• অন্যান্য খবর
  • " />

     

    সেদিনের এই দিনে: গ্রোসো! গ্রোসো! গ্রোসো!

    সেদিনের এই দিনে: গ্রোসো! গ্রোসো! গ্রোসো!    

    গোল!!! গোল!! গোল!!! গ্রোসো!! গ্রসো!! গোল!!! গোল!! গোল দি গ্রোসো!! গোল দি গ্রোসো!!! মানকা উন মিনুতো!! মানকা উন মিনুতো!!

    ফাবিও কারেসার ধারাভাষ্যটা শুনলে মনে হবে যে কোনো সময় বুঝি তার হৃৎপিন্ডটা ফেটে যাবে। পুরো ইতালি তখন হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত, উলফানস্টাডেনের নীল জার্সি পরা ভক্তেরা বিহবল হয়ে বুঝতে পারছিলেন না কী করবেন। আর বুঝতে পারছিলেন না একজন, গোলটা যিনি করেছেন। মাথা নাড়তে নাড়তে এমনভাবে দৌড়ে গেলেন সাইডলাইনে, যিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না একটু আগে কী করে ফেলেছেন। ইতালিকে নিয়ে গেছেন বিশ্বকাপ ফাইনালে, ১৯৯৪ সালের ঠিক ১২ বছর পর আরেকবার। মার্কো টার্ডেই বা পাওলো রসির ৮২ সালের উদযাপনটা ইতালির ফুটবল পুরাণে ঢুকে গিয়েছিল আগে। আর এই গোল দিয়ে ঢুকে গেলেন গ্রোসো।

    অথচ ২০০৬ বিশ্বকাপ শুরুর আগে ইতালির অনেকেই চিনতেন না গ্রোসোকে। সিরি সি মানে ইতালির তৃতীয় বিভাগ ফুটবল লিগে খেলেছেন কিছুদিন। খেলেছেন দ্বিতীয় বিভাগেও। পালের্মোর হয়ে সিরি আ তে উঠে আসার মৌসুমটা দারুণ খেলেছিলেন। আর তখনই তার ওপর চোখ পড়ে মার্সেলো লিপ্পির। আরও চারজন ক্লাব সতীর্থের সঙ্গে সুযোগ পেয়ে যান দলে। তবে একাদশে তার থাকার কথা ছিল না, অন্তত লিপ্পির প্ল্যান এ তে ছিলেন না কোনোভাবেই।


    কিন্তু ভাগ্যে থাকলে ঠেকায় কে? জিয়ানলুকা জামব্রোত্তার চোটে গ্রুপ পর্বে সুযোগ পেয়ে যান একাদশে। পরে জামব্রোত্তা ফিরেছেন, লেফট ব্যাকে তার জায়গাটা ছেড়ে দেওয়ার কথাই ছিল। কিন্তু রাইট ব্যাকে ক্রিস্টিয়ান জাক্কারদো দুঃস্বপ্নের টুর্নামেন্ট কাটাচ্ছিলেন। গ্রোসো তাই টিকে গেলেন, জামব্রোত্তা চলে এলেন ডান প্রান্তে।  আর সঙ্গে মাতেরাজ্জি আর ক্যানাভারো তো ছিলেনই।

    গ্রোসোর ওপর ইতালির প্রথমবার ভর করা শুরু দ্বিতীয় রাউন্ডে, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পেনাল্টি এনে দিয়েছিলেন দলকে। পেনাল্টিটা বিতর্কিত ছিল, সেটা নিয়ে তুমুল হইচই শুরু হয়ে যায়। কোয়ার্টারে অবশ্য ইউক্রেনকে উড়িয়েই দিয়েছিল ইতালি, সেমিতে প্রতিপক্ষ জার্মানি। ক্লিন্সমানের দলটা সেই বিশ্বকাপে যেন চিরায়ত জার্মান ঘরানা থেকে অনেকখানি বেরিয়ে এসেছিল। প্রথম ম্যাচ থেকেই মন ভরানো ফুটবল খেলতে শুরু করে। তরুণ পোডলস্কির সঙ্গে স্ট্রাইকে ক্লোজা আর ইঞ্জিন হিসেবে ছিলেন মাইকেল বালাক। সেমিতে দুই দলের লড়াইয়ের আগে অবশ্য কয়েকটা ঘটনা ঘটে যায়।

    ইতালির ফুটবলে সেই মৌসুমে পাতানো ম্যাচের অস্থির হাওয়া বইছে। বিশ্বকাপ শুরুর সময়েই চলছিল তদন্ত, সেই বিশ্বকাপেরই ১৩ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। আর ফাইনালে সাত জনকে করা হয়েছে জেরা। বোঝা যাচ্ছিল, বড় একটা ধাক্কা আসছে ইতালির ফুটবলে। সেমিফাইনালের দিন সকালে গুজব ছড়িয়ে পড়ে, জুভেন্টাসের শিরোপা কেড়ে নেওয়া হবে। তাদের নামিয়ে দেওয়া হবে সিরি বি তে। লিপ্পি জানতেন, মাঠের বাইরের অন্য একটা প্রতিপক্ষও আছে তাদের। সেভাবেই প্রস্তুত করলেন দলকে। পরে অবশ্য গুজবটা ঠিক প্রমাণিতই হয়েছিল।


