• টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০২১
  • " />

     

    নামিবিয়ার রূপকথা: একজন চিকিৎসক, একজন যাযাবর আর একটা বম্ব স্কোয়াডের গল্প

    নামিবিয়ার রূপকথা: একজন চিকিৎসক, একজন যাযাবর আর একটা বম্ব স্কোয়াডের গল্প    

    ভিন্ডহোক, নামিবিয়ার রাজধানী। সর্বসাকুল্যে দেশে মাত্র ২৫ লাখ মানুষ। রাজধানীর মাঝে ৯টি ক্রিকেট মাঠ,  ৫টি প্রিমিয়ার লিগ ক্লাব; ক্রিকেট অজনপ্রিয়, সাদাদের খেলা। এসব অবশ্য অনেকেই জানেন এখন, লেখালিখিও কম হয়নি। 

    ২০০৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপের সবচেয়ে ‘খর্বশক্তি’, ‘ছোট দেশ’ ছিল নামিবিয়া। ভিন্ডহোকের সীমানা পেরিয়ে ১৮ বছর পর সেই ছোট নামিবিয়াই শারজাহতে লিখে গেছে ক্রিকেট সুন্দর এক রোমান্টিক গল্প। সে গল্পের চরিত্র একজন কিংবা দুইজন নয়, গল্পের চরিত্র প্রত্যেকেরই আছে ছোট ছোট গল্প। শেখ জায়েদ আর শারজাহতে এসে সেগুলো মিলে জন্ম দিয়েছে এক বিশাল আখ্যান। 

     

    ********

    নামিবিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অর্জন হিসেবে আয়ারল্যান্ড-বধকেই হয়তো স্বীকৃতি দেওয়া হবে। যে অর্জনের স্বপ্ন বোনা হয়েছিল তিন বছর আগে, ২০১৮ সালের ১৮ই অক্টোবর। মাঝে দুঃস্বপ্ন হয়ে উকি দিচ্ছিল করোনাভাইরাসের প্রকোপ, আর বিলম্বে টুর্নামেন্ট শুরু হওয়ার যন্ত্রণা। ধৈর্য্য নিয়ে নামিবিয়া তবুও অপেক্ষা করেছে ২০২১ সালের ২২ অক্টোবরের জন্য।

    দুই বছর আগেও যেখানে তাদের কেন্দ্রীয় চুক্তির খেলোয়াড় ছিলেন মাত্র চারজন। আইসিসি’র ওয়ানডে স্ট্যাটাস পাওয়ার পর যেখানে যুক্ত হন আরো ১৩, সবমিলিয়ে ১৭ জন।

    কিংবা তারও আগের কথা, সাব-রিজিওনাল কোয়ালিফায়ারের অংশ হিসেবে বতসোয়ানার মাঠে যখন তাদের প্রথম ম্যাচ খেলতে হয়েছে এসওয়াতিনির (আগে সোয়াজিল্যান্ড হিসেবে পরিচিত) সঙ্গে। ২০১৮ এর অক্টোবর-নভেম্বরে চলা সে টুর্নামেন্টে আফ্রিকার মধ্যে দ্বিতীয় হয়েছিল তারা, স্বাগতিক বতসোয়ানা ছিল চ্যাম্পিয়ন। ছয় ম্যাচের মধ্যে পাঁচ জয়, ফলে টিকেটটাও মিলে গেল আফ্রিকান রিজিওনাল কোয়ালিফায়ারের। সেখানে আরো ছয়টি ম্যাচ।

    ছয়টি ম্যাচের দুইটি ভেসে গেল বৃষ্টিতে, আর চারটিতে জয়। রান-রেটে এগিয়ে থাকায় ২০১৯ এ উগান্ডায় হওয়া টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়নও বনে গেল ‘ঈগল’রা। এবার পরবর্তী যাত্রা- ওয়ার্ল্ড কোয়ালিফায়ার। 

    ছবি: সুপার ১২ এর পথে নামিবিয়ার যাত্রা

    গ্রুপ পর্বে ৪ জয়, ২টি হার। সুযোগ মিলল প্লে-অফে খেলার, প্রতিপক্ষ ওমান। প্রথমে ব্যাট করে ১৬১ রানের চ্যালেঞ্জিং স্কোর। ওমান যেখানে আসতে পারল মাত্র ১০৭ রান পর্যন্ত। 

    নামিবিয়া তখক্ষণে জেনে গেছে তারা অংশ নিচ্ছে ২০২০ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে, সেসময় পর্যন্ত তাদের সেরা সাফল্য! 

