ক্রিকেটের তিন পুরুষ এবং একজন 'ভালা' মানুষ
আল-আমেরাতে মিনিস্ট্রি টার্ফে আগামীকাল বেজে উঠবে তাদের জাতীয় সঙ্গীত, ‘উই আর ইনডিপেনডেন্ট অ্যান্ড উই আর ফ্রি, পাপুয়া নিউ গিনি’- হয়তো শেষ বারের মত। ওমান থেকে এই সুর গিয়ে পৌঁছাবে পাপুয়া নিউ গিনির রাজধানী পোর্ট মোর্সবি থেকে উত্তর-পশ্চিমে, মাত্র ১৫,০০০ মানুষের বসবাস নিয়ে পাহাড়ঘেরা গ্রাম হানুয়াবাদাতে। পাপুয়া নিউ গিনি দলের প্রায় সবাই-ই তো এসেছেন এই গ্রাম থেকে বিশ্ব ময়দানের সবচেয়ে বড় মঞ্চে।
বিশ্বকাপ শুরুর আগে এক সাক্ষাৎকারে ঠিক এটাই বলেছিলেন চার্লস আমিনি, ‘এই বড় মঞ্চে আমরা শুধুই কয়েকজন গ্রামের ক্রিকেটার’। চার্লস জর্ডান আলেওয়া আমিনি- টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এসে যিনি দেশের পাশাপাশি প্রতিনিধিত্ব করছেন নিজের পরিবারকেও। আমিনি পরিবার আর পাপুয়া নিউ গিনি’র ক্রিকেট যে একসঙ্গে জড়িয়ে বহু বছর ধরে, ক্রিকেট তাঁদের রক্তে। দাদা থেকে শুরু করে আমিনির বাবা-মা, আমিনির বড় ভাই সবাই পাপুয়া নিউ গিনির হয়ে খেলেছেন ক্রিকেট। মা কুনেমো রুপা আমিনি ছিলেন নারী দলের ক্যাপ্টেন, ২০০৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত দিয়েছিলেন নেতৃত্ব। বাবা ক্রিস আমিনি সিনিয়র খেলেছেন ১৯৮৬ আইসিসি ট্রফিতে, আর বড় ভাই ক্রিস ছিলেন অনুর্ধ্ব-১৯ দলের ক্যাপ্টেন।
রাজধানী পোর্ট মোর্সবির কেন্দ্রে পাপুয়া নিউ গিনি ক্রিকেট দলের স্টেডিয়াম- আমিনি পার্ক। আমিনি পরিবারের অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে এই স্টেডিয়ামেই পাপুয়া নিউ গিনি দল বুনে চলে সামনে এগিয়ে চলার অনুপ্ররণা, যেমনটা এনে দিয়েছিলেন কুনেমো রুপা। ২০০৮ এ তার নেতৃত্বে এই আমিনি পার্ক স্টেডিয়ামেই নারী দল হারিয়েছিল জাপানকে, জায়গা করে নিয়েছিল ২০০৮ আইসিসি নারী বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়ারে।
পাপুয়া নিউ গিনিতে ক্রিকেট নিয়ে এসেছিলেন ইংরেজ যাজকরা, আর সেটাও ১৮৯০ এর দিকে। সহযোগী দেশ হিসেবে পাপুয়া নিউ গিনির স্বীকৃতি পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছে আরো ৮৩ বছর। এরপর এই আমিনি পার্কেই এসেছিল অস্ট্রেলিয়া দল, ১৯৭৫ এ এসে খেলে গেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আমিনি পার্কে খেলেছেন ব্রায়ান আমিনি, তার ছেলে চার্লস সিনিয়র আমিনি। তবে আমিনি পার্ক থেকে বিশ্বকাপের মঞ্চে আসতে পেরেছেন শুধু চার্লস আমিনিই।
‘আর তো কেউ বিশ্বকাপ খেলেনি, আমিই একমাত্র যার এই সুযোগ হচ্ছে’- আইসিসির পডকাস্টে বিশ্বকাপ শুরু মাসখানেক আগে ঠাট্টাচ্ছলে বলছিলেন চার্লস আমিনি। তবে পরিবারে সেরা কিনা, সে নিয়ে তার দ্বিমত; বলেছিলেন বড় ভাই ক্রিস ছিলেন পরিবারের সেরা ক্রিকেটার। তবে চার্লস মোটেও শুধু একজন ‘সাধারণ’ ক্রিকেটার নন। পাপুয়া নিউ গিনির ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্জনটা এসেছিল তার অবদানেই। ২০১৪ সালে হংকংয়ের বিপক্ষে ২০১৫ বিশ্বকাপ কোয়ালিফাইং পর্বে খেলেছিলেন ৬১ রানের ইনিংস, পাপুয়া নিউ গিনি সেই ম্যাচে জিতেছিল ৬ উইকেটে। সেই জয়ের কারণেই তারা প্রথমবারের মত পায় ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টি ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যাটাস। তখনকার ২৩ বছরের তরুণ চার্লস এখন আরো পরিণত। ২০১৯ এর কোয়ালিফাইং রাউন্ড পার করে দলকে নিয়ে এসেছেন মূল মঞ্চে। ওমানের বিপক্ষে তার করা ৩৭ রান দলকে বাঁচিয়েছে বিপর্যয় থেকে। পরিবারের ক্রিকেট ঐতিহ্য প্রতিনিধিত্ব করতে আসা চার্লস নিজের অবদান নিয়ে কিছুটা গর্ব অনুভব করতেই পারেন।
বিশ্বকাপ শুরুর ঠিক আঠারো দিন আগে চার্লস হারিয়েছেন তার মাকে কুনেমো রুপাকে। তবুও চার্লস এসেছেন তার পরিবারের প্রতিনিধি হয়ে, দেশের ক্রিকেট ইতিহাসে নতুন কোন গল্প লিখতে।
পাপুয়া নিউ গিনি দলে প্রায় সবাই হানুয়াবাদা থেকে এলেও একজন এসেছেন রাজধানী পোর্ট মোর্সবি থেকেও বেশ দূর থেকে। আসাদ ভালা- পাপুয়া নিউ গিনি দলের ক্যাপ্টেন, স্বভাবে শান্ত, হাসিখুশি। মাঠে তার টেম্পারমেন্ট বরফ শীতল। কবজির মোচড়ে যিনি বল আছড়ে ফেলতে পছন্দ করেন এক্সট্রা কাভার ও ডিপ মিড উইকেটে দিয়ে। শচীন আর লারাকে দেখে যিনি নিজেও হতে চেয়েছিলেন একজন বিশ্বসেরা ব্যাটার।
আসাদ ভালার সঙ্গে বাংলাদেশের একটা কাকতালীয় সম্পর্ক আছে। পাপুয়া নিউ গিনির হয়ে তার ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল ২০০৪ অনুর্ধ-১৯ বিশ্বকাপে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে গ্রুপ পর্বের দ্বিতীয় ম্যাচে খেলেছিলেন ৮৪ রানের ইনিংস। সেবার বাংলাদেশের সঙ্গে খেলার সুযোগ ছিল না, এর মাঝে পার হয়ে গেছে আরো সতেরো বছর। ২০১৮ তে ভালাকে করা হয় জাতীয় দলের ক্যাপ্টেন। বিশ্বকাপ শুরুর আগে এক সাক্ষাৎকারে ভালা জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচের জন্যই সবচেয়ে বেশি মুখিয়ে আছেন তিনি।
‘ছেলেরা বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচের জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে। তাদের মত শীর্ষ দলের সঙ্গে আমাদের শক্তির পরীক্ষা একটা দারুণ ব্যাপার হবে, আর আমরাও বুঝতে পারব বিশ্বের সেরা দলগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমরা কতটা লড়াই করতে পারি’- আসাদ ভালার সেই অপেক্ষা অবশেষে ফুরাবে আগামীকাল। এই ম্যাচ বাংলাদেশের জন্য পরের পর্বে যাওয়ার উপলক্ষ্য হতে পারে শুধুমাত্র, তবে আসাদ ভালাদের এই পর্যন্ত আসতে বছরের পর বছর পোড়াতে হয়েছে কাঠখড়।
২০১৯ এ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শুরুর ঠিক আগে পাপুয়া নিউ গিনি হেরেছিল টানা আটটি ম্যাচ। এরকম শঙ্কার মেঘ নিয়ে টুর্নামেন্ট শুরু করা দল অবশ্য লিখেছিল ঘুরে দাঁড়ানোর এক গল্প, যার অন্যতম রূপকার আসাদ ভালা। ছয় ম্যাচে পাঁচ জয় নিয়ে মূল পর্বে জায়গা করে নেওয়া পাপুয়া নিউ গিনি দলে অলরাউন্ড পারফরম্যান্স ছিল ভালার, ১২১ স্ট্রাইক রেটে ১৯৭ রান, সঙ্গে মাত্র ৪ ইকোনমি রেটে ১০ উইকেট- এরকম পারফরম্যান্সে দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে পাপুয়া নিউ গিনিকে নিয়ে আসেন বিশ্বমঞ্চে। কিংবা বলা যেতে পারে, হানুয়াবাদা গ্রামকে তুলে আনেন বিশ্বকাপের বড় মঞ্চে।
যুবরাজের ছয় বলে ছয় ছক্কার রেকর্ড পুনরাবৃত্তি করার ইচ্ছা আছে ভালার। তবে দল তার কাছে সবচেয়ে বড়, জেতার জন্য দিতে চান নিজের সেরার চাইতেও একটু বেশি।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে না হলেও সহযোগী দেশ হিসেবে দু’বার সাক্ষাৎ হয়েছিল বাংলাদেশ-পাপুয়া নিউ গিনির, তবে সেটা একদিনের ম্যাচে। ১৯৮২ এর আইসিসি ট্রফিতে বাংলাদেশের বিপক্ষে শেষ হাসি হেসেছিল পাপুয়া নিউ গিনি, আর বাংলাদেশ সেই উপলক্ষ্য ফিরিয়ে দিয়েছিল ১৯৯৬ সালে, এসিসি ট্রফিতে তাদের বিপক্ষে জয় দিয়ে। এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন, লড়াইটা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মূল পর্বে ওঠার। সমীকরণ বাংলাদেশের জন্য সহজ, পাপুয়া নিউ গিনির জন্য অসম্ভব। তবে সাকিব-রিয়াদদের বিপক্ষে মাঠে নামার অধীর আগ্রহে থাকা আসাদ ভালাদের সামনে আকাশ ছোঁয়ার হাতছানি। চার্লস আমিনি লিখতে পারেন তার পরিবারের ক্রিকেট ঐতিহ্যে আরেকটি বীরত্বগাঁথা। পোর্ট মোর্সবির হানুয়াবাদ গ্রাম থেকে আসা দলটি চাইবে বিশ্বমঞ্চে লিখে যেতে তাদের নাম।