• " />

     

    জাসকারান মালহোত্রা: ভারত-স্বপ্নভঙ্গ শেষে মার্কিন মুলুকে ছয় ছক্কার ক্লাবে

    জাসকারান মালহোত্রা:  ভারত-স্বপ্নভঙ্গ শেষে মার্কিন মুলুকে ছয় ছক্কার ক্লাবে    

    সেপ্টেম্বরের নয় তারিখের আগেও তাকে হয়তো আপনি চিনতেন না। আমেরিকার ক্রিকেটের খোজখবর এত গভীরে রাখবার সময় আপনার থাকার কথা নয়। ৬ ওয়ানডেতে ১১ গড়ে ৫৫ রান করা ব্যাটসম্যানকে চিনতে হলে প্রয়োজন 'বিশেষ কিছু'। সেপ্টেম্বরের নয় তারিখে 'ছয় ছক্কা' হাঁকিয়ে বিশ্বের কাছে তিনি আর অচেনা কেউ নন। হার্শেল গিবস, যুবরাজ সিং, কিয়েরন পোলার্ডদের সঙ্গে এখন উচ্চারিত হবে জাসকারান মালহোত্রারও নাম! 

    নামেই আঁচ করতে পারছেন, জাসকারান মালহোত্রার কোনও না কোনও সংযোগ থাকবেই ভারতের সঙ্গে। আদতে জাসকারান তো স্বপ্ন দেখেছিলেন ভারতের জার্সিটাই গায়ে চাপাবার। কিন্ত জীবনের বাকবদলে ইতিহাস গড়লেন যে দলের হয়ে, সেটির নাম ভারতের বদলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ওয়ানডে ক্রিকেটে মার্কিন মুলুক প্রথম সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছে তারই হাত ধরে। আর সেই ইতিহাসের ম্যাচে তিনি করেছেন ‘বিশেষ কিছু’ও। কিন্ত ‘ছয় ছক্কা’ মারার ‘উইশ’ তো স্বপ্নের সীমানায়ও ঢুকতে পারে না, নয়তো তা স্বপ্নের সীমানাই ছাড়িয়ে যায়!  

    ১০ ওভারের ভিতরে ২৯ রানেই তিন উইকেট সেদিন হারিয়ে ফেলেছিল আমেরিকার দল। পাচঁ নাম্বার ব্যাটসম্যান হয়ে তখন নামলেন জাসকারান মালহোত্রা। লক্ষ্য ছিল শেষ পর্যন্ত টিকে থাকাটাই। শেষ বল পর্যন্তই টিকে থাকলেন শেষমেশ। ১২৪ বল খেলে অপরাজিত রইলেন ১৭৩ রানে। তাঁর ইনিংসের শেষ ২২ বলে আনলেন ৭৩ রান। যার প্রায় অর্ধেকই এলো ইনিংসের শেষ ওভারে, যেখানে গাউদি টোকার পরপর ছয় বল হাওয়ায় ভেসে ভেসে গেল সীমানা পেরিয়ে। 

    লং অন দিয়ে, পরেরটা এক্সট্রা কাভার অঞ্চল দিয়ে, এরপর লং অফ বরাবর। তিন বলে তিন ছয়ের পর টোকা গেলেন রাউন্ড দ্য উইকেটে, এবার ওয়াইড লং অন দিয়ে। চার ছক্কার পর তখনই জাসকারানের ভাবনায় এল 'ছয় ছক্কা'! পাপুয়া নিউগিনির ডানহাতি মিডিয়াম পেসার টোকা আবার ফিরলেন ওভার দ্য উইকেটে, ফলাফল একই। 'না চাওয়ার' ইতিহাসে প্রবেশ রুখবার শেষ চেষ্টায় বল করতে এলেন টোকা, সেই চাপটাই বোধহয় বলটাকে বানিয়ে দিলো ফুলটস। স্কোয়ার লেগের উপর দিয়ে ছক্কার ছক্কা! 

    সেই ছয় ছক্কা জাসকারান মালহোত্রাকে জায়গা করে দিলো রথী-মহারথীদের পাশেই। গিবসের পরে ওয়ানডে ক্রিকেটে হলেন ‘ছয় বলে ছয় ছক্কা’ মারা দ্বিতীয় ক্রিকেটার, পুরো ইনিংসে ১৬ ছয় মেরে যৌথভাবে ওয়ানডেতে এক ম্যাচে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ছক্কা মারার রেকর্ড গড়লেন, ১৭৩ রান করে হলেন পাচঁ নাম্বারে ব্যাটিংয়ে নেমে সর্বোচ্চ স্কোরার। যে রেকর্ডটা আগে ছিল, আব্রাহাম বেঞ্জামিন ডি ভিলিয়ার্স নামের একজনের। বারকয়েক পাপুয়া নিউগিনির ফিল্ডারদের সহায়তা পেয়েছেন অবশ্য তিনি সে যাত্রায়। দু-তিনবার জীবন পেয়েছেন ঠিক, তবু তাতে কিই-বা আসে যায়! জীবন পাওয়া ক্রিকেটে 'খেলার অংশ' বলেই কথিত, তবে সেটার তো আর 'খেলার হিসেবে' আসবার সুযোগ নেই!

