• " />

     

    হারিয়ে যাওয়া তারা

    হারিয়ে যাওয়া তারা    

    রুহুল আমিন তখন খেলাঘর সমাজকল্যাণ সংঘের কোচ। সারা দেশ চষে বেড়ান, স্কুল ক্রিকেটের খেলা দেখেন, ক্রিকেটার তুলে আনেন। কুষ্টিয়ায় সেবার এমনই একজনকে পেলেন। ৯২ রান করেছিল সে ক্রিকেটার। রুহুল ছুটে গেলেন সে ক্রিকেটারের বাড়িতে, খুলনা। কিন্তু অভিভাবকদের বোঝাতে বেশ বিপত্তি পেতে হলো তাঁর! অবশেষে রাজি হলেন তাঁরা, একটা শর্ত জুড়ে দিয়ে রাজি হলেন ছেলেকে ঢাকা পাঠাতে। তাঁদেরই পাড়ার এক পুত্রতুল্য ছেলে, সেই ক্রিকেটারের বন্ধুকে সঙ্গে পাঠাবেন।

     

    ঢাকায় এসে সে বন্ধু প্রতিদিন খেলাঘরে এসে বসে থাকে। প্র্যাকটিস দেখে। রুহুল একদিন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি খেলো না?’ সে জবাব দিল, ‘খেলি। আমি বাঁ হাতে স্পিন করি।‘

     

    মানজারুল ইসলাম রানার এরপর নেটে স্পিন করা, রুহুল আমিনের চোখে লেগে যাওয়া সে বোলিং। ক্রিকেট বোর্ডে গিয়ে রেজিস্ট্রেশন করিয়ে আনলেন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। খেলাঘর এরপর রুপালি ব্যাংককে হারিয়ে দ্বিতীয় বিভাগের সুপার লিগে উঠে গেল, রানা নিলেন ৫ উইকেট, সঙ্গে ৫৩ রান। খেলাঘর উঠলো প্রথম বিভাগে, রানার কল্যাণে সেখানেও খেলাঘর খেললো বেশ! খেলাঘর থেকে কলাবাগান, আবাহনী, ভিক্টোরিয়া। তারপর লাল সবুজ। ডেভ হোয়াটমোরের 'আস্থাভাজন' শিষ্য হয়ে ওঠা।

     

    মোহাম্মদ রফিকের চোট রানাকে সুযোগ করে দিয়েছিল ওয়ানডে অভিষেকের, ২০০৩ সালে ইংল্যান্ডের সঙ্গে। এরপর প্রথম টেস্ট খেলেছিলেন ২০০৪ সালে, জিম্বাবুয়ের সঙ্গে।

     

    প্রথম যেবার বাংলাদেশ ওয়ানডে সিরিজ জিতলো, বাংলাদেশ প্রথম দুই ওয়ানডেতেই হেরে পিছিয়ে ছিল। রানা পরপর দুইবার ম্যাচসেরা হলেন, বাংলাদেশ ফিরে এলো সিরিজে। শেষ ম্যাচে আলো কেড়ে নিলেন মোহাম্মদ রফিক, তবে তাঁর সঙ্গে রানার স্পিন বোলিংয়ের জুটিটা গড়ে ওঠার হাতছানি দিচ্ছিলো ঠিকই! সময় কেটে গেল, রানার ফর্মটা বিগড়ে গেল একসময়। কেনিয়ার সঙ্গে ২০০৬ সালের সিরিজের পর বাদ পড়লেন দল থেকে। খারাপ সময় আসবে, চলে যাবে, রানা দল থেকে বাদ পড়বেন, ফিরে আসবেন, হওয়ার কথা ছিল তো এমনই! হলো না। সবকিছু নিয়ম মানে না। সবাই কথা রাখে না।

     

    ১৬ মার্চ ২০০৭, মানজারুল ইসলাম রানা থাকতে পারতেন আরও দুইটি ভিন্ন জায়গায়। জাতীয় দলের হয়ে ক্যারিবীয় বিশ্বকাপে অথবা 'এ' দলের হয়ে শ্রীলংকা সফরে। দুই সফরের একটিতেও যাওয়া হয়নি। রানা সেদিন ছিলেন খুলনায়।

