অল্প গল্পে অলিম্পিক-১: হারকিউলেসের হাত ধরে
পেলোপনেস পেনিনসুলা, দক্ষিণ গ্রিস। আড্রিয়াটিক সাগর থেকে খুব বেশি দূরে নয়, পর্বত উপবিষ্ট হওয়ায় সারা বছর আবহাওয়াও থাকে চমৎকার। তীব্র গরমের বালাই নেই, হাড়-কাঁপানো শীত নেই, সারা বছর ফুরফুরে হাওয়া আর পরিমিত বৃষ্টিপাত; এই ভূগোলকে স্বর্গের কাছাকাছি কিছু থেকে থাকলে নিঃসন্দেহে পেলোপনেস তার ভিতরে পড়বে।
যে সময়টার কথা বলছি সেটা অবশ্য আজকের নয়। তখনো যীশুর জন্ম হয়নি, যীশুখ্রিস্ট তো পরে, আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেটের জন্মেরও প্রায় ৩৫০ বছর আগেকার ঘটনা বলছি। আসলে প্লেটোর জন্মও ঐ সময়কালের কয়েক শতাব্দী পরে। ৭৭৬ অব্দ, মানে হচ্ছে আজ থেকে প্রায় ২৮০০ বছর আগের কথা। সভ্যতার অস্তিত্ব তখন অড্রিয়াটিক আর এজিয়ান সাগরের পাড়ে; সাইক্লডস, ডোডেকানিজ, সারোনিক দ্বীপপুঞ্জের বুকে। তখন মানব সভ্যতা আজকের হিসাব মতে ‘ক্ল্যাসিকাল এজ’ এ প্রবেশ করছে, পাগান সভ্যতার হিসাবে সেটা হেলেনিক যুগের অগ্রভাগ।
‘সিভিক’ শব্দটার উৎপত্তি ঐ সময়েই, নগররাজ্যের ধারণাগুলো তখন বিকশিত হচ্ছে। ছোট ছোট শহরগুলোই একেকটি দেশ, যদিও এদের মধ্যে সংস্কৃতি-ভাষা-আচারে তেমন পার্থক্য নেই। যুদ্ধ-বিগ্রহ ছিল নৈমিত্তিক, সীমিত সম্পদ ব্যবহার নিয়ে কাড়াকাড়ি ছিল স্বাভাবিক- আবার বিপদে পাশের নগরটিই হতো সামরিক ‘এলায়েন্স’। ইতিহাস কপচানোর অর্থ আসলে এই এলায়েন্সের জন্যেই। যুদ্ধকে দূরে সরিয়ে রেখে বন্ধুত্বকে প্রগাঢ় করার মনোভাব থেকেই ঐ পেলোপনেস পেনিনসুলার অলিম্পিয়া নগরে অলিম্পিক গেমসের জন্ম! আজকের গেমসের সাথে সেটার মিল নেই ঠিক; কিন্তু মূলভাবটা আজো অটুট- ভ্রাতৃত্ব, বন্ধন, সাম্য, বন্ধুত্ব!
অলিম্পিকের উৎপত্তির কারণ হিসেবে আমরা আজ এই ভ্রাতৃত্বকে জ্ঞাত করলেও গ্রীক মিথোলজি কিন্তু সেটা সমর্থন করে না। হেরাকলস কে চিনেন? উনাকে না চিনলেও হারকিউলেসকে আপনি নিশ্চিত চিনে থাকবেন। গ্রীক হেরাকলসই আসলে রোমান ভাষায় হয়ে গেছেন হারকিউলেস, উনি স্বয়ং দেবতাদের দেবতা মহামান্য জিউসের পুত্র। টিভি সিরিজের কল্যাণে এই কাহিনী হয়তো অনেকেরই জানা- দেবী হেরার গুণমুগ্ধ হয়ে হারকিউলেস তার স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে গলা কেটে হত্যার পর যখন প্রবল পাপবোধে বিদ্ধ- তখন পাগান পাদ্রীর পরামর্শে তিনি চলে যান টিরানসে। সেখানকার রাজা ইউরেসথিউসের আজ্ঞাবহ হয়ে তিনি ১২ বছর কাটিয়ে দেন প্রায়শ্চিত্তের জন্য- সমাধা করেন বারটি অকল্পনীয় কাজ। নিমিয়ান লায়ন্স, কিংবা নয় মাথার হাইড্রা ডেভিলকে মারা এসব ছিল এই কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই কাজগুলোর বিনিময়ে তিনি অমরত্বও পেতে পারতেন, কিন্তু সেটি আর নিতে চান নি। এজন্যেই তিনি ডেমিগড- ঈশ্বরের পুত্র হয়েও অবিনশ্বর নন!
তার বারটি কাজের ছয়টিই ছিল এই পেলোপনেস উপত্যকায়। প্রায়শ্চিত্তের পর তাই তিনি পেলোপনেসের অলিম্পিয়াতে পিতা জিউসের সম্মানে আয়োজন করেন এথলেটিক্স প্রতিযোগ। সালটা ৭৭৬ অব্দ, গ্রিক মিথে ওটাই প্রথম অলিম্পিক গেমস। স্বয়ং জিউস সেখানে উপস্থিত ছিলেন বলেও কোন কোন রেয়াতে উল্লেখ আছে!
আরেকটা মিথও অবশ্য বেশ চালু আছে। গ্রীসের পিসার রাজপালকে তার গণক যখন বললেন যে তাঁর মৃত্যু মেয়ে-জামাইয়ের হাত ন্যাস্ত তখন তিনি পাগল হয়ে গেলেন! মেয়ে হিপোডামিয়া অসামান্য অপরূপা, গ্রীসে তার রূপ নিয়েই বেশ কয়েকটা উপাখ্যান আছে। গণকের ভবিষ্যদ্বাণীর পর রাজা এনেমাস সমন জারি করলেন- তার মেয়েকে বিয়ে করতে চাইলে তার বিপক্ষে চ্যারিয়ট রেসে জিততে হবে। উদ্দেশ্য ছিল আসলে চ্যারিয়ট রেসের আড়ালে এমন অবস্থা সৃষ্টি করা যাতে হবু-জামাইয়ের মৃত্যু সুনিশ্চিত করা যায়। রাজার চ্যারিয়ট-টাও ছিল দেবতা পোসাইডন প্রদত্ত- গতি ছিল বজ্রের মত। তখনি আগমন নায়কের এবং অপরূপা হিপোডামিয়া নায়কের প্রেমে পড়তে সময়ও নিল না!
দেবতার চ্যারিয়টের বিপক্ষে জিতার জন্যে নায়ক আশ্রয় নিল চাতুরির। চাকার ব্রোঞ্জপিনের বদলে সে বসিয়ে দিল মোমের পিন। রেস শুরু হবার পর মোম গলে চাকা বিচ্যুত হতে সময় নিল না, আর তাতেই মৃত্যু হল এনেমাসের। পোসাইডনের অনুসারী হওয়াতে রুষ্ট দেবতা জিউস ঐ সময়েই এনোমাসের প্রাসাদ ধুলার সাথে মিশিয়ে দিলেন। অবশ্য একটা কাঠের পিলারকে তিনি অক্ষত রেখেছিলেন। দেবতা জিউসের রাখা ঐ অক্ষত কাঠের পিলারটি আজো গ্রীসের আল্টিস শহরে বিদ্যমান আছে। শহরের অবস্থানটা কোথায় জানেন? ঐ পেলোপনেস উপত্যকায়। জায়গাটার নাম আসলে ঐ নায়কের নামেই হয়েছে- নায়কের নাম তো পেলোপস! এই বীরোচিত ঘটনাকে বরণ করতে আর জিউসের সম্মানেই জন্ম হয় অলিম্পিক গেমসের!
জন্ম নিয়ে তো অনেক আলাপই হলো। আপনি কি জানেন, প্রাচীন অলিম্পিক গেমস মহিলাদের জন্যে নিষিদ্ধ ছিল? কোন মহিলা গোপনেও যদি অলিম্পিক স্টেডিয়ামে প্রবেশ করে ধরা পড়ে যেতেন তবে তাকে শাস্তি দেয়া হত পর্বত চূড়া থেকে নিচে নিক্ষেপ করে! গ্রীকরা মেয়েদের এথলেটিক্স চর্চা নিষিদ্ধ করে রাখলেও স্পার্তানরা ব্যতিক্রম ছিল। সুঠাম এবং যোদ্ধা সন্তান পাবার আশায় স্পার্তান মেয়েদের এথলেটিক্স চর্চায় ব্যাপক উৎসাহ দেয়া হত। এরাই পরবর্তীতে অলিম্পিকে নারী অংশগ্রহণের টিকিট হিসেবে ভূমিকা পালন করেছিলেন।
প্রাচীন অলিম্পিকের আরেকটি ব্যাপার ছিল পোষাক। প্রত্যেক অংশগ্রহণকারীদের অবশ্যই নগ্ন হয়ে অংশ নিতে হত! অবশ্য চ্যারিয়ট রেসের ক্ষেত্রে এই বাধকতা ছিল না। মেয়েরা অংশ নেয়া শুরু করার পর অবশ্য এই নিয়ম শিথিল হয়। তবে অনেক মেয়েই নগ্ন হয়ে নামতেন; পোষাক পড়লেও সেটি থাকত স্বল্পবসন!
অলিম্পিকের প্রথম ইভেন্ট ছিল স্তাদে। গ্রীক ঐ স্তাদে শব্দ থেকেই আজকের স্টেডিয়াম শব্দের সূচনা। স্তাদে কে মোটামুটি আজকের হিসাবে ১৯২ মিটার দৌড়ের সাথে তুলনা করা যায়। হেলেনিক যুগে অলিম্পিক ছাড়াও আরো অনেক গেমস ছিল। যেমন দেবী হেরার প্রতি অর্ঘ্য নিবেদনের জন্য হেরারিয়ান গেমস, এপোলো দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদিত পিথিয়ান গেমস। কিন্তু ব্যাপক জনপ্রিয় হয় আসলে অলিম্পিকই। এই গেমসে অংশের জন্যে দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসত। প্রথমে শুধু স্বাধীন গ্রীকভাষীদের জন্যে অংশ নেয়ার সু্যোগ থাকলেও বিদেশী কোটায় অন্যরাও পরে অংশ নেয়ার সু্যোগ পায়। তখনো চার বছর পরপর গেমস হত- গেমসের বছরে অলিখিত চুক্তি থাকত যুদ্ধ বিরতির। জনপ্রিয়তার আতিশায্যে গ্রীকরা এরপর দিনক্ষণ হিসাবই শুরু করে অলিম্পিকের বছর ধরে। চার বছরে গণনা করা হত এক অলিম্পিয়াড!
এমন তের অলিম্পিয়াড বাদেই নতুন ইভেন্ট শুরু হয়। ‘ডিয়াউলোস’- এটাকে আজকের চারশ মিটার দৌড়ের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। এর সাথে চালু হয় দোলিকোস- এটা ছিল দূরপাল্লার দৌড়। কেউ এটাকে ৫০০০ মিটার বললেও অনেক ক্ষেত্রে এটাকে ১৫০০ মিটার দৌড় ইভেন্ট হিসাবে বলা আছে।
৭০৬ অব্দের অলিম্পিকে যুক্ত হয় পেন্টাথলন। তখনকার পেন্টাথলন অবশ্য আজকের থেকে অনেক ব্যতিক্রম ছিল। ৬৮৮ অব্দে চালু হয় বক্সিং, ৬৮০ অব্দে চ্যারিয়ট রেস আর সর্বশেষ সংযোজন হয় ৬৪৮ এ- ‘প্যানক্রাশন’। রেসলিং এবং বক্সিং এর যুগলবন্দী বলা যেতে পারে একে- কোনরকম নিয়মনীতি ছাড়াই একে অপরকে আঘাত করার এই ইভেন্টটাই ছিল সবচাইতে সাংঘর্ষিক।
হেলেনিক যুগ পার হয়ে প্যানহেলেনিস্টিক যুগ পর্যন্ত এই গেমস ছিল গ্রীকদের সবচাইতে বড় মিলনমেলা। প্যানহেলেনিস্টিক যুগের বিনাশ হয় অ্যালেকজান্ডারের মৃত্যুর সাথে সাথে। তাঁর অধিকৃত বিশাল গ্রীক সাম্রাজ্য তিনটি ভাগে ভাগ হয়ে যায়। ক্রমাগত কমতে থাকে গ্রীকদের শৌর্য; সামরিক সক্ষমতা। নগরগুলো যখন দুর্নীতি আর ক্ষমতালোভীদের অদূরদর্শিতায় ক্রমাগত দংশিত হচ্ছিল তখনি গ্রিসে রোমান অনুপ্রবেশ ঘটে। দুনিয়ার ইতিহাসে সেটা ছিল পালাবর্তনের কাল; সভ্যতার ব্যাটনটা গ্রীক থেকে রোমানদের হাতে সমর্পণের কাল। এরপর তো আসে ক্রিশ্চিয়ানিটির ধারণা। পাগানদের বহু দেবতার কৃষ্টি ক্রমশ ক্রিশ্চিয়ান ধ্যান-ধারণা দিয়ে পিষ্ট হতে থাকে। প্রথম দিকে সহাবস্থান চললেও ক্রমশ সেটা রূপ নেয় সাম্প্রদায়িক উগ্রতায়। রোমান রাজা থিওডিয়াস শেষ পর্যন্ত সমস্ত পাগান সংস্কৃতিকে নিষিদ্ধ করে তাদের সব মন্দির ভেঙ্গে দেয়ার নির্দেশ দেন। জিউসের অর্ঘ্যে নিবেদিত অলিম্পিক গেমসেরও সেখানে সমাপ্তি ঘটে। সময়টা আনুমানিক ৩৮৪ খ্রীষ্টাব্দ।
১৫০০ বছর পর ব্যারন পিয়েরে দ্য কুবার্তিনের হাত ধরে চালু হবার আগে মানব সভ্যতার ইতিহাসে সেটাই ছিল শেষ অলিম্পিক গেমস।
আধুনিক অলিম্পিকের মতো প্রাচীন অলিম্পিকের সবকিছুর আর্কাইভ আজ আর পাওয়া সম্ভব নয়। অবশ্য যেটুকু উদ্ধার হয়েছে তাতেও ঘটনা প্রবাহের সীমা-পরিসীমা নেই। আমাদের পরবর্তী পর্বগুলো তাই আধুনিক অলিম্পিকের ঘটনাপ্রবাহ নিয়েই সাজানো থাকবে।
পড়ার আমন্ত্রণ রইলো!
পরের পর্বঃ