বেল-রেগিয়ন যেভাবে বদলে দিতে পারেন টটেনহামকে
মাউরিসিও পচেত্তিনো ২০১৯-২০ মৌসুম শুরুর আগে ‘বেদনাদায়ক পুনর্নির্মাণে’র কথা বলেছিলেন। গ্যারি লিনেকারের সঙ্গে পচেত্তিনোর এক সাক্ষাৎকারে তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনার ঘর (স্টেডিয়াম) তো ঠিকঠাক নির্মাণ হয়ে গেছে, তবে সেই ঘর সাজানোর মতো পর্যাপ্ত আসবাবপত্র (খেলোয়াড়) কী আছে আপনার কাছে? তার জবাবেই বেদনাদায়ক পুনর্নির্মাণের কথা উঠে এসেছিল। পচেত্তিনোর অধীনে দারুণ কয়েকটি মৌসুম কাটানোর পর টটেনহাম এখন সেই বেদনাদায়ক পুনর্নির্মাণ পর্বে রয়েছে। পচেত্তিনো নেই, খারাপ পারফরম্যান্সের বলি হয়ে গত মৌসুমের অর্ধেকও টিকেননি, তার বদলে স্পার্সে আসা ‘স্পেশাল ওয়ান’ জোসে মরিনহোর অধীনে হচ্ছে সেই পুনর্নির্মাণ। আর সেই পুনর্নির্মাণের অংশ হয়েই টটেনহামে পা রাখতে যাচ্ছেন গ্যারেথ বেল-সার্জিও রেগিয়ন।
দীর্ঘ সময় ধরে পচেত্তিনোর অধীনে খেলা মুসা দেম্বেলে, ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেন, ইয়ান ভার্তুগেনরা একে একে ক্লাব ছেড়েছেন। তাদের জায়গায় এসেছেন জিওভানি লো সেলসো, পিয়ের-এমিল হয়বিয়ের, ম্যাট ডোহার্টিরা।
এভারটনের সঙ্গে হারের পরই বুঝা গিয়েছিল এই টটেনহাম দল একটা জায়গাতেই নিয়মিত মার খেয়ে যাচ্ছে। আর সেটা হচ্ছে আত্মবিশ্বাস এবং মাঠে ভাবভঙ্গি। বেল এবং রেগিয়নের দলে আসাটা খেলোয়াড়দের সেই ভাবভঙ্গি বদলাতে কাজে দিতে পারে। আক্রমণে হ্যারি কেইন, হিউং-মিন সনরা বেলের মতো বিশ্বমানের একজন খেলোয়াড়কে সাথে পেলে মাঠে আরেকটু বেশি কিছু করার তাগিদ বাড়বে। আর লেফটব্যাক পজেশনে বর্তমানে কার্যত মরিনহোর একমাত্র অপশন বেলের স্বদেশী বেন ডেভিস। রেগিয়নের দলে আসার মাধ্যমে সেই পজেশনে প্রতিযোগিতা তৈরি হবে। পচেত্তিনো স্কোয়াডের গভীরতা না থাকাতেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে মার খেয়ে গেছেন। সেই জায়গাতেই এবার মরিনহো ক্লাবের পক্ষ থেকে বেশ সাহায্য পাচ্ছেন।
প্রথমত রেগিয়ন দলে আসলে মরিনহোর খেলার ধরন নিশ্চিতভাবেই বদলে যাবে। কারণ এখন পর্যন্ত চারজনকে রক্ষণে রেখে খেলছেন মরিনহো। ডান পাশে ডোহার্টি খেলেন অনেকটা উইংব্যাকের ভূমিকায়, বাম পাশে ডেভিস ততটা সামনে এগোন না। ডোহার্টি এক দিক দিয়ে অনেকটা উপরে উঠে গেলে নিচে নেমে এসে ব্যাক থ্রি তৈরি করেন ডেভিস। তবে রেগিয়নের ডেভিসের চেয়ে ডোহার্টির সঙ্গে মিল বেশি। আক্রমণাত্মক ফুলব্যাক হিসেবে কাজ করতে পছন্দ করেন তিনি। সেক্ষেত্রে আগামী দিনগুলোতে মরিনহো দুই উইংব্যাক নিয়ে খেলতে পারেন। সেক্ষেত্রে তিন সেন্টারব্যাক ব্যবহার করতে দেখা যেতে পারে মরিনহোকে অথবা দুইজন সেন্টারব্যাক রাখতে পারেন তিনি, সেক্ষেত্রে সিডিএমের দায়িত্ব হবে দুই ফুলব্যাক আক্রমণে উঠলে রক্ষণে দুই সিবির সঙ্গে যোগ দেওয়া।
রেগিয়ন দলে আসলে বাম প্রান্ত দিয়ে টটেনহামের আক্রমণের চেহারাই বদলে যাওয়ার কথা। ডেভিস তার পুরো ১২৯ ম্যাচের প্রিমিয়ার লিগ ক্যারিয়ারে ৪৫ বার ড্রিবল করেছেন, আর রেগিয়ন কেবল লা লিগায় গত মৌসুমেই ড্রিবল করেছেন ৪৯ বার। ফাইনাল থার্ড এবং প্রতিপক্ষের বক্সে পদচারণার দিক দিয়েও রেগিয়ন অনেক এগিয়ে আছে ডেভিস বা রোজের চেয়ে। তারা দুজন মিলে এখন পর্যন্ত ফাইনাল থার্ডে মাত্র ২৩৭ টি পাস খেলেছেন আর প্রতিপক্ষের বক্সে গিয়েছেন ৩১ বার। আর রেগিয়ন গত মৌসুমে ফাইনাল থার্ডে ৩৬৯ টি পাস খেলেছেন সফলভাবে আর ৮২ বার প্রতিপক্ষে বক্সে ঢুকেছেন তিনি।