    মাঝে এক বছর পিছিয়ে বিশ্বকাপের গন্তব্য পাল্টালেও নামিবিয়ার গন্তব্য পাল্টায়নি। কোয়ালিফায়ারের সেমি আর তৃতীয় স্থানের প্লে অফ হারলেও ২০২১ বিশ্বকাপ টিকেটের কোন হেরফের হয়নি। শ্রীলংকার সঙ্গে আত্মসমর্পন হতে পারত দলের জন্য বড় ধাক্কা, সেটাও হয়নি।

    যেটা হওয়ার সেটাই হয়েছে, যে লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছিল তিন বছর আগে। ১১০০ দিনেরও বেশি সময় আর ২৪ টি ম্যাচ পর নেদারল্যান্ডস আর আয়ারল্যান্ডকে হারিয়ে তারা জায়গা করে নিয়ে আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মূল পর্বে। এত দীর্ঘ সময়ের নানা বাধা-অনিশ্চয়তার সময়ও ধৈর্য্য নিয়ে অপেক্ষা করেছে এই মুহূর্তের- নামিবিয়া ক্রিকেট দলের জন্য এ এক সম্মিলিত অর্জন। 

     

    ********

    রুডি ফন বুরেন- নামটা শুনে চট করে কিছু মনে পড়ে কী?

    নামিবিয়া যখন সবশেষ কোন আইসিসি টুর্নামেন্টে খেলেছিল, তখনও জন্ম হয়নি টি-টোয়েন্টির। ছিল না আইপিএল কিংবা বিগ ব্যাশ। অন্তত নামিবিয়া যে ক্রিকেট খেলত সেটা সাংবাদিক ছাড়া সাধারণ ক্রিকেট ভক্ত-সমর্থকদেরও জানার কথা ছিল না। না, সেবার তারা কোন চমক দেয়নি। ২০০৩ সালের সে নামিবিয়া শুধুই ছিল অন্য দলগুলোর রেকর্ড ভাঙ্গা-গড়ার উপলক্ষ্য মাত্র।

    ১৯৯২ সালে আইসিসির সহযোগী সদস্য হিসেবে যাত্রা শুরু নামিবিয়ার জন্য ২০০৩ বিশ্বকাপ ছিল সবচেয়ে বড় মঞ্চ। সেই বড় মঞ্চে এসে তারা পত্রিকার শিরোনাম হয়েছেন ঠিকই, কিছুটা হাস্যরসের পাত্র হয়ে। জিম্বাবুয়ে তাদের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে করেছিল ৩৪০ রানের পাহাড়সম স্কোর। পাকিস্তান তাদের বিপক্ষে জিতেছিল ১৭১ রানে, ভারত জয় পেয়েছিল ১৮১ রানে। আর সেবারের চ্যাম্পিয়ন, ‘ইনভিন্সিবল’ অজিরাতো আরেক কাঠি সরেস- গ্লেন ম্যাকগ্রা একাই সাত উইকেট নিয়ে করেছিলেন রেকর্ড, নামিবিয়ার বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়া পেয়েছিল সবচেয়ে বড় রানের ব্যবধানে জয়- ২৫৬ রানে জেতার যে রেকর্ড অবশ্য পরে ভারত নিজেদের করে নিয়েছিল বারমুডার বিপক্ষে ২৫৭ রানে জিতে। এত রেকর্ডের চাপে পিষ্ট নামিবিয়া দলে একজনই ছিলেন ব্যতিক্রম- রুডি ফন বুরেন, সেবারের নামিবিয়া দলের তারকা। ট্রেসকোথিক-নাসের-স্টুয়ার্টের ইংল্যান্ডের বিপক্ষে যিনি নিয়েছিলেন ৫ উইকেট।

    ছবি: 'ডাক্তার', 'রাগবি খেলোয়াড়' ও ক্রিকেটার- একের ভেতর তিন ফন বুরেন

    অথবা এর চেয়েও বড় এক কীর্তি আছে তার। ঠিক পরের ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে নেমেছিল নামিবিয়া। শচীন টেন্ডুলকার মাত্রই ছাড়িয়েছেন ১৫০ রানের মাইলফলক। কিন্তু হঠাতই রুডি ফন বুরেনের বলের লেন্থ ভুল পড়ে আচমকাই হয়েছিলেন বোল্ড! ভারত ৩১১ রান করতে যে দুইটি উইকেট হারিয়েছিল, সে দুইটিই ফন বুরেনের শিকার- আরেকজন ছিলেন ভিরেন্দর শেবাগ। ২০১৯ এ ওডিআই স্ট্যাটাস, কিংবা মূল পর্বে খেলার যোগ্যতা; অথবা সুপার ১২ খেলার টিকেট পাওয়ার আগে পুরো নামিবিয়া ক্রিকেটেরই সবচেয়ে বড় সাফল্য এতটুকুই- যা এসেছিল পেশায় পুরোদস্তুর এক ডাক্তারের হাত ধরে।

    সেই রুডি ফন বুরেন এখন নামিবিয়া ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট, যিনি নামিবিয়ার হয়ে ১৯৯৮ আর ২০০৩ সালে খেলেছেন রাগবি চ্যাম্পিয়নশিপও। মাত্র ২৫ লাখ মানুষের দেশে যেখানে মাত্র ৪৬০ জন পূর্ণবয়স্ক, আর হাজারখানেক বয়সভিত্তিক ক্রিকেটার- সেদেশের ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট হিসেবে বুরেনের জন্য এই সুপার ১২ এ জায়গা করে নেওয়ার সাফল্য ছাড়িয়ে গেছে তার আঠারো বছর আগের অর্জনও। ‘টেন্ডুলকারের উইকেট পাওয়াটা নিশ্চয়ই একটা দারুণ ব্যাপার ছিল, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পাঁচ উইকেটও। কিন্তু এর সঙ্গে [সুপার ১২] আর কিছুর তুলনা চলে না’- এক সাক্ষাৎকারে বলছিলেন আবেগাপ্লুত ফন বুরেন।

    ২০০৩ বিশ্বকাপে নামিবিয়ার ক্রিকেট দলের প্রাইজমানি ছিল ২০০ নামিবিয়ান ডলার, যা সে সময়ে হিসেব করলে দাঁড়ায় ১৩.৮০ ইউরো- বাংলাদেশি টাকায় ২০০৩ সালের হিসেবে যা দাঁড়াত ৮৭০ টাকা! অর্থাৎ ৬ ম্যাচ খেলে নামিবিয়ার প্রত্যেক ক্রিকেটার পেয়েছিলেন ৫২২০ টাকা করে।

    তার ষোল বছর পর, ২০১৯ সালে শুরু হয় নামিবিয়ার প্রথম পেশাদার ক্রিকেট বোর্ড। বোর্ড সভাপতি হয়ে সেই ২০০৩ বিশ্বকাপ দলের ফন বুরেন কেন্দ্রীয় চুক্তিতে আনেন নতুন আরো ১৩ জন ক্রিকেটার। লেস্টারশায়ারের সাবেক কোচ পিয়েরে ডি ব্রুইনকে এনেছেন দলের কোচ হিসেবে, আর সহকারী হিসেবে পেয়েছেন তার বন্ধু দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক পেসার অ্যালবি মরকেলকে। সবাইকে নিয়ে এমন এক ‘অ্যাডভেঞ্চার’কে নিঃসন্দেহে আর সবকিছুর উপরেই রাখতে চান ৪৯ বছর বয়সী ডাক্তার ও বোর্ড পরিচালক ফন বুরেন। গর্ব করে বলেন, সহযোগী দেশগুলোর মধ্যে ক্রিকেট অবকাঠামো নির্মাণে আইসিসির জন্য নামিবিয়া এক ‘মডেল’ বা আদর্শ দেশ।

     

    ********

    ডেভিড ভিসা। এক ‘যাযাবর’ ক্রিকেটার। কার্ল বারকেনস্টক, মিকাউ ডু প্রিস, ইয়ান ফ্রাইলিংক, রুবেন ট্রাম্পেলমান- এরাও প্রায় একই সূত্রে গাঁথা। 

    ৭৫ বছর দক্ষিণ আফ্রিকার অধীনে থাকার পর ১৯৯০ সালে স্বাধীনতা পায় নামিবিয়া। ভিন্ডহোক স্টেডিয়ামে দক্ষিণ আফ্রিকার পতাকা নামিয়ে সেখানে তোলা হয় লাল, নীল, সবুজ আর স্বর্নালী বর্ণে রাঙানো নামিবিয়া প্রজাতন্ত্রের পতাকা। 

    নামিবিয়ার স্বতন্ত্র অর্থনীতি এখনোও অবশ্য সীমানা ছাড়িয়ে সম্পর্ক ধরে রেখেছে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে। সীমানা ছাড়িয়ে ভিন্ডহোকের দিকে পা বাড়িয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার কিছু ক্রিকেটারও। রুডপোর্ট, সেঞ্চুরিয়ন, প্রিটোরিয়া থেকে জড়ো হয়েছেন ‘নতুন’ এক নামিবিয়া ক্রিকেট দলে।

    বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড ম্যাচটা সবেমাত্র শেষ হয়েছে। স্টেডিয়ামের বেশিরভাগ বাঙালি সমর্থক দল হারার ভাঙ্গা হৃদয় নিয়ে ছাড়ছিলেন গ্যালারি, আর অন্যদিকে পিচে হচ্ছিল চমকপ্রদ এক ঘটনা! 

    ম্যাচের প্রথম ইনিংসের প্রথম ওভারে রুবেল ট্রাম্পেলমানের তীক্ষ্ণ ইনসুইঙ্গারে নেই স্কটল্যান্ডের জর্জ মানসি, ক্যালাম ম্যাকলাউড, রিচি বেরিংটনের উইকেট। টি-টোয়েন্টি আন্তর্জাতিকের ইতিহাসে এমন ঘটনা মাত্র চতুর্থবার!

    একসময় রেকর্ডের উপলক্ষ্য নামিবিয়া এখন রেকর্ডবুকে লিখছে নিজেদের নাম। বলার অপেক্ষা রাখে না, সুপার ১২ এ উঠে নামিবিয়া নিজেদের প্রথম ম্যাচটাও জিতেছে ৪ উইকেটে। 

    ছবি: স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে এক ওভারে তিন উইকেট নেওয়া ট্রাম্পেলমান

    নামিবিয়াকে সুপার ১২ এর প্রথম ম্যাচে জয় এনে দেওয়া ট্রাম্পেলমানকে অবশ্য নামিবিয়ার জার্সিতে দেখতে পাওয়ার কথা না। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়া ডারবানে জন্ম নেওয়া এই দীর্ঘদেহী বাঁ হাতি পেসার বয়সভিত্তিক ক্রিকেট খেলেছেন নর্দার্নসের হয়ে। এদিকে নামিবিয়ার সহকারী কোচ দক্ষিণ আফ্রিকার অ্যালবি মরকেল বুঝে গিয়েছিলেন, নামিবিয়া দলের তুরুপের তাস হতে পারেন তিনি।

    ট্রাম্পেলমানের বাবা জন্মেছিলেন ভিন্ডহোকে। নামিবিয়ার জার্সিটাই তুলে নিলেন শেষমেষ। এসে লন্ডভন্ড করে গেলেন স্কটিশ টপ অর্ডার। 

    কিংবা কথা হতে পারে তারই সতীর্থ ইয়ান ফ্রাইলিংককে নিয়ে। দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্ম নেওয়া এই ক্রিকেটার দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে খেলেছেন অনুর্ধ-১৯ ক্রিকেট। ২০১৮ তে সিদ্ধান্ত নিয়ে বদলে ফেললেন দেশ আর জার্সি, বাবা নামিবিয়ায় জন্ম নেওয়ায় ‘ঈগল’দের হয়ে খেলার সুযোগ পেলেন। 

    টি-টোয়েন্টিতে এই ফ্রাইলিংকই নামিবিয়ার নিয়েছেন সবচেয়ে বেশি ৪২ উইকেট। রুডি ফন বুরেনের ১৬ বছর পর দ্বিতীয় নামিবিয়ান ক্রিকেটার হিসেবে তিনি পেয়েছিলেন ওয়ানডে পাঁচ উইকেট।

    ডেভিড ভিসা, যাযাবর এক ক্রিকেটার যিনি কখনো কোথাও থিতু হননি তার ক্যারিয়ারে। যার ঝুলিতে ২৭০টিরও বেশি টি-টোয়েন্টি খেলার অভিজ্ঞতা, তিনিই ছিলেন নামিবিয়া দলের জন্য দাবার গুটির শেষ চাল, কিংবা ‘মিসিং পিস অফ দ্য পাজল’। ৩৬ বছর বয়সের তুখোড় আর অভিজ্ঞ তার যাযাবর জীবনের ইতি টেনেছেন নামিবিয়ায় এসে থিতু হয়ে। নামিবিয়াকে বড় মঞ্চে সাফল্য এনে দেওয়াটা ছিল তার জন্য একটা স্বপ্ন, যেটা তিনি পূরণ করেও ফেলেছেন।

    ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে ভিসা পরিচিত নাম। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ তো আছেই; বিগ ব্যাশ, সিপিএল, দ্য হান্ড্রেড- সব ফরম্যাটের ভেতর -বাইরেটা তার চেনা। দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে নেমেছিলেন ২৬টি টি-টোয়েন্টিতে, যাকে একসময় ভাবা হয়েছিল জ্যাক ক্যালিসের ‘রিপ্লেসমেন্ট’। সে তকমাটা হয়তো বেশিদিন টিকেনি, কিন্তু যখন যে দলে খেলেছেন, ব্যাট-বলে ছিলেন দারুণ কার্যকরী।

    ছবি: যাযাবর ডেভিড ভিসা

    কতটা কার্যকরী সেটা পরিসংখ্যান দিয়ে কিছুটা যাচাই করা যেতে পারে। সবশেষ তিন বছরে টি-টোয়েন্টিতে সর্বোচ্চ স্ট্রাইক রেট আর বোলিংয়ে কম ইকোনমি রেট ধরে রাখা মাত্র চারজন ক্রিকেটারের মাঝে একজন ডেভিড ভিসা। এই তালিকার বাকি তিনজন মোহাম্মদ নবী, আন্দ্রে রাসেল, ড্যান ক্রিশ্চিয়ানরা যেখানে প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেট দলের সদস্য, সেখানে ভিসা নামিবিয়ার হয়ে খেলা শুরুই করেছেন মাত্র কয়েকদিন আগে। কলপ্যাক চুক্তি বাতিল করে এখন তিনি নামিবিয়ারই স্থায়ী। ভিসার যাযাবর জীবনের অভিজ্ঞতাটা ঠিকই নামিবিয়াকে অনুপ্রেরণা দিচ্ছে তাদের যাত্রাপথে বড় স্বপ্ন দেখার জন্য।

     

    ********

    ডেভিড ভিসা, গেরহার্ড এরাসমাস, জেজে স্মিট- ‘দ্য বম্ব স্কোয়াড’।

    নামটা নামিবিয়া দলের কোচ পিটার ডি ব্রুইনের দেওয়া। নামিবিয়া দলের ‘মেরুদণ্ড’ যেন এই ত্রয়ী। মাঠে কিংবা মাঠের বাইরে যারা দলকে নিয়ে এসেছেন এত দূর।

    ২৬ বছর বয়সী গেরহার্ড এরাসমাস, নামিবিয়া দলের অধিনায়ক- বম্ব স্কোয়াডের ‘অ্যাংকর’। ২০১১ সাল থেকে যিনি আছেন নামিবিয়া ক্রিকেটের সঙ্গে। টি-টোয়েন্টি বৈশ্বিক কোয়ালিফায়ারে যিনি পেয়ে যান নামিবিয়া দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব। 

    ২০০৩ সালে নামিবিয়াকে যখন বিশ্বকাপে খেলতে দেখেছিলেন, তখন তার বয়স মাত্র ৯। আইনে স্নাতক এরাসমাস হতে পারতেন একজন আইনজীবী, অন্তত ক্যারিয়ারের লক্ষ্য সেটাই ছিল। ক্রিকেট খেলে যে নামিবিয়ায় আর পূর্ণাঙ্গ ক্যারিয়ার গড়া যায় না। 

    সব বদলে গেল ২০১৯ সালে, নামিবিয়া ফিরে পেল ওয়ানডে স্ট্যাটাস। এরাসমাসও বনে গেলেন পুরোদস্তুর পেশাদার নামিবিয়ার ক্রিকেটার, এলেন কেন্দ্রীয় চুক্তির ভেতরে। এরপর হলো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বৈশ্বিক কোয়ালিফায়ার, যে টুর্নামেন্টে এরাসমাস ছিলেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। নামিবিয়া দলের হয়ে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকও তিনি।

    বম্ব স্কোয়াডের ‘ফিনিশার’ জেজে স্মিট। এরাসমাস ব্যাট হাতে এক প্রান্ত থেকে ধীরে সংগ্রহ করেছেন রান, অন্য প্রান্তে স্মিট ছিলেন বিধ্বংসী। সে টুর্নামেন্টে সবচেয়ে বেশি ছয় এসেছে তার ব্যাট থেকে। ২২ টি-টোয়েন্টি খেলে দেড়শ স্ট্রাইক রেট, নামিবিয়া দলে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ; তবে অন্যদের থেকে গড় তারই সবচেয়ে বেশি- ৩৮.২৭। বল হাতে ২২ উইকেট, নিয়মিত আনেন ব্রেক-থ্রু। 

    ভিসার ব্যাপারে নতুন করে কিছু বলার নেই। তিনি হলেন বম্ব স্কোয়াডের ‘ক্লিনার’- যখন দলের যা প্রয়োজন, সেটা সম্ভব করেন ব্যাট-বল-ফিল্ডিংয়ে।

    নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ১৬৫ তাড়া করে জেতা সহজ ছিল না, সহজ বানিয়ে দিয়েছিল নামিবিয়ার বম্ব স্কোয়াডই। এরাসমাসের ২২ বলে ৩২ রান, আর অন্যদিকে ভিসার ৪০ বলে বিধ্বংসী ৬৬ রানের ইনিংস। ডাচ বোলারদেরকে একের পর এক ছয় মেরে ম্যাচটা ছিনিয়ে আনার কাজটা করেছিলেন ভিসাই।

    এরাসমাস শেষ পর্যন্ত ছিলেন না। কাজটা শেষ করেছিলেন জেজে স্মিট, তাও পরপর দুই বলে দুইটি চার মেরে। 

    কিংবা সেই স্বপ্ন ছোঁয়ার ম্যাচে শারজাহ’র ফ্ল্যাট ট্র্যাকে আয়ারল্যান্ডের দেওয়া ১২৬ রান তাড়া করা। স্মিট আর ভিসা বোলিংয়েও পেয়েছিলেন উইকেট। ব্যাটিংয়ে এরাসমাসের অপরাজিত ৫৩ আর ভিসার ২৮ রানই ছিল যথেষ্ট। 

    ‘দ্য বম্ব স্কোয়াড’, নামিবিয়ার দুই দক্ষিণ আফ্রিকার কোচ, ফ্রাইলিংক, ট্রাম্পেলমানদের অবশ্য দম ফেলার ফুরসত নেই। সুপার ১২ খেলতে হবে আরো চারটি ম্যাচ; সামনে ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান আর নিউজিল্যান্ডকে সামলানোর চ্যালেঞ্জ। ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সঙ্গে মিলে গেছে ২০২২ অস্ট্রেলিয়া টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের টিকেটও। কিন্তু বাকি আছে ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপের কোয়ালিফায়ার খেলার ধকল, দুই বছরে প্রায় ৩৬ টি ওয়ানডে ম্যাচ। অধিনায়ক এরাসমাসের চোখ এবার সেদিকেই।

     

    ********

    ২২ গজের পিচে কান্না পাওয়াটা আর দশটা স্বাভাবিক ঘটনার মত নয়। আপনার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়া আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না, বলছিলেন গেরহার্ড এরাসমাস। এটা এমন বিশেষ কোন প্রাপ্তির জন্য, যার বহিঃপ্রকাশ শুধু চোখের জলেই হতে পারে- আর অন্যভাবে এটা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। 

    ছোট দেশের বড় ক্রিকেটাররা সেদিন আক্ষরিক অর্থেই ‘বিশাল’ কিছুই করে ফেলেছিলেন। এরাসমাস, ভিসার ‘আনন্দ অশ্রু’ এখন এক ইতিহাসের অংশ।