'হচ্ছে না' নাকি বাংলাদেশ 'পারছে না'?
‘আমাদের দ্বারা হচ্ছে না’
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে যা খেলল বাংলাদেশ, এমন ম্যাচের পর প্রশ্নের অভাব থাকে না! কিন্ত নাসুম আহমেদের কাছে যে উত্তরের বড্ড অভাব ছিল। উত্তর থাকবেই বা কি করে! তিনি তো আর দলের পরিকল্পনা বা গেমপ্ল্যানের সাথে জড়িত থাকেন না। যারা থাকেন, সাপোর্ট স্টাফ, অধিনায়ক, কিংবা সিনিয়র কোন ক্রিকেটারই না এসে পাঠিয়ে দিলেন ‘বেচারা’ নাসুমকে! হ্যাঁ, নাসুম যেন বেচারাই বনে গিয়েছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে এসে ঘুরেফিরে আসছিলেন একই কথায়, ‘চেষ্টা করছি। আমাদের দ্বারা হচ্ছে না।’
হচ্ছে না, নাকি পারছেন না, এমন এক প্রশ্নও করে বসলেন এক সাংবাদিক। তিনি সেবারও বললেন, ‘আসলে হচ্ছে না’। কিন্ত পারতে হলে তো আগে সামর্থ্য থাকতে হয়, এরপরই না আসে পারা না পারার প্রশ্ন। বাংলাদেশের সামর্থ্য কি এতটুকুই, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। অবশ্য অস্বীকার করার উপায় নেই যে এর চাইতে খুব বেশি সামর্থ্যও যে নেই বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি দলের! স্কটল্যান্ডের মতো দলের সাথে ‘যাচ্ছেতাই’ অবস্থায় হয়, ওমানের সাথেও পরাজয় উঁকি দিয়ে যায়, শ্রীলংকাও দিয়ে গেল শিক্ষা। ইংল্যান্ডের সাথ বেরিয়ে এলো আমাদের ‘আসল’ রুপ! আমাদের সামর্থ্যের সাথে পরিচয় ঘটে গেল সে ম্যাচেই।
টি-টোয়েন্টিতে পাওয়ার হিটিংয়ের গুরুত্ব সবারই জানা আছে। তবে সেই সাথে যে ‘বুদ্ধিমান’ও হতে হয়! ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যানদের ‘ভয়ঙ্কর’ বলে সুনাম আছে, অবশ্য তারা বিধ্বংসী নাম কুড়িয়েছেন ‘স্মার্ট’ ব্যাটিংয়ের বদৌলতেই! বোলারকে পড়ার চেষ্টা করেন, ফিল্ডিংয়ের সাথে খেলানেলা করেন। এলোপাতাড়ি ব্যাট না চালিয়ে ভালো বল আসলে সম্মান জানাতে যেমন জানেন, তেমনি জানেন ভালো বলকে খারাপ বানাতেও, খেলেন বোলারদের চিন্তাভাবনার সাথেও। প্রতিপক্ষের ফিল্ডিং সাজানো দেখে অনেক সময়ই ব্যাটসম্যান তার পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণ করেন। মঈন আলীর উপর প্রথম ওভারেই চড়াও হলেও মরগান লিটনের ‘আক্রমণাত্মক’ মনোভাব দেখেই তাকে আবার আনেন। হয়তো বুঝে গিয়েছিলেন লিটনের উদ্দেশ্য, মঈন আলীর উপর ঝাপিয়ে পড়া!