মাঠের বাম প্রান্তে সনের সঙ্গে রেগিয়নের ভালো বোঝাপড়া গড়ে উঠলে পরের ম্যাচগুলোতে টটেনহামের আক্রমণে ভিন্ন মাত্রা দেখা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সনকেও একেবারে ওয়াইডম্যান হিসেবে নয়, বরং বক্সের আরও কাছাকাছি দেখা যেতে পারে।
আর রিয়াল মাদ্রিদ থেকে সাত বছর পর আবারও নিজের পুরনো ক্লাবে ফিরছেন বেল। এই টটেনহামের হয়েই তার স্বপ্নযাত্রা শুরু হয়েছিল। ছয় মৌসুম হোয়াইট হার্ট লেন মাতানোর পর বিশ্বরেকর্ড ফি দিয়ে তাকে দলে টানে মাদ্রিদ। মাদ্রিদের হয়ে সম্ভাব্য সবকিছুই জিতেছেন, তবে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে জিদানের অধীনে শেষ কয়েক মৌসুম ভালো কাটেনি তার। বেশিরভাগ সময় বেঞ্চে বসেই কেটেছে তার। দীর্ঘদিন নিয়মিত খেলার বাইরে থাকা বেল তাই টটেনহামে এসেই কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারবেন সেটা একটা প্রশ্ন। এছাড়া গত কয়েক মৌসুমে চোট সমস্যায় জর্জরিত বেল টটেনহাম আসছেনও চোট নিয়ে। পূর্ণ ফিট অবস্থায় টটেনহামের হয়ে মাঠে নামতে তার আরও মাসখানেক প্রয়োজন।
যদিও রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে নিয়মিত না খেললেও আন্তর্জাতিক বিরতিতে ওয়েলসের হয়ে কিন্তু ঠিকই আলো ছড়িয়েছেন বেল। গত দুই বছরে ওয়েলসের হয়ে ১৫ ম্যাচ খেলে ৭ গোল করেছেন, বেশ কয়েকটি গোলে অবদানও রেখেছেন। কেইন, সন এবং ফিট বেলের আক্রমণভাগ প্রিমিয়ার লিগের যেকোনো প্রতিপক্ষের মনেই ভয় তৈরি করবে। শেফিল্ড কোচ ক্রিস ওয়াইল্ডার তো বেল আসার আগেই মজা করে বললেন, মাদ্রিদে অনেক ভালো গলফ কোর্স আছে, সেখানেই থাকো। আমাদের জন্য সমস্যা তৈরি করো না।
ফিট থাকতে পারলে নির্দ্বিধায় বেল টটেনহামের আক্রমণভাগকে অনেক শক্তিশালী করবে। বয়স এবং চোটের কারণ আগের মতো তিনি গতির ঝড় হয়ত ততটা তুলতে পারবেন না। তবে তার জাদুকরী বাম পা এখনো যথেষ্ট কার্যকরী। এরিকসেন যাওয়ার পর ফ্রি-কিক থেকে গোল করতে প্রায় ভুলে গেছে টটেনহাম, বেলের আগমনে তাদের ফ্রি-কিকগুলোও আরও কার্যকর হয়ে উঠতে পারে। আর দূর থেকে নিখুঁত শটে লক্ষ্যভেদ করার ক্ষেত্রে তো বেলের মুন্সিয়ানা রয়েছেই। সর্বোপরি, বেলের মতো টটেনহাম অন্তপ্রাণ এবং বিশ্বসেরা একজন খেলোয়াড়কে দলে পেলে স্কোয়াডের অন্যদের ভঙ্গুর আত্মবিশ্বাসেও কিছুটা উন্নতির ছাপ দেখা যেতে পারে।
পচেত্তিনোর অধীনে টানা চার মৌসুম চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলেছে টটেনহাম, ২০১৮-১৯ মৌসুমে তো ফাইনাল পর্যন্ত গিয়েছে। অথচ তার প্রস্থানের মৌসুমেই টটেনহাম আর চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলা নিশ্চিত করতে পারেনি। স্টেডিয়ামসহ ক্লাবের বিভিন্ন আধুনিক স্থাপনায় কাড়ি কাড়ি অর্থ ব্যয় করা টটেনহামের বোর্ড কোনোভাবেই চ্যাম্পিয়নস লিগ ফুটবল ছাড়া থাকতে চায় না। চ্যাম্পিয়নস লিগ ফুটবল না থাকলে ক্লাবের ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি হবে সেজন্য। আর তাই এবার দলবদলের বাজারে টটেনহামের চিরাচরিত ধারার বিপরীতে গিয়ে কোচ মরিনহোকে চেয়ারম্যান ড্যানিয়েল লেভি যথাসম্ভব সমর্থন দিচ্ছেন। দলের সব দুর্বল পজেশনগুলোতে নতুন, নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড় নিয়ে আসা হচ্ছে। বেল-রেগিলনকে আনার পরেও একজন ব্যাকআপ স্ট্রাইকার এবং সেন্টারব্যাকও আনা হবে বলে শোনা যাচ্ছে। বল এবার ‘স্পেশাল ওয়ানে’র কোর্টে।