• " />

     

    ভালোবাসা-ঘৃণার দোলাচলে আমির মুগ্ধতা দর্শন

    ভালোবাসা-ঘৃণার দোলাচলে আমির মুগ্ধতা দর্শন    

    ১.
    বিপিএল ২০১৫। ৩১ বলে ৪৪ রানে মুশফিক আছেন ক্রিজে। শেষ ওভারে ৯ রান আটকাতে এলেন মোহাম্মদ আমির। আমিরের ইয়র্কারে মুশফিকের স্কুপে বল গেল শর্ট ফাইন লেগের হাতে এক বাউন্সে। মুশফিক সিঙ্গেল নিলেন, আমিরের বাউন্সার ও ইয়র্কারে পরের দুই বল অজান্তা মেন্ডিস ডট দেওয়াতে প্রশ্নবানের মুখে পড়লো তাঁর এ সিদ্ধান্ত। ৩ বলে ৮ রান, যেকোনও উপায়েই মুশফিকের স্ট্রাইক পাওয়া চাই, কিপারের হাতে বল থাকা সত্ত্বেও মুশফিকের সাহসী দৌড়ে তা সম্ভব হলো। পরের বলে স্টাম্প ছেড়ে কাভার দিয়ে মুশফিক চার মেরে সমীকরণ নিয়ে এলেন শেষ বলে তিনে। শেষ বলে পারফেক্ট ইয়র্কারে আমির সিঙ্গেলের বেশি কিছু তাকে নিতে দিলেন না।

    চিটাগং ভাইকিংসের ফ্যান হোন কিংবা না, আপনি মনের অজান্তেই সেদিন আমিরকে ভালোবাসতে শুরু করেন। তখনই আপনার মনে এসে উঁকি দেয় সে ‘কলঙ্কিত অধ্যায়’। আপনি পড়ে যান দোটানায়। ভালোবাসবেন না ঘৃণা করবেন?  

    ২.
    এমন ব্যাটিং উইকেট আমির ইংল্যান্ডে কখনো দেখেননি। ফাইনাল ইংল্যান্ডে, ফাইনালে ভারত-পাকিস্তান। বিরাট কোহলি চ্যালেঞ্জ ভালোবাসেন, আমিরও। ৩৩৮ রান করেও ভারতের ত্রাসত্রয়ী রোহিত-ধাওয়ান-কোহলির কারণে তা সুরক্ষিত না। তবে দায়িত্বটা যেন স্বেচ্ছায় নিজ কাঁধে তুলে নিলেন মোহাম্মদ আমির। আমির কিভাবে পারলেন এ তিনজনকে ফেরাতে? আপনার বিস্ময়ের ঘোর কাটে না।  

    বার্মিংহামে আমির রোহিতকে ইনসুইং করাতে থাকলেন প্রথম ওভারে, রোহিতও তাঁর দুর্বলতার জায়গায় পরাস্ত হলেন বারবার। এদিন আমির তার স্টান্স দেখে বুঝলেন, রোহিত প্রস্তুত ইনসুইংগারের জন্য। আমির সিদ্ধান্ত নিলেন, প্রথম দুইটা সুইং করে বাইরে বের করাবেন, পরে ইনসুইং করবেন। চিন্তামতো মাঠেও ঘটালেন সবকিছু, তৃতীয় বলের ওই ইনসুইংয়ে পরাস্ত হয়ে এলবিডব্লিউ হলেন রোহিত শর্মা। 

     

     

    আমির সিদ্ধান্ত নিলেন, ভিতরে ঢুকাবেন না বল। বিরাট প্রস্তুত ছিলেন ইনসুইংয়ের জন্য, আমির তাকে দেখে সেটা বুঝলেন। এঙ্গেলে যে বলগুলো বের হয়ে যায়, সেগুলোতে কিছুটা ভুগেন সেটাও ছিল মাথায়। পরের ওভারে বাইরেই বল করতে থাকলেন, তৃতীয় ওভারের তৃতীয় বলে উঠলো ক্যাচ স্লিপে, আজহার ক্যাচ মিস করলেন। আমির রান আপে যাচ্ছেন আর ভাবছেন- এই বুঝি ম্যাচ গেলো! না জানি ফখর কান্ড হয়ে যায়। ফখরের ক্যাচ সেদিন ধোনির তালুবন্দী হয়েছিল ঠিকই, কিন্ত বুমরার সে বল ছিল নো বল। ৩ রানে জীবন পেয়ে পরে ফখর থেমেছেন ১১৪ করে। চেজে বিরাট সবচে সফল, সেই বিরাটের ক্যাচ প্রথম স্লিপে মিস। জীবন পেয়ে না জানি বিরাটও সেঞ্চুরি করে ফেলেন! তা হলে তো পাকিস্তানের জয়ের সম্ভাবনাও হয়ে যাবে হাওয়া। যখনই বোলিং মার্কে পৌছলেন আমির, তখন ধারণা করলেন কোহলি ভেতরে ঢুকা বলের জন্য প্রস্তুত, আমির সিদ্ধান্ত নিলেন বাইরেই করবেন, তবে আরেকটু সামনে। যেমন চিন্তা, তেমন প্রয়োগ। কোহলি জীবন পেয়ে পরের বলেই জীবন হারালেন শাদাবের হাতে পয়েন্টে ক্যাচ দিয়ে। খানিক বাদে আমিরের বলে কিপারের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফিরলেন ৩৩৮ রান করা টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ স্কোরার শিখর ধাওয়ানও।

    আমিরের বুদ্ধিমত্তায়, পরিকল্পনায় আপনি মুগ্ধ হন। সে মুগ্ধতার আবেশে তাঁর ভালোবাসায় আবিষ্ট হয়ে যান আপনি। আবারও পড়ে যান দোটানায়। তখনই যে আপনার সামনে প্রকট হয় ওই ‘কলঙ্কিত অধ্যায়’, মুছে দিতে চায় ক্ষণিকের সে ভালোলাগা, ভুলিয়ে দিতে চায় আমির-মুগ্ধতা। ভালোবাসবেন না ঘৃণা করবেন? এ গ্যাঁড়াকল থেকে আপনি বেরুতে পারেননা সহজে।

    ৩.
    না পারেন ভালোবাসতে, না পারেন ঘৃণা করতে। ভালোবাসেন না, ঘৃণাও করেন না, এমনটাও হয় না। আর এভাবেই ভালোবাসা-ঘৃণার দোলাচলেই কাটছে আপনার আমির মুগ্ধতা দর্শনকাল। আপনি আমিরকে খোলামেলা ভালোবাসতে পারেন না। এর কারণ যে ‘কলঙ্কিত অধ্যায়’, সেটি আপনি জানতে চান। কোনও একদিন আমিরের মুখ থেকেই শুনতে পেলেন তা। বীভৎস ফিক্সিংয়ের জগতে আমিরের পা দেয়ার গল্প।

    প্রভাত দিনের পুর্বাভাস দেয়। সেদিনের প্রভাত আভাস দিয়েছিল দুর ভবিষ্যতেরও। অধুনা বিলুপ্ত নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড ট্যাবলয়েডের একটি খবরে সেদিন ছারখার হয়ে গিয়েছিলো কোটি ভক্তের হৃদয়।  তাদের বিশ্বাসের সঙ্গে ছিনিমিনি খেলে, প্রতারণা করে তাদের ‘হিরো’রা সেদিন পরিণত হন ভিলেনে। তাদের সঙ্গে সঙ্গে সে খবরে মাথায় যেন বাজ পড়ে সেই ‘হিরো’দেরও। লর্ডসের সোনালী ইতিহাসে সেদিন ঢুকে পড়ে এক ‘কলঙ্কিত অধ্যায়’।

    ম্যান অব দ্যা সিরিজের পুরস্কার আনতে আমিরকে যেতে হবে লর্ডসের লংরুমে, সেখানেই আয়োজন প্রেজেন্টেশনের। এ আমি কি করলাম! লজ্জা, অনুশোচনায় বিধ্বস্ত আমির যেতে চাইছেন না নিচে। সিকিউরিটি অফিসারের আশ্বাসে শেষে নিচে নামার সাহস করলেন তিনি। সবার দৃষ্টি তাঁর দিকে, সেটা সুনজর হওয়ার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণই। সকলের এমন চাহনি দেখে তখন আমিরের মনে পড়লো- কোথায় ছিলেন আর আজ তিনি কোথায়। আকাশ থেকে আমির পড়লেন মাটিতে।

     

     

    ২০১০ সালের ২৯ আগস্টের আগে আমির দূর আকাশের তারাই ছিলেন। নিষিদ্ধ হওয়ার আগে তিন ফরম্যাট মিলিয়ে ৬০ ইনিংসে নিয়েছেন ৯৯ উইকেট। টেস্টে সবচেয়ে কমবয়সী হিসেবে ৫০ উইকেট নেয়ার রেকর্ড গড়েছেন। টেস্টে ২৭ ইনিংসে ৫১ উইকেটের পর তাঁর ক্যারিয়ার গেছে অনাকাঙ্খিত বিরতিতে। ৩ বারের পাঁচ উইকেটের মাইলফলকের একটি লর্ডসে, অনার্স বোর্ডে লেখা হয়ে গেছে তাঁর নাম, সেখানে তিনি সর্বকনিষ্ঠ। সাদা বলের ক্রিকেটে নিষিদ্ধ হওয়ার পূর্বে ৩৩ ম্যাচে নিয়েছেন ৪৮ উইকেট। টি-টোয়েন্টিতে প্রায় ৭ ইকোনমিতে ১৮ ম্যাচে শিকার ২৩ উইকেট, টি-টোয়েন্টিতে বিশ্বকাপও জেতা হয়েছে ততদিনে।

    ৪.
    পাকিস্তানের ইংল্যান্ড সফর। ২০১০ সাল। 

    সে সফরে দুবার আমিরকে ফিক্সিংয়ের এপ্রোচ করলেন তাঁর অধিনায়ক সালমান বাট। প্রথমবার আমির হেসে উড়িয়ে দিলেন। পরেরবার বলেছেন, এসব অন্যায়, হারাম কাজে তিনি নেই। 

    আলি, একজন ব্যবসায়ী, সালমানের বন্ধু হিসেবে আমিরের সঙ্গে পরিচয়। লর্ডসের আগের টেস্টে আলির সাথে আমিরের কিছু মেসেজ চালাচালি হয়েছিল। আলি একটা সময় তাঁর ব্যাংক একাউন্ট নাম্বার জানতে চাইলেন, হোটেলের লবিতে বসে বিরক্ত আমির কৌতুহলবশত দিয়ে দিলেন সেটা। কৌতুহলের ব্যাপার‍টা ধরতে হলে আমিরের ১৯ বছর বয়সটা অবশ্যই খেয়ালে রাখতে হবে।

    লর্ডস টেস্টের আগেরদিন আমিরের এজেন্ট মাজহার মজিদ তাকে ডাকলেন। আলির সঙ্গে তাঁর ওই মেসেজ চালাচালি ও কলের কথাগুলো চলে গেছে আইসিসির হাতে, তাই তিনি বিপদে। আমির কিছুই করেননি আলীর জন্য, কোনও টাকাও নেননি। তবু তিনি বিপদে, মেনে নিলেন মাজহারের কথায়। 'সাজানো' এ বিপদ থেকে উদ্ধারের পথও আমির জানতে চাইলেন মাজহারেরই কাছে। মাজহার আশ্বাস দিলেন, কেস গেছে তার বন্ধুর হাতে, তিনি সব ম্যানেজ করবেন। সেজন্য একটা ফেভার করতে হবে আমিরের, করতে হবে দুটো নো বল। 'বোকা' আমির বিপদে পড়েছেন ভেবে সেটা করতে প্রথমে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগে পরে যে করেছেন সেটা তো বিশ্ব জানে। মাঝখানে আমিরকে বলে দেয়া অনুযায়ী তৃতীয় ওভারের প্রথম বল ও ১৯তম ওভারের তৃতীয় বল হবে নো-বল, সে তথ্য মাজহার এক ব্যবসায়ীকে দেয়ার বিনিময়ে বুঝে নিলেন ১ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড, আমির তা জানেন না। ওই ব্যবসায়ী যে নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ডের স্টিং অপারেশন চালাচ্ছেন ব্যবসায়ীর মুখোশ পরে, মাজহার তা জানেন না।

    আব্দুর রাজ্জাক সে সফরের আগে থেকেই বুঝতে পারলেন গড়বড়, সালমান বাটের ব্যাটিংয়ে। রাজ্জাক আফ্রিদিকে সেটা জানালে আফ্রিদি প্রথম বিশ্বাস না করে উড়িয়ে দিলেন। একদিন মাজহারের মোবাইল নষ্ট হয়ে গেলো, মাজহার যে দোকানে তা ঠিক করতে দিলেন সে দোকানের মালিক রাজ্জাকেরই বন্ধু। ওই দোকানী মোবাইল ঠিক করে অন করতেই দেখতে পেলেন মাজহার ও সালমানের 'ফিক্সিং' সংক্রান্ত মেসেজ চালাচালি। জানালেন আব্দুর রাজ্জাককে, রাজ্জাক তা জানালেন আফ্রিদিকে। এরপর ওই দোকানীর আরেক বন্ধুর কাছ থেকে সেটা জেনে যায় নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড, লেগে যায় তারা স্টিং অপারেশনে। 

    ৫.
    আজ মাজহারের খুশির দিন৷ আমির তার কথামতো নো-বল করেছেন। মাজহার খুশি হয়ে তাই আমিরকে ১৫০০ ডলার দিতে চাইলেন। নিতে না চেয়েও মাজহারের জোরজবরদস্তিতে তা নিয়ে অবশ্য আমির তাঁর একটি কড়িও ব্যবহার করেননি। এরপর এলো সেই সকাল, বেরিয়ে এলো সে খবর। আমির শুরুতে কিছু বুঝে উঠতে না পেরে ভুল স্বীকার করেননি, দু মাস পরে তা করেছেন। ৫ বছরের নিষেধাজ্ঞার সাথে ৬ মাসের জেলের সাজা, বিশেষ বিবেচনায় তিন মাসই অবশ্য তাকে জেলে থাকতে হয়েছে।

     

    তারা চারজন। সালমান বাট, মোহাম্মদ আসিফ, মাজহার মাজিদ, মোহাম্মদ আমির।

     

    ভুলতে চাওয়া সে অধ্যায়ে আমির পা দেন যখন, তার বয়স তখন উনিশ। আর এ বয়সের কথা বিবেচনায়, ভুল বুঝতে পেরে বারবার ভুল স্বীকার করে মাফ চাওয়া বিবেচনায় অনেকেই তাকে ভালো না বাসলেও অন্তত ঘৃণা করেন না। কিংবা ঠিক সে পরিমাণ ঘৃণা করেন না, যেমনটা ফিক্সারের ক্ষেত্রে করা উচিত বা করেন। 

    ইমরান খান, ওয়াসিম আকরাম, শহিদ আফ্রদিরাও তাকে দূরে ঠেলে দেননা,  বয়স ও ভুল বুঝতে পারা বিবেচনায়। দূর ইংল্যান্ডে বসবাস করা মাইকেল আথারটনও তাঁর পাশে দাড়ান। ঘটনার সময়েই মাইকেল হোল্ডিং বুঝতে পারেন, কেউ একজন পিছনে কলকাঠিটা নাড়ছে। ভালো সময়ে, খারাপ সময়ে, একজনের সমর্থন তো তিনি পেয়েই আসছেন। তাকে গড়ে তুলার কারিগর, আসিফ বাজওয়া। জেল থেকে বের হবার পরেই যিনি কল করে বলেছেন, ছাদে নেট লাগিয়েছি বোলিং প্র্যাকটিসের জন্যে। 

    লর্ডসের ওই আমিরের বয়সী হোন অথবা না, আপনি নিজেকে সে বয়সের ভেবেই কল্পনা করেন, আমিরের জায়গা থেকে বুঝার চেষ্টা করেন। তাতে ঘৃণার পরিমাণটা একটু হলেও কমে হয়তো। হয়তো ঘৃণা-ভালোবাসার দোলাচল থেকে কিছুটা বেরুতেও পারেন আপনি। কিংবা পারেন না। সালমান যে আমিরের কথা অস্বীকার করেন। তাই আপনি বুঝে যান, এ দোলাচল থেকে বেরুবার কোনও পথ আপনার জানা নেই। কাটিয়ে দিতে হবে আমির দর্শনকাল এভাবেই।