লিটনের আউটের বলের আগেই মরগান অফ সাইডের পাঁচ ফিল্ডারের একজনকে মিডউইকেটে নিয়ে আসেন। বাইরে থাকা দুজন ছিলেন স্কোয়ার লেগ ও ওয়াইড লং অনে। আর অফ সাইডে একজন কমে হলেন চারজন। লিটন অফ সাইডের দিকে সরে গিয়ে সুইপ খেলার সিদ্ধান্তই নিলেন। মঈন আগের দুই বাউন্ডারি বলের চেয়ে একটু পেছনে করলেন, শর্ট ফাইন লেগের উপর দিয়ে মারার চেষ্টায় টপ এজে শূন্যে ক্যাচ দিলেন লিটন। অথচ বাইরে থাকা দুই ফিল্ডার যে পাশে ছিলেন, সেই লেগ সাইড বাউন্ডারি ছিল তুলনামুলকভাবে বড়ও। কম ফিল্ডার থাকলেই যে সেদিকেই খেলতো হবে, তা না, কিন্ত ঝুঁকি না নিয়ে অফ সাইডে খেলার পথ বেছে নেওয়াটাই হতো বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত! কিংবা লেগ সাইডে ঠেলে দিয়ে সিঙ্গেল নেওয়ার অপশন ছিল! কিন্ত লিটনের আরেক সমস্যা যেটা হচ্ছে, বিশ্বকাপের শুরু থেকেই দেখা যাচ্ছে গ্যাপ খুঁজে নিতে ব্যর্থ হচ্ছেন তিনি। সে সিদ্ধান্তের পেছনে এ কারণটাও হয়তো কাজ করতে পারে! অপর প্রান্তে নাঈম 'স্লো' খেলায় আক্রমণের দায়িত্বটাও তার উপরই বর্তায়! উইকেট হারানোর পর তার সঙ্গী নাঈমও সে ওভারেই মারতে গেলেন, পারলেন না ইনফিল্ডটাই ক্লিয়ার করতে। বাংলাদেশ যে ‘স্মার্ট’ ব্যাটিং করতে পারে না, এ দুই উদাহরণই তার পক্ষে সাক্ষ্য দিচ্ছে!
ধারাভাষ্যে মাইকেল আথারটন বলছিলেন, সাধারণতই বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানদের বাউন্ডারি খুঁজে নিতে কষ্ট হয়, নাকি শুধুই এ দলের সমস্যা হচ্ছে? উত্তর তো সবারই জানা, আতহার আলীও বলেছেন, আমাদের পাওয়ার হিটারের অভাব আছে। সোহানকে ভাবা হয় সেরকমই একজন! কিন্ত আথারটন তার কিছুই দেখতে পারলেন না! শেষমেশ যে ১২৫ রান করতে পেরেছিল বাংলাদেশ তাতে ডট ছিল পঞ্চাশটিরও বেশি। তার মানে, পাওয়ার হিটিংয়ের বাইরে বাংলাদেশের আরও বড় সমস্যা যে হচ্ছে সিঙ্গেল বের করতেই! অর্থাৎ, গলদ গোড়াতেই! আর রানিং বিট্যুইন দ্যা উইকেট পারদর্শীতারও যে সফলতায় অংশীদারিত্ব থাকতে পারে, সেটি তো দেখিয়েই দিল পাকিস্তান!
ম্যাচের আগের দিনই বোলিং কোচ ওটিস গিবসন বলেছিলেন, 'ইংল্যান্ডের ব্যাটাররা তোমাকে মারবে, কিন্ত সুযোগও দিবে, সেজন্য স্থির থেকে ভালো জায়গায় বল করে যেতে হবে'। বোলিংটা নিয়ে আমাদের আস্থা ব্যাটিংয়ের তুলনায় ছিল একটু বেশি। কিন্ত ইংল্যান্ড ছেলেখেলা করলো বোলিংয়ের সাথেও। ৩৫ বল হাতে রেখেই যে জিতেছে ইংলিশরা, তাতে বরং বাংলাদেশের ছন্নছাড়া বোলিংয়েরও কিছুটা অবদান আছে! ইংল্যান্ডের সাথে ১২৫ রান ডিফেন্ড করাটা অসাধ্যের মধ্যেই পড়ে ঠিক, তবু লড়ে যাওয়ার মনোভাব থাকার আশা করাই উচিত। বাংলাদেশকে দেখে মনে হয়নি, বাংলাদেশ সে মনোভাবেই নেমেছে মাঠে। অথচ ৫৫ রানের পুঁজি নিয়েও এই ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে লড়তে দেখা গেছে সর্বোচ্চ দিয়ে!
৫৫ রানে অলআউট হওয়া ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে এসে প্রশ্নবাণের মুখোমুখি হয়েছেন পোলার্ড, কিন্ত শক্ত মুখে কঠিন উত্তরের বদলে তিনি হাসিমুখেই সব জবাব দিয়েছেন। মেনে নিয়েছেন, তারা খারাপ খেলেছেন, এবং সে ম্যাচ পেছনে ফেলে সামনেই অগ্রসর হতে চান। পেশাদারিত্ব শুধুই যে মাঠে নয়, