অল্প গল্পে অলিম্পিক-২: সিনেমা যেখানে হার মানে
অলিম্পিকের জয়ীদের হাসির পিছনে লুকিয়ে থাকে ঘাম, পরিশ্রম, ত্যাগ আর তিতিক্ষার গল্প। এর বাইরেও কিছু বিজয়ী থাকেন যাদের কাছে পদক জয় নিছক বাতুলতা, জীবনের ক্ল্যাইমেক্স-অ্যান্টিক্ল্যাইমেক্সে তাঁদের জীবনটাই হয়ে উঠে এক একটা সিনেমা। বেইজিং অলিম্পিকের এমন দুটি ঘটনা নিয়েই এবারের আয়োজন। দুয়ারে কড়া নাড়া আরেকটি অলিম্পিকের আগে একটু 'সিনেমাপাঠ' হয়েই যাক না হয়!
আগের পর্ব : অল্প গল্পে অলিম্পিক-১: হারকিউলেসের হাত ধরে
‘স্ট্রংগেস্ট ম্যান ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’
‘That brings the tear to eyes. He’s wild. That must for Susann. He’s remarkable! You’re looking at the strongest man in the world. Unbelievable!!’
তিনি যখন মঞ্চে আসলেন শেষবারের মতো ওয়েট লিফট করতে, তখনি তার চোখে জল। দুরু দুরু বুকে দাঁড়ালেন, জোরে জোরে কয়েকটা দমও নিলেন। এরপর পনের সেকেন্ডের মধ্যে তুলে ফেললেন ৪৬১ কেজি! তারপরের ঘটনাগুলো অলিম্পিকের ইতিহাসে চিরকাল বাঁধাই করে রাখার মত দৃশ্য! তিনি লাফালেন, কাঁদলেন, কোচকে জড়িয়ে ধরলেন, জার্সি তুলে কি যেন দেখালেন। এরপর আবার হু হু করে কাঁদতে বসলেন। ধারাভাষ্যকারের স্বাভাবিক এবং বহুল ব্যবহৃত উপরের কথাগুলোও তখন আবেগী শোনাল, তৈরি করল ভ্রমের।
ম্যাথিয়াস স্টাইনারের এই ‘সুজান ইতিকথা’ বুঝার জন্য যেতে হবে আরো পিছনে। ২০০৪ সাল তখন, স্টাইনার তখন উঠতি ভারত্তোলক। স্টাইনারের জন্ম আর বেড়ে উঠা দুটিই অস্ট্রিয়ায়। জন্মস্থানের হয়েই লড়ছিলেন সেরা হতে, আর সেটা প্রচারিত হচ্ছিল টিভিতে। জার্মান তরুণী সুজান সেই টিভির দেখাতেই প্রেমে পড়ে যান স্টাইনারের! তাঁর মেইল আইডি যোগাড়ের জন্য টিভি অফিসে গিয়েও হানা দেন, নানা কার্যকলাপ-চাপ-নাটক প্রয়োগ করার পর সেই আইডি তাঁর হাতে আসেও। নাটক-সিনেমার দোষ দিয়ে আর লাভ কি? এগুলার গল্পের সূতিকাগার তো এই রক্ত-মাংসের সুজানরাই! জার্মান তরুণী সুজান এরপর অস্ট্রিয়ান স্টাইনারের সাথে দেখা করেন অস্ট্রিয়াতে গিয়ে। ক্রমশ সেটা গিয়ে গড়ায় প্রণয়ে, এরপর তো পরিণয়! এর কিছুদিন পরেই জার্মানি চলে আসেন স্টাইনার, নাগরিকত্বও পেয়ে যান।
ভালবাসার এই ঘরের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র তিন বছর! ঘর তাঁরা নিজেরা ভাঙ্গেননি, নিয়তিই আসলে বিরাট দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল স্টাইনার-সুজানের মাঝখানে। ২০০৭ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান সুজান। স্টাইনারের জন্য সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। পরের বছর অলিম্পিক, সেটার জোর প্রস্তুতি চলছিল তখন। ১৮ বছর বয়স থেকে ভুগতে থাকা ডায়াবেটিস, সাথে এই মানসিক ধাক্কা - একজন ভারত্তোলকের জন্য যেটা অভিশাপ সেটাই তাঁর জীবনে নেমে আসে। মাত্র কয়েকদিনে আট কেজির মত ওজন হারান তিনি।
স্টাইনারের প্রস্তুতি বাধাগ্রস্ত হয়েছিল, কিন্তু বন্ধ হয়নি। আর এটার ফল তিনি কি পেয়েছিলেন সেটা তো প্রথম অনুচ্ছেদ থেকেই বুঝা যাচ্ছে। ২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিকের ১০৫+ শ্রেণিতে তিনিই ছিলেন ভারত্তোলকদের মধ্যে সেরা।
জেতার পর স্টাইনারের ওই কান্না নিঃসন্দেহে প্রয়াত স্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা। আমাদের মত ‘দুঃখ বিলাসী’-দের আসলে সাধ্য নেই ঐ চোখের পানির আবেগকে কথার মাধ্যমে প্রকাশ করার! পদকটা এজন্যেই যতটা না স্টাইনারের, তাঁর থেকেও বেশি সুজানের!
‘মৃত্যু নদীর সাঁতারু’
মার্টেন ফন ডার ভিজডেনকে বলা হচ্ছিল সাঁতারে ডাচদের ভবিষ্যৎ। ১৯৯৮ সালের ঐ সময়টাতে কথাটাকে একটুও মিথ্যে মনে হচ্ছিল না। কি দুর্দান্ত আবির্ভাব তাঁর, ডাচদের জাতীয় প্রতিযোগিতায় ১৫০০ মিটার ফ্রিস্টাইলে প্রথম অংশ নিয়েই চ্যাম্পিয়ন! এরপর পদক জিতেছেন টানা ৩ বছর। দূরপাল্লার সাঁতারে তাঁর আশেপাশেও তখন আর ডাচদের মধ্যে কেউ ছিলেন না।
সোনালি চুলের সেই সুদর্শন ছেলেকেই কয়দিন পর চুল ফেলে দিতে হল। বলা ভাল, ফেলতে বাধ্য হলেন। সাড়ে ছয় ফিটের উপরে লম্বা ছেলেটির আশ্রয় হল জল ছেড়ে হাসপাতালের বিছানায়। অস্বাভাবিক দুর্বলতা আর ক্ষত না সারার সমস্যা নিয়ে এসেছিলেন হাসপাতালে; রক্ত পরীক্ষায় পাওয়া গেল ‘ব্লাস্ট’ এর উপস্থিতি। সাথে বোন ম্যারোর অস্বাভাবিকতায় প্রচুর পরিমাণে শ্বেত রক্তকণিকা। চলতি ভাষায় এটাকেই বলে ‘লিউকেমিয়া’; আরো পরিষ্কার করে বললে রক্তের ক্যান্সার!
জীবন যখন একটি মিহি সুতার উপর ঝুলে পড়ে, খেলাধুলা তখন হয়ে যায় বাহুলতা। ডাচদের সেরা সাঁতার প্রতিভার অলিম্পিক পদক হাতে শিরোনাম হবার স্বপ্ন নিভে গেল সেখানেই। বেঁচে ফিরবেন এটা মার্টেন নিজেও বিশ্বাস করতেন না। তবু মানুষের প্রাচীন প্রবৃত্তি থেকে একের পর এক কেমো নিতে থাকলেন, ব্যথায় অচেতন হয়ে পড়ে থাকলেন বিছানায়। বোন ম্যারো প্রতিস্থাপন করলেন, খাবারের থেকে বেশি গ্রহণ করলেন ওষুধ। হার মানেননি মার্টেন, ক্যান্সারকে জয় করে এসেছেন। তাঁর ফিরে আসাটা ডাক্তারদের কাছে যদি মিরাকল হয় তাহলে পরের ঘটনাগুলোকে কি বলবেন সেটি আপনিই ঠিক করুন!
ক্যান্সার থেকে সেরে উঠলেন ২০০৪ সালে। ঐ বছরেই তিনি লেক ইয়েসেল সাঁতরে পার হলেন ৪ ঘন্টা ২১ মিনিট সময় নিয়ে। ১৫ মিনিট কম সময় নিয়ে ভেঙ্গে দিলেন আগের রেকর্ডটা। লেক ইয়েসেল হচ্ছে পশ্চিম ইউরোপের সবচাইতে বড় হ্রদ। আয়তন প্রায় ১১০০ বর্গকিলোমিটার। ক্যান্সারের ধকল পুরো না সামলিয়েও কাজটি তিনি করেছিলেন কৃতজ্ঞতা থেকে। রেকর্ড ভাঙ্গায় যে ৫০০০০ ইউরো পেয়েছিলেন তার সবটাই দিয়ে দিয়েছিলেন ক্যান্সার গবেষণায় সাহায্য করার জন্যে!
প্রতিযোগিতামূলক সাঁতারেও এরপর ফিরলেন, ফিরেই জাতীয় প্রতিযোগে ৪০০ মিটার ফ্রিস্টাইলে চ্যাম্পিয়ন! মার্টেনের মিতালি যতটা না পুলের সাথে তার চাইতেও বেশি উন্মুক্ত নদীতে। দূরপাল্লার সাঁতারেই তিনি বেশি স্বচ্ছন্দ, লক্ষ্যও ছিল এই ক্ষেত্রে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হবার। মৃত্যুকে জয় করে আসা মার্টেল এই ‘ক্ষুদ্র’ রণক্ষেত্রেও পেলেন বিজয়ের স্বাদ। সেভিয়ায় ২০০৮ বিশ্ব সাঁতারে জিতলেন সোনা। সুযোগ পেলেন প্রথমবারের মত অলিম্পিকে যাবার! এরপর যেভাবে বলা হয় আরকি! ইতিহাস গড়লেন মার্টেন, যে মার্টেনের বেঁচে থাকারই কথা ছিল না, সেই মার্টেনই বেইজিং অলিম্পিকে জিতলেন সোনা। ১০ কিলোমিটার সাঁতারে অল্প ব্যবধানে হারিয়ে দিলেন ফেবারিট ডেভিড ডেভিসকে!
সোনালিচুলো মার্টেনের অলিম্পিক সোনা গলায় নিয়ে সংবাদ শিরোনাম হবার স্বপ্ন পূরণ হল। তবে এবার শুধু ডাচ পত্রিকাতেই নন, সারা বিশ্বের খেলার পাতায়ই শিরোনাম হলেন তিনি। সাথে সোনালি চুলের বদলে ন্যাড়া মাথায় নিও লেখা সেই ছবিটা! সোনার হাসি হাসা মার্টেলের সেই ছবিটা তাই অবিনশ্বর, ক্যান্সার আক্রান্ত সবাইকে এটি প্রেরণা যোগাবে; এখন, সামনে, হয়তো কয়েক শতাব্দী পরেও...
২০০৮ সালেই তিনি হন ডাচ ‘স্পোর্টসম্যান অব দ্য ইয়ার’। পুরস্কারটা হাতে নিয়ে তিনি সবার আগে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন নাম না জানা সেসব ব্যক্তিদের যারা ক্যান্সার গবেষণায় বিনিয়োগ করেছেন সহস্র মিলিয়ন ডলার। ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন তাঁর ডাক্তারদের; তিনি হাল ছেঁড়ে দিলেও যারা হাল ছেড়ে দেননি। ঐ বক্তব্যেই তিনি ইতি টেনে দেন তাঁর ক্যারিয়ারের, উদ্দেশ্যটাও পরিষ্কার করে বলেন- ‘Now it’s time to swim against cancer; not for me, but for other people.’
জীবনকে পানসে মনে হচ্ছে, অর্থ খুঁজে পাচ্ছেন না? মার্টেলের ওয়েবসাইট থেকে একটু ঘুরে আসতে পারেন! কথা দিচ্ছি, হতাশ হবেন না আপনি!
পরের পর্বঃ