যে তারারা থাকতে পারতেন- পর্ব ১
চোখ বন্ধ করে একবার ভাবুন তো; বাঁ প্রান্ত থেকে ভ্যান ডার ভার্ট পাস বাড়ালেন স্নাইডারের দিকে। স্নাইডার ডান প্রান্তে থ্রু দিলেন সুয়ারেজকে। দু’জন ডিফেন্ডারকে বোকা বানিয়ে একটা চিপ করলেন তিনি। আচমকা পুরো শরীর হাওয়ায় ভাসিয়ে ডানপায়ের অসাধারণ সিজার-কিকে বল জালে জড়ালেন ইব্রাহিমোভিচ। ভাবছেন, কোনো ফিফা গেমে করা গোলের কথা বললাম? শুনে অবাক লাগতে পারে, তবে হল্যান্ডের সবচেয়ে বড় ক্লাব আয়াক্স আমস্টারডাম যদি তাদের সেরা খেলোয়াড়দের বিক্রি না করতো, তাহলে এমন কিছু হতেই পারত!
সবচেয়ে ফুটবলারপ্রসূ একাডেমিগুলোর একটি হিসেবে আয়াক্সের নাম শুরুর দিকেই থাকবে। যে একাডেমি ফুটবলকে ভ্যান ডার সার, ফ্র্যাংক ডি বোর, রোনাল্ড ডি বোর, বার্গক্যাম্প, ডেভিডস, ক্রুইফ, সিডর্ফ, স্নাইডার, রাইকার্ড, ওভারমার্স, ভ্যান বাস্তেনের মত কিংবদন্তী উপহার দিয়েছে, তাদের আসলে থাকারই কথা। সেই বার্গক্যাম্প, ভ্যান বাস্তেন থেকে শুরু করে হালের এরিকসেন, এল ঘাজী-আয়াক্স এখনো ফুটবলকে প্রতিশ্রুতিশীল প্লেয়ার উপহার দিয়ে যাচ্ছে।গত এক যুগে যদি আয়াক্স প্রতিশ্রুতিশীল অনেককে বিক্রি না করত, তাহলে তাদের দলটা হতো যে কারও জন্যই বড় একটা হুমকি।
গোলরক্ষকের কথাই ধরা যাক। ২০১০ বিশ্বকাপে সবাইকে চমকে দিয়ে ফাইনালে ওঠে হল্যান্ড। স্নাইডার, ভ্যান পার্সি, রবেনদের নিয়ে আলোচনাটা স্বাভাবিকভাবেই বেশী থাকলেও নীরবে নিজেদের কাজটা ঠিকই অসাধারণ দক্ষতার সাথে করে গেছেন গোলকিপার মার্টিন স্টেকেলেনবার্গ ও গ্রেগরি ভ্যান ডার ভিল। দীর্ঘদেহী স্টেকেলেনবার্গ সেই ’৯৭-এ আয়াক্সে আসার পর প্রথম তিন মৌসুম ভ্যান ডার সারের ছায়ায় থাকলেও যে কয়টি ম্যাচ খেলেছিলেন, তাতেই নিজের সামর্থ্যের জানান দিয়েছেন। তাই ভ্যান ডার সার জুভেন্টাসে যাওয়ার পর পরই মাত্র ১৮ বছরের তরুণ স্টেকেলেনবার্গকে স্থায়ীভাবে ‘নাম্বার ওয়ান’ গোলকিপারের দায়িত্ব অর্পণ করে আয়াক্স। ‘১০ বিশ্বকাপের পর আঙ্গুল ভেঙ্গে যাওয়ায় এবং ফিরে আসার পর ফর্মহীনতায় ভোগায় বহু বছর পর পাকাপাকিভাবে আয়াক্সের মূল গোলকিপারের দায়িত্ব হারান তিনি। এরপর রোমা কিনে নেয় তাকে। বর্তমানে সিলিসেন তাঁর অভাব তেমন বুঝতে দিচ্ছেন না। তবে তাঁর আগে স্টেকেলেনবার্গকে ভালোই মিস করেছে আয়াক্স।
ভ্যান ডার ভিলের অভাবটাও আয়াক্সের টের পাওয়ার কথা।আয়াক্সের একাডেমির এই রাইটব্যাক ১৯৯৬ থেকে ২০০২ থেকে ছিলেন ক্লাবে।এরপর ধারে বেশকিছু ক্লাবে খেললেও ’০৫-এ আয়াক্সে ফেরত আসেন তিনি। ’১২ পর্যন্ত দলের প্রথম সারির খেলোয়াড়দের একজন ছিলেন । ’১০-এ ডাচলিগের সেরা তরুণ খেলোয়াড় হয়েছিলেন। কিন্তু পেট্রোডলারে পুষ্ট পিএসজির চোখ পড়ে তাঁর ওপর। ভ্যান ডার ভিলের গতি এবং রক্ষণে নির্ভরতার অভাব এখনো ভোগ করে আয়াক্স।