     

    অস্থিরতার সেই বিষবাষ্পের মধ্যেই ম্যাচটা নিয়ে স্নায়ুচাপ শুরু হয়ে যায়। মজার ব্যাপার, সেটার কেন্দ্রে ছিল একটা ভাল্লুক। ইতালি থেকে বিশাল একটা ভাল্লুক জার্মান সীমান্তে গিয়ে হিংস্র হয়ে ওঠে, বেশ কিছু প্রাণিকে আহত করে। শেষ পর্যন্ত বাভারিয়ান শিকারীরা মেরে ফেলে ওই ভাল্লুককে। কিন্তু ব্রুনো নামের ভাল্লুকটা ইতালিতে প্রায় বীর বনে যায়, সেদিন ইতালির বেশ কিছু সমর্থক ছোট ভাল্লুকের পুতুল নিয়ে এসেছিলেন স্টেডিয়ামে। অস্থিরতার একটা বাষ্প ঠিকই জমাট বাঁধছিল।

    মাঠেও যেন সেই হাওয়া ভেসে আসে কিছুটা। নইলে অত কাছ থেকে সিমোনে পেরোত্তা আর  বার্ন্ড স্নাইডার মিস করবেন কেন। বুফনও তার জাত চিনিয়ে দিছচিলেন দারুণ কিছু সেভে। গ্রোসো অবশ্য দ্বিতীয়ার্ধেই নায়ক হয়ে যেতে পারতেন, যদি পিরলোর কাছ থেকে পাওয়া বলটা ঠিকঠাক নিতে পারতেন। তবে আসল নাটক শুরু হয় অতিরিক্ত সময়ে এসে।

    লিপ্পি টনির জায়গায় জিলার্দিনোকে নামিয়েছিলেন আগেই। এবার ইয়াকুইন্তাকে নামালেন কামারোনেসির জায়গায়, পরে দেল পিয়েরো নামলেন পেরোত্তার জায়গায়। কাগজে কলমে মাঠে তখন চার স্ট্রাইকার। পুরো বিশ্বকাপেই তার পাঁচ স্ট্রাইকারকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খেলিয়েছিলেন, কমবেশি অবদানও রেখেছিলেন সবাই। এর মধ্যেই জিলার্দিনোর শট পোস্টে লেগে ফিরে এলো, খানিক পর জামব্রোত্তাও একইভাবে দূর থেকে পোস্টে লাগালেন। ইতালির সমর্থকেরা ভাবল, এবার বুঝি আর হলো না। ওদিকে পোডলস্কি দারুণ একটা সুযোগ পেলেন, কিন্তু ঠেকালেন বুফন। দূর থেকে আচমকা শট করেছিলেন পিরলো, এবার জার্মানির রক্ষাকর্তা লেম্যান। কিন্তু সব নাটক জমা ছিল শেষ কয়েক মিনিটের জন্য।

    কর্নার পেল ইতালি, সেটা থেকে জার্মানি ক্লিয়ার করতে পারল না ঠিকঠাক। বক্সের মাথায় দাঁড়িয়ে ছিলেন পিরলো, বল এসে পড়ল তার পায়ে। মুহূর্তে দেখে নিলেন আশেপাশে কে আছে, চুম্বকের মতো তার দিকে টেনে নিয়ে আসতে দিলেন জার্মানদের। একবার পাস দেওয়ার ভান করে ডামি দিলেন, এরপরেই বলটা ছেড়ে দিলেন। গ্রোসো যেন অপেক্ষা করছিলেন মুহূর্তটার জন্য, বাঁ পায়ে ফার্স্ট টাচেই নিলেন শট। নিখুঁত একটা পরাবৃত্ত রচনা করে সেই শট জড়িয়ে গেল জালে, লেম্যান তা ধরতে পারলেন না। গ্রোসো তখন সম্বিত হারিয়ে ফেলেছেন, বুফন তাকে ধরার জন্য দিয়েছেন জীবনের সেরা দৌড়। লিপ্পি চোখের জল আটকানর চেষ্টা করছেন, নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন খেলোয়াড়দের। আর জার্মানি তখন হতভম্ব শোকে। নিজেদের মাঠে এত বড় ট্র্যাজেডি তারা বোধ হয় আর দেখেনি। সেই গোলের ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই আরেকটি গোল। এবার দারুণ কাউন্টার অ্যাটাক, জিলার্দিনোর পাসে দেল পিয়েরো বল জড়িয়ে দিলেন জালে। জার্মানির উৎসব থামিয়ে ডর্টমুন্ডে ইতালির জয়জয়কার।

    সেই ম্যাচের পর অনেক কিছুই হয়েছে। ফাইনালটা জিতেছে ইতালি অবশ্যই, ক্যানাভারোর হাতে উঠেছে বিশ্বকাপ। এরপর পাতানো ম্যাচের ধাক্কায় ইতালি টালমাটাল হয়েছে, পর পর দুইটি বিশ্বকাপে প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। এর পরের বিশ্বকাপে তো খেলাই হয়নি। গ্রোসোর সেই গোলের স্মৃতিই  এখনও তাই ইতালির সম্বল!