    ম্যাচ শেষে জাসকারানের হোয়াটসঅ্যাপ ভরে যায় মেসেজে, জমা পড়ে হাজার চার-পাঁচেক মেসেজ 'আনরিড মেসেজেস'র ঘরে। কিয়েরন পোলার্ডের মেসেজটা অবশ্যই 'আনরিড' হয়ে থাকতে পারে না। ছয় ছক্কার ক্লাবের কিছুদিন পুর্বেই 'নতুন সদস্য' থাকা পোলার্ড নিশ্চয়ই স্বাগত জানাবেন সদ্য 'নতুন সদস্য' হওয়া জাসকারান মালহোত্রাকে। পোলার্ডের সঙ্গে পরিচয়টা অবশ্য রয়েছে তাঁর আগে থেকেই। ২০১৮ সালে সিপিএলে পোলার্ডের সেন্ট লুসিয়া স্টারসের দলেই যে ছিলেন তিনি। তবে ‘ছয় ছক্কা’ ক্লাবের আরেকজনের ‘অভিবাদন’ বার্তার অপেক্ষায়ই আছেন তিনি। এবং তিনি এও জানেন, তাঁর ইয়ুভি পাজির (যুবরাজ সিং) কাছ থেকে তা আসবেই নিশ্চিত। এতক্ষণে তা এসেই গেছে হয়তো! 

    যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা সত্যি হলে হয়তো যুবরাজ সিংয়ের সতীর্থও হতে পারতেন জাসকারান৷ ভারতের ক্রিকেটে ঢের সাফল্যের গল্পে আঁধারে ডুবে যায় ব্যর্থতার গল্পগুলো। ব্যর্থতার পেছনের গল্পগুলোও তাই আড়ালেই রয়ে যায়। দেশের জার্সি জয়ের স্বপ্ন ফেলে অনেকেই এখন ছুটেন অন্য দেশে। জাসকারান মালহোত্রাও তেমনি আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছিলেন ২০১৪ সালেই।

    হিমাচল প্রদেশের অনুর্ধ্ব-১৫, অনুর্ধ্ব-১৭ দলের অধিনায়কত্ব করেছেন, ছিলেন অনুর্ধ্ব-১৭ পর্যায়ের সম্ভাবনায় উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান। বিশ্বকাপের অনুর্ধ্ব-১৯ দলের সম্ভাব্য বিশের ক্যাম্পে ছিলেন, পরে জায়গা করে নিতে পারেননি সেরা ১৬ জনে। যারা পরবর্তীতে ২০০৮ সালে বিরাট কোহলির নেতৃত্বে জয় করে বিশ্বকাপ। 

    ২০১০ সালে ভারতের ঘরোয়া মৌসুম শেষে আমেরিকায় এক আত্মীয়ের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন জাসকারান। সেখানে লোকাল এক টুর্নামেন্টে খেলার সুযোগও পেয়ে যান৷ বেশ ভালো করার সুবাদে তারপর প্রতি বছরই আমেরিকা থেকে আসতে থাকে খেলার অফার। অন্যদিকে তাঁর ভারতের হয়ে খেলার স্বপ্নের পরিধিও দিনকে দিন সংকুচিত হচ্ছিলো। অবশেষে ২০১৪ সালে তিনি একেবারেই পাড়ি জমান আমেরিকায়। সেই আমেরিকার সেঞ্চুরির ইতিহাসের শুভ সূচনা করে জাসকারান অমরত্বই পেয়ে নিলেন মার্কিন মুলুকের ক্রিকেটে।

    আচ্ছা, 'ছয় ছক্কা' কে মারলো যেমন জানতে চায় সবাই, জানতে চায় তো এমন নির্মম ঘটনার ভুক্তভোগী হতে হলো কাকে সেটাও। গাউদি টোকা হাত ঘোরান না খুব একটা। সেপ্টেম্বরের নয় তারিখের আগে তিনি দশ ওয়ানডের একটিতেই শুধু বল করেছেন, তাতে বল করেননি ৪.৩ ওভারের বেশি। সেপ্টেম্বরের ওই দিনটায় করলেন সাত ওভার, শেষের ওভারে বৈধ উপায়ে যতটি ছয় খাওয়া সম্ভব তাকে খেতে হলো ততটাই। এরপরেও ছুটবেন তিনি বল হাতে নিশ্চয়ই, বেশি হোক কিংবা কম। স্টুয়ার্ড ব্রডও 'ছয় ছক্কা'র ওভারের আগে-পরে বোলিং করে গেছেন ওভারের পর ওভার৷ কিন্ত টোকা, আকিলা ধানাঞ্জায়া, ব্রড, ভ্যান বাঙ্গে কারোরই চাইলেই ভুলার উপায় নেই সেই 'বিশেষ' ওভারটি!

    যেমনটা ভোলার নয় গিবস, যুবরাজ, পোলার্ডেরও। দর্শকদের মনেই তো সেই ‘বিশেষ ওভার’ জায়গা করে নিয়েছে স্থায়ীভাবে। সেপ্টেম্বরের নয় তারিখে ‘বিশেষ কিছু’ করে সেখানে ঢুকে গেলেন জাসকারান মালহোত্রাও!