রক্ষণে শুধু ভ্যান ডার ভিল নয়, অলারওয়েরেল্ড ও ভার্টনগেনও আয়াক্সের বড় ভরসা হয়ে ছিলেন। থমাস ভারমাইলেনকে আর্সেনাল কিনে নেওয়ার পরে তিন মৌসুম আয়াক্সের সেন্ট্রাল ডিফেন্স সামাল দিয়েছেন অল্ডারওয়েরেল্ড ও ভার্টনগেন। এই তিন মৌসুমের প্রতিটিতে ডাচলিগের ‘টীম অফ দ্যা সীজন’-এর ডিফেন্স জুটি ছিলেন তারা। ’১২ তে ভার্টনগেনকে এবং ’১৫ তে অল্ডারওয়েরেল্ডকে কিনে নেয় স্পার্স।
বড় ক্লাবের কাছে আয়াক্সের বিক্রি করতে বাধ্য হওয়া আরেক ডিফেন্ডার হলেন ব্রাজিলিয়ান ম্যাক্সওয়েল। ব্রাজিলের ক্রুজেইরো থেকে ইউরোপে ম্যাক্সওয়েলের প্রথম ক্লাব ছিল আয়াক্স। পাঁচ বছর ছিলেন এই ক্লাবে। লেফটব্যাক হয়েও ’০৪-এ ডাচলিগের সেরা ফুটবলার হন। স্বাভাবিকভাবেই এরপর বড় ক্লাবের লোলুপ নজরে পড়লেন তিনি এবং অতঃপর ইন্টার মিলান কিনে নেয় তাঁকে।
বার্গক্যাম্প, ভ্যান বাস্তেনদের পর আয়াক্স হারিয়েছে এরিকসেন, ব্লিন্ড, ভ্যান ডার ভার্ট, ডি ইয়ং, স্নাইডারদের মত বর্তমান যুগের অন্যতম সেরা কিছু মিডফিল্ডারদের। বাবার পথ অনুসরণ করে যুবদলে খেলার পর মূল দলেও নিজের জায়গা পাকা করেছিলেন ‘জুনিয়র’ ব্লিন্ড। ডিফেন্স ও মিডফিল্ডের যেকোনো পজিশনে ভাল খেলতে পারার ফলে অচিরেই আয়াক্স ফ্যানদের অন্যতম প্রিয় একজন হয়ে উঠেন তিনি। নজর কাড়েন ইংল্যান্ড ও বিশ্বের অন্যতম বড় ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের। অতঃপর ২০১৪ বিশ্বকাপের পর আয়াক্স ছেড়ে ইউনাইটেডে পাড়ি জমান তিনি।
আয়াক্সের সাম্প্রতিক সময়ের একাডেমি খেলোয়াড়দের মধ্যে খুব সম্ভবত সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল ছিলেন ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেন। মুভমেন্ট, ড্রিবলিং, খেলা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতার জন্য আয়াক্স ফ্যানরা তাঁকে 'আধুনিক বার্গক্যাম্প' বলেই ডাকত। ইউনাইটেড, মাদ্রিদ, সিটির মত বড় ক্লাবগুলোর আকর্ষণের পরেও আয়াক্সে থাকার সিদ্ধান্ত নেন এরিকসেন। কিন্তু পরের মৌসুমেই স্পার্সের ২৫ মিলিয়ন ইউরোর অফারে রাজি হয় আয়াক্স। এরিকসনও ব্লিন্ডের মত ইংল্যান্ডে চলে যান।
পোড় খাওয়া মিডফিল্ডার নাইজেল ডি ইয়ংয়ের ক্যারিয়ারও শুরু হয়েছিল আয়াক্সে। প্রথম দুই মৌসুম দলে জায়গা পাকা করতে না পারলেও এরপরের মৌসুম থেকেই আয়াক্সের এক অপরিহার্য সদস্যে পরিণত হন তিনি। ’০৪-'০৫ মৌসুমে আয়াক্সের সেরা খেলোয়াড় হন তিনি। কিন্তু এরপরে ম্যানেজারের সাথে রেষারেষির ফলে আয়াক্স ছেড়ে হ্যামবার্গে পাড়ি জমান তিনি।
’১০ বিশ্বকাপের ফাইনালিস্ট হল্যান্ড দলের আক্রমণ ভাগের অন্যতম দুই কুশীলব রাফায়েল ভ্যান ডার ভার্ট এবং ওয়েসলি স্নাইডারের ক্যারিয়ারও শুরু হয়েছিল আয়াক্সে। বন্ধু স্নাইডার, হাইটিংগার সাথে মাত্র ১০ বছর বয়সে আয়াক্সের যুব দলে যোগ দেন ‘ভিডিভি’। মাত্র ১৭ বছর বয়সে মূল দলে জায়গা পাকা করেন ভ্যান ডার ভার্ট। জাতীয় দল আর ক্লাবের হয়ে অসাধারণ পারফরম করতে থাকায় অচিরেই হল্যান্ড ও ইউরোপের সেরা তরুণ খেলোয়াড় হয়েছিলেন। ইনজুরি আর ওই সময়ের সতীর্থ ইব্রাহিমোভিচের সাথে কোন্দলের ফলে ’০৫ এর সেপ্টেম্বরে ক্লাব ছাড়ার ঘোষণা দেন। ভ্যান ডার ভার্ট চলে গেলেও থেকে যান স্নাইডার। ইব্রা, ভ্যান ডার ভার্ট চলে যাওয়ার ফলে ওইসময় আয়াক্সের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় ছিলেন । কিন্তু এর দুই বছর পরেই রিয়াল মাদ্রিদ স্নাইডারের জন্য ৩০ মিলিয়ন ইউরোর অফার করলে তাকেও বিক্রি করতে বাধ্য হয় নিরূপায় আয়াক্স।
স্নাইডারের মতো অনেক দিন আক্ষেপ করতে হয়েছে লুইস সুয়ারেজকে নিয়েও। প্রথম মৌসুমে আলো ছড়াতে না পারলেও দ্বিতীয় মৌসুম থেকেই আয়াক্সের নিউক্লিয়াস বনে যান সুয়ারেজ। তার অসামান্য অবদানের ফলেই আয়াক্স ডাচ লিগ ও কাপ জেতে। টানা দুই মৌসুমে ডাচ লিগের সেরা খেলোয়াড় হন এই উরুগুইয়ান স্ট্রাইকার। এরপর থেকেই তার দিকে নজর পড়ে লিভারপুলের। অনেকদিন চেষ্টা করার পর অবশেষে লিভারপুলের ২৬.৫ মিলিয়ন ইউরোর প্রস্তাবে রাজি হয় আয়াক্স। সুয়ারেজ চলে যান ইংল্যান্ড জয় করতে।
সুয়ারেজের মতো আয়াক্স কিংবদন্তি হওয়ার সুযোগ ছিল ইব্রাহিমোভিচের সামনেও। নিজ শহরের ক্লাব মালমো থেকে মাত্র ২০ বছর বয়সে আয়াক্সে পাড়ি জমান । তৎকালীন আয়াক্স কোচ রোনাল্ড কোম্যান অসাধারণ প্রতিভাধর ইব্রা-কে বেশকিছু দিন ধরে স্কাউট করার পর তাকে কিনেই দলের মূল স্ট্রাইকার হিসেবে খেলানোর সিদ্ধান্ত নেন। ইব্রাও তার নতুন কোচের আস্থার প্রতিদান দিতে থাকেন। যে তিন বছর ছিলেন, তাতে আয়াক্সকে লিগ জিতিয়েছেন দুবার আর ডাচ কাপ জিতিয়েছেন একবার। কিন্তু অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং সতীর্থ ভ্যান ডার ভার্টকে ট্রেনিংয়ে ইচ্ছা করে ইনজুরড করার গুঞ্জনসহ আরো বিভিন্ন বাহ্যিক চাপের কারণে অবশেষে বেশ ক্ষোভ নিয়েই আয়াক্স ছাড়েন ইব্রা।
আয়াক্সের সম্ভাব্য দল
ডাচলিগের এক নম্বর ক্লাব হলেও আর্থিকভাবে ইউরোপের প্রথম সারির দলগুলো থেকে বেশ পিছিয়ে আছে আয়াক্স। এজন্যই তাদেরকে নিজেদের একাডেমী এবং ইংরেজি পরিভাষায় ‘শ্রুড সাইনিং’-এর উপর নির্ভর করতে হয় বেশী। আয়াক্সের এতদিন সাফল্য মূলত এই দুটি জিনিসের উপর নির্ভর করেই হয়েছে। তাই আয়াক্স সমর্থকরা এই ভেবে আশায় বুক বাঁধতে পারেন যে, তাদের একাডেমি ও ম্যানেজমেন্ট তাদের এই সাফল্য ধারা বজায় রাখতে পারবেন এবং এর ফলে কয়েক মৌসুমের জন্য হলেও তারা আরো কিছু রাঘব-বোয়ালকে নিজেদের প্লেয়ার হিসেবে দেখতে পাবেন।
আরো পড়ুনঃ
যে তারারা থাকতে পারতেন- পর্ব ২