     

    ১১ তারিখে বাংলাদেশ ‘এ’ দলের হয়ে খেলেন ইংল্যান্ড ‘এ’ দলের সঙ্গে। ১২ তারিখ থেকে শুরু হওয়া সেই মৌসুমে জাতীয় লিগে খুলনার শেষ ম্যাচে নেতৃত্ব দেন দলকে, ফতুল্লায়, নেন ৯ উইকেট। রানার সঙ্গে ছিলেন সাজ্জাদুল হাসান সেতুও। খুলনার সতীর্থ হিসেবে। ১৫ তারিখে ম্যাচ শেষ হয়, তাঁরা খুলনা যান। ১৬ তারিখে একটা স্থানীয় ম্যাচে খেলেন, রানা হন ম্যাচসেরা।

     

    ম্যাচশেষ, বাড়ি ফিরবেন। সতীর্থ আরেক ক্রিকেটার জাতীয় দলের সাবেক উইকেটকিপার মোহাম্মদ সেলিম বললেন, আব্বাসের হোটেল থেকে খেয়ে আসতে। বিখ্যাত আব্বাসের হোটেল, বিখ্যাত তার খাসির মাংস। রানা ও সেতু, দুইজন শুরুতে দুই বাইকে ছিলেন। মাঝপথে রানা সেতুকে নিজের বাইকে তুলে নেন।

     

    রাস্তায় নিয়ন্ত্রন হারান এরপর, মাইক্রোবাসের সঙ্গে প্রথম সংঘর্ষ, তারপর ইলেক্ট্রিক পোলের সঙ্গে। তারপর সব শেষ! রানার ৬ টেস্ট আর ২৬ ওয়ানডের ক্যারিয়ার শেষ। ঢাকাতে খেলতে আসা অনেক অনেক ক্রিকেটারের অনেক বড় অবলম্বন ‘রানা ভাই’ শেষ। বাংলাদেশের পরবর্তী মোহাম্মদ রফিক শেষ। মাশরাফির অনেক ভাল বন্ধু শেষ। আমিনুল ইসলাম বুলবুলের এক ছোট ভাই শেষ। ৯৬ নম্বর ওয়ানডে জার্সিটা তখন স্মৃতি।

     

    আর পরিবারের অবলম্বন সেতু শেষ। একটা সম্ভাবনা জাগানো ক্যারিয়ার শেষ।

     

    রানার মৃত্যুর খবর পৌঁছালো ক্যারিবীয়তে। পরদিন বাংলাদেশের ম্যাচ ভারতের সঙ্গে। ‘শোককে শক্তিতে পরিণত করা’, কথাটা ক্লিশে। তবে রানা যেন সেদিনও ছিলেন, পোর্ট অব স্পেনে। হাবিবুল-মাশরাফির আবেগের সঙ্গে মিশে। বিশ্বকাপ যাওয়ার আগে হাবিবুলকে নাকি রানা বলেছিলেন, ‘সুমন ভাই, একটা ম্যাচ হলেও জেতা চাই!’

     

    সুমনরা জিতেছিলেন। রানার জন্যই তো! আর রানা যাওয়ার আগে বাংলাদেশকে একটা ‘রেকর্ড’ দিয়ে গেছেন। সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত সময় বেঁচে থাকা টেস্ট ক্রিকেটার তো এখনও তিনিই! ‘রেকর্ড’ কত কঠিন মাঝে মাঝে!

     

    আরেকটা ১৬ মার্চ। রানা-সেতু চলে যাওয়ার নয় বছর পেরিয়ে গেল কত দ্রুতই! বাংলাদেশের ক্রিকেট কতকিছু দেখলো এর মাঝে! তাঁরা দুইজন কি দেখলেন? দেখছেন কি?

     

    দেখলে হয়তো মার্টিন ক্রোকে বলছেন, ‘দেখুন, আমাদের ক্রিকেটের সেরা সময়টাও দেখুন!’