• " />

     

    যিনি এনেছিলেন কিউইদের 'সেরা সময়'

    যিনি এনেছিলেন কিউইদের 'সেরা সময়'    

    ওয়েলিংটনে ঠান্ডা তখন জেঁকে বসছে। তবে দর্শকদের ‘কেক-টিন’ ছেড়ে যাওয়ার নাম গন্ধই নেই! পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান দেখতে হবে, শুনতে হবে তাদের ‘নেতা’র কথা! ডাবল সেঞ্চুরি করা মার্টিন গাপটিল, ড্যানিয়েল ভেট্টোরি, দলীয় পারফরম্যান্স বা খোদ দর্শকদের কথা, ব্রেন্ডন ম্যাককালাম যাই বলেন, দর্শকদের উচ্ছ্বাসই বাড়ে শুধু! কোয়ার্টার ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়েছে নিউ জিল্যান্ড, বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে গেছে সপ্তমবারের মতো। দর্শকদের উচ্ছ্বাসের কারণ তো আছেই।

    ৩০.৩ ওভারে ৮.১৯ রানরেটে অলআউট হবার আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজ করেছিল ২৫০ রান। উইকেটসংখ্যা না বললে যে কেউ বলবেন, ‘খারাপ কী!’ তবে ভাল খারাপ যাই হোক, ওয়েস্ট ইন্ডিজের জন্য এ রান যথেষ্ট ছিল না! লক্ষ্য যে ছিল ৩৯৪! ব্রেন্ডন ম্যাককালামের ‘নতুন ধারা’র অধিনায়কত্বের অনেক বড় পরিচায়ক হতে পারে এ ম্যাচ। ব্যাটসম্যান অনুকূল সব নিয়মে ব্যাটসম্যানদের বেঁধে রাখার একমাত্র উপায় উইকেট নেয়া, ম্যাককালাম যেন নতুন করে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন এ তত্ত্বই! ট্রেন্ট বোল্টকে দিয়ে তাই এ ম্যাচে টানা দশ ওভার বল করিয়েছিলেন ম্যাককালাম। ২০১৫ বিশ্বকাপের নিউজিল্যান্ডকে বুঝতে এ ম্যাচটির দিকে একবার তাকাতে পারেন, ম্যাককালামের অধিনায়কত্ব বা নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটে ম্যাককালামের অবদান বুঝতে তাকাতে পারেন সে বিশ্বকাপের দিকে!

    সপ্তমবারের চেষ্টায় নিউ জিল্যান্ড গড়লো ইতিহাস, আগের কোনো কিউই অধিনায়ক যা করতে পারেন নি, ম্যাককালাম করলেন তাই! ভিলিয়ার্স-মরকেলদের কান্না, ম্যাককালামের ২৬ বলে ৫৯ রানের পর ইডেন পার্কে গ্রান্ট এলিয়টের ‘সুপারম্যান’ হয়ে ওঠা, অথবা হতাশায় নুহ্য হয়ে পড়া স্টেইনের দিকে বাড়ানো এলিয়টের হাত- অনেক টুকরো টুকরো ইতিহাসকে একত্র করে নিউ জিল্যান্ড পৌঁছে গেল স্বপ্নের ফাইনালে, বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো! রাগবির দেশে ম্যাককালামরা তুললেন অদ্ভূত এক ক্রিকেট-সুর!

    এমসিজির ফাইনাল অবশ্য আর কোনো বিজয়-সঙ্গীতের সুর তুলতে দিলো না। তাতে কী! ম্যাককালামকে গিয়ে বলুন, তিনি এখনও বলবেন, সে বিশ্বকাপই ছিল তাঁদের জীবনের ‘সেরা সময়’! ৯ ইনিংসে ১৮৮.৫০ স্ট্রাইক রেটে করা ম্যাককালামের ৩২৮ রান, সঙ্গে ইংল্যান্ডকে গুঁড়িয়ে দেয়া ২৫ বলে ৭৭ আর আফ্রিকাকে কাঁদানো সে ইনিংসগুলিও বলবে, ম্যাককালাম ব্যাট হাতেও এক ‘সেরা সময়’ কাটিয়েছিলেন!  

