ে উঠতে পারেননি। পরেরজন অবশ্য রক্ষণে তেমন একটা ভুল করেননি এবার, তবে অটামেন্ডির খেলার ধরনটাই ভুল আর সঠিকের মিশেল। কোপায় এবার প্রায় প্রতি ম্যাচেই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বড় ভুল করেছেন তিনি।

    ব্রাজিল এখন পর্যন্ত যাদের সঙ্গে খেলেছে, তারা প্রায় সবাই নিজেদের রক্ষণে ছিল অধিক মনোযোগী। তাই জমাট রক্ষণ ভাঙতেও বেশ ভুগতে হয়েছে ব্রাজিলকে। আর্জেন্টিনার বিপক্ষে অবশ্য খোলামেলা রক্ষণের আশা করতেই পারে ব্রাজিল। একমাত্র পেরুই ব্রাজিলের বিপক্ষে আক্রমণাত্মক খেলার চেষ্টা করেছিল, তারা এরপর ব্রাজিলের কাছে হেরেছিল ৫-০ গোলে। রাতারাতি আর্জেন্টিনার আক্রমণ দুর্গ তুলে না ফেললে গোল পেতে অন্তত সমস্যা হওয়ার কথা নয় ব্রাজিলের। সেটা হলেও শুরু থেকেই বা বদলি হয়ে নামা উইলিয়ানও আর্জেন্টিনার জন্য যথেষ্ট দুশ্চিন্তার কারণ তৈরি করতে পারেন। আক্রমণে তিনি আরও ডাইরেক্ট আপ্রোচ এনে দেন দলকে। ব্রাজিলের প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই এবার নিয়মিত চিত্র হয়ে গেছে সেটা।

    আক্রমণ এখনও ব্রাজিলিয়ানদের মন ভরাতে না পারলেও রক্ষণ নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকার নয় ব্রাজিলের। গোলরক্ষক থেকে শুরু করে রক্ষণ, মিডফিল্ড পুরোটাতেই স্থিতিশীল এক দলের ছাপ। সিলভা, মার্কিনহোসরা এখনও গোল হজম করেননি এই টুর্নামেন্টে। বিশ্বকাপের পর ব্রাজিল ১৪ ম্যাচে গোল খেয়েছে মাত্র দুইটি। প্রতিপক্ষ দল আছে সেরা ফুটবলার, সম্ভব বিশ্বেরই সেরা তিনি- কিন্তু সেখানেও আশা আছে ব্রাজিলের। মেসি নিজেও ফর্মে নেই। নিজেদের কাজটা ঠিকঠাক করে সিলভারা আপাতত আশা করতে পারেন অতিমানবীয় কিছু একটা করে বসবেন না মেসি। ফাইনালের পথটা এখান থেকে খুব কাছেই মনে হওয়ার কথা ব্রাজিলের।

    দলে লিওনেল মেসি থাকাটা আর্জেন্টিনাকে ব্রাজিলের সমকক্ষে তুলে দিচ্ছে প্রায়। বহুবার আর্জেন্টিনার দুঃসময়ে দলের হাল ধরেছেন তিনি। এবারও তার কাছ থেকে সেরকম কিছুই আশা করবে আর্জেন্টাইনরা। গোলের জন্য অবশ্য নতুন আশার প্রদীপ খুঁজে পেয়েছেন আর্জেন্টিনা কোচ লিওনেল স্কালোনি। লাউতারো মার্টিনেজ শারীরিক সামর্থ্য বেশ ভালো। ফিনিশও মন্দ নয়। দুই ম্যাচে দুই গোল করে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতিও নেই। সার্জিও আগুয়েরোর সঙ্গে বোঝাপড়াও দারুণ তার। ব্রাজিলের এই রক্ষণ এখনও পর্যন্ত তেমন পরীক্ষায় পড়েনি প্রতিপক্ষে ফুবটলারদের কাছ থেকে। আগুয়েরো-মেসি-মার্টিনেজরা নিজেদের সেরাটা খুঁজে বের করতে পারলে তাদের আটকে রাখা কঠিনই হবে। আর পাউলো দিবালারাও বদলি থেকে নেমে বদলে দিতে পারেন ম্যাচের ভাগ্য। 

    মেসি কোপায় কেন পারছেন না সেটার জবাব অবশ্য আগে খুঁজতে হবে। মেসি সাধারণত নিজের পছন্দমতো জায়গায় প্রায় পুরো মাঠ জুড়ে খেলেন। তার কোনো নির্দিষ্ট পজিশন থাকে না ক্লাবের হয়ে। কিন্তু ক্লাব বাকি খেলোয়াড়দের সঙ্গে তার সমন্বয়টা হয় সঠিক। ৪-৩-৩ ফর্মেশনের অন্যতম মূল ভিত্তি রাইট বা লেফট সাইডে ট্রায়াঙ্গেল তৈরি করে আক্রমণে ওঠা। ট্রায়াঙ্গেল মেসি তৈরি করছেন ঠিকই, কিন্তু বাকি দুইজন তাকে সাহায্য করতে পারছেন না তেমন একটা। বিল্ড আপেও সমস্যা আর্জেন্টিনার। ছোট পাসে নিজেদের অর্ধ থেকে বিল্ড আপ করে আর্জেন্টিনা খেলে আসছে বহুদিন ধরে। কিন্তু গোলরক্ষক ফ্রাঙ্কো আর্মানির জন্য সে কৌশল বদলে ফেলতে হচ্ছে। দলে একজন সেন্টার ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার না থাকা অবশ্য বড় কারণ। লিয়ান্দ্রো পারেদেসকে অনেকটা জোড় করেই খেলানো হচ্ছে এই রোলে। মিডফিল্ডে সৃজনশীলতার অভাবটাও তাই আর যায়নি আর্জেন্টিনার।

    মাঝে মধ্যে মেসি নির্ভরতাও কাল হচ্ছে আর্জেন্টিনার। ফাঁকা স্পেস কাজে লাগানোর বদলে মেসিকে খুঁজে পাস দিতে দেখা গেছে একাধিক আর্জেন্টিনা খেলোয়াড়কে। তাতে একটা সম্ভাবনাময় আক্রমণ থেকে খালি হাতেই ফিরেছে আর্জেন্টিনা।

    কোপা শুরুর আগে আর্জেন্টিনা কোচ লিওনেল স্কালোনি বলেছিলেন, ৪-৪-২ তার পছন্দের ফর্মেশন। প্রথম ম্যাচের পরই অবশ্য সরে এসেছেন সেখান থেকে, আপাতত ৪-৩-১-২ ফর্মেশনে খেলছে আর্জেন্টিনা। দুই স্ট্রাইকারের পেছনে খেলা মেসি এখনও নিজেকে প্রমাণ করতে পারেননি এবারের আসরে। এই ফর্মেশনে আর্জেন্টিনা গোলের দেখা পেলেও, মেসির ফর্ম নেমে গেছে তাই অনেকটাই।

    মিডফিল্ড আর রক্ষণের বিচারে ব্রাজিলের চেয়ে ঢের পিছিয়ে তারা। অন্তত এই ম্যাচের জন্য কাউন্টার অ্যাটাকে খেলার জন্য মনস্থির করতে পারেন স্কালোনি। সেটাই টোটকা হয়ে যেতে পারে আর্জেন্টিনার। আঁটো সাটো রক্ষণে খুব বেশি ভুল না করে ব্রাজিলকে আটকে রাখতে পারলে ঘরের মাঠে উলটো চাপে পড়ে যাবে স্বাগতিকেরাই। এরপর খেলাটা মাঠের ফুটবলের চেয়ে বরং মানসিকতার। সময়মতো এরপর একটা গোল করে বসতে পারলেই ভাগ্য খুলে যেতে পারে আর্জেন্টিনার।

    কিন্তু আর্জেন্টিনার কোচ আর্জেন্টিনার জন্য দায়বন্ধতাও। প্রায় প্রতি ম্যাচেই তার নতুন একাদশ নামানোটা ইঙ্গিত করছে সেরা একাদশটা এখনও জানেন না তিনি। অভিজ্ঞতার দিক দিয়েও স্কালোনি পিছিয়ে অনেক।  তবে ব্রাজিলের সঙ্গে একটা ম্যাচ আছে তার ঝুলিতে কোচ হিসেবে। সে ম্যাচেও আর্জেন্টিনা তেমন একটা আক্রমণে ওঠেনি। তবে ব্রাজিলকে প্রায় হতাশ করে ছেড়েছিল আর্জেন্টিনা। শেষ মুহুর্তের গোলে অবশ্য ব্রাজিলই প্রীতি ম্যাচটা জিতে নিয়েছিল আগের বছর। তখন স্কালোনির হাতে ছিলেন না মেসি। এবার আছে। কিন্তু স্কালোনি কি ব্রাজিলকে টেক্কা দেওয়া বিদ্যা খাটাতে পারবেন বেলো হরিজন্তেতে?