    ম্যাককালামের সঙ্গে সুর মেলাবেন অনেকেই, নিউ জিল্যান্ডের ক্রিকেট ইতিহাসেই যে বেশ বড়সড় এক অধ্যায়ের নাম ২০১৫ সালের বিশ্বকাপ। ম্যাককালামের ক্রিকেট ক্যারিয়ারেরও তাই। সে ক্যারিয়ারে বাকী রইলো দুইটি টেস্ট, রঙ্গীন পোশাকের ক্যারিয়ারের ইতি টানলেন আজ! শেষবেলায়ও দিয়ে গেলেন ২৭ বলে ৪৭ রানের এক রোমাঞ্চ।

    মিচেল মার্শের আউট হওয়া না হওয়া নিয়ে থাকলো বিতর্কের সুযোগ। তবে সব ছাপিয়ে তা হয়ে উঠলো ম্যাককালামের বিদায়ী ম্যাচ। শেষবার ব্যাটিংয়ে নেমে পেলেন অস্ট্রেলীয়দের ‘গার্ড অব অনার’, শেষবার উঠে গেলেন উইলিয়ামসন, এলিয়ট, গাপটিল, রনকি, অ্যান্ডারসন, হেনরিদের পেছনে নিয়ে। ম্যাককালামের পেছনে থাকলো নিউ জিল্যান্ডের ভবিষ্যত। ম্যাককালাম যখন নিউ জিল্যান্ডের ‘ভবিষ্যত’ হয়ে মাঠে নেমেছিলেন প্রথমবার, সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে, তখন তাঁর সামনে ছিলেন রিচার্ডসন, ম্যাকমিলান, কেয়ার্নস, হ্যারিস, ভেট্টোরি, বন্ডরা। ক্রিকেটটা রক্তেই ছিল ব্রেন্ডনের, বাবা লুইস প্রথম শ্রেনির ক্রিকেট খেলেছিলেন, ভাই ন্যাথানের সঙ্গে ব্রেন্ডনও খেলেছেন অনেকবার।

    শেষ ম্যাচের মতো প্রথম ম্যাচেও উইকেটকিপিং করেননি, তবে শীঘ্রই হাতে তুলেছিলেন গ্লাভস। ব্রেন্ডন তো সবার আগে একজন উইকেটকিপারই ছিলেন! অভিষেকের বছরেই এক ম্যাচে পাঁচ ডিসমিসাল নিয়ে নিউ জিল্যান্ডের রেকর্ড গড়েছিলেন, পাঁচ ডিসমিসাল করেছিলেন পরের ম্যাচেও। পাঁচ ডিসমিসালের উচ্চতা ম্যাককালাম তাঁর ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ছুঁয়েছেন আরও তিনবার। সব মিলিয়ে ২৪২টি ডিসমিসাল তাঁর। ওয়ানডে রেকর্ডের তালিকায় ৬ষ্ঠ। নিউ জিল্যান্ডের তালিকায় প্রথম।

    উইকেটকিপিংয়ে তাও সংক্ষিপ্ত তালিকায় আছেন, ব্যাটিংয়ের ৩০ ছুঁই ছুঁই গড়ে হাজার ছয়েক রান তাঁকে কিংবদন্তি বানাবে না। যদিও নিউ জিল্যান্ডের হয়ে সবচেয়ে বেশী রানের তালিকাই তিনিই তৃতীয়। ৫টি সেঞ্চুরি আছে তাঁর, তিনটিই আবার কানাডা, আয়ারল্যান্ড ও জিম্বাবুয়ের সঙ্গে! প্রথম তিন অঙ্কের দেখা পেতেই তো ম্যাককালাম অপেক্ষা করেছিলেন ১৩৩ ইনিংস! শুধু এ পরিসংখ্যান দিয়েই যদি ম্যাককালামকে বিচার করতে চান কেউ, কিছুটা ভুলই করবেন!

    ম্যাককালামের ব্যাটিংয়ে যে বিনোদন ছিল নিখাদ, শেষবেলায় এসে যা হয়েছিল আরও ব্যাপক! ম্যাককালামের ব্যাটিং ছিল অননুমেয়, তবে একটা বিষয় বোধহয় সবাই অনুমান করে নিতে পারতেন, ম্যাককালাম আক্রমণ করবেন! শন টেইটের ঘন্টায় ১৫০ কিলোমিটার গতির বলকেও তাই তিনি স্কুপ করেছিলেন! ম্যাককালামের যেন গুঁড়িয়ে দিতে চাইতেন সব! যেমন একাই গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশকে, ২০০৭ সালে কুইন্সটাউনে। ৬ ওভার আর ৩১ মিনিটে বাংলাদেশের ৯৩ রান পেরিয়ে গিয়েছিল নিউ জিল্যান্ড, ম্যাককালাম একাই করেছিলেন ২৮ বলে অপরাজিত ৮০, স্ট্রাইক রেট ২৮৫.৭১! সব মিলিয়ে ওয়ানডেতে স্ট্রাইক রেট ছিল ৯৬ এর মতো।

    ক্রিকেটের ক্ষুদ্রতম সংস্করণে তাই ম্যাককালামের রাজত্ব। টি-টোয়েন্টির ইতিহাসে প্রথম ও এখন পর্যন্ত একমাত্র ব্যাটসম্যান হিসেবে ২০০০ রান ছোঁয়া ব্যাটসম্যান তিনি। ১২০ বলের ম্যাচেই একমাত্র ব্যাটসম্যান হিসেবে দুই সেঞ্চুরির কৃতিত্ব তাঁর! ওয়ানডেতে যাই হোন, টি-টোয়েন্টিতে যদি কিংবদন্তির দল করা হয়, ম্যাককালাম শীর্ষের দিকেই থাকবেন!

    ম্যাককালাম শীর্ষে আছেন সফল কিউই অধিনায়কদের চূড়াতেও। ওয়ানডেতে ৬২ ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়ে নিউ জিল্যান্ডকে জিতিয়েছেন ৩৬ ম্যাচে, জয়ের হার ৬১.৮৬ শতাংশ। অথচ ম্যাককালাম যখন নেতৃত্ব পান, নিউ জিল্যান্ডের ক্রিকেটে এক অন্যরকমের অস্বস্তি তখন। রস টেলরকে সরিয়ে দিয়ে তাঁকে দেয়া হলো অধিনায়কত্ব, টেলরকে সরিয়ে দেয়া হলো দক্ষিণ আফ্রিকা সফর থেকেও। সে ম্যাককালামই নিউ জিল্যান্ড ক্রিকেটে এনেছিলেন স্বস্তি। তাদের ক্রিকেট ইতিহাসের এক ‘সেরা সময়’!

    হ্যামিল্টনের সেডন পার্কে ২০০৬-০৭ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে তখনকার সর্বোচ্চ রান তাড়া করার রেকর্ড গড়েছিল নিউজিল্যান্ড। ম্যাককালাম ৮৬ রান করে ছিলেন ইনিংসের শেষ পর্যন্ত। সে সেডন পার্কেই সমাপ্ত হলো আফ্রিকার সঙ্গে সিরিজে শুরু হওয়া অধিনায়কত্বের যাত্রা, সিডনিতে শুরু হওয়া ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ত সংস্করণের যাত্রা।

    শুরু আর শেষের মাঝে থেকে গেলেন আক্রমণাত্মক আর বিনোদনদায়ী এক ব্যাটসম্যান, অসাধারণ এক উইকেটকিপার, মনোমুগ্ধকর এক ফিল্ডার।

    আর হ্যাঁ, অনন্য এক অধিনায়ক।  

    যিনি দর্শকদের এনে দিয়েছিলেন অনেক উচ্ছ্বাসের উপলক্ষ্য। ওয়েলিংটনের সেই শীত বা হ্যামিল্টনের এ গ্রীষ্মের সন্ধ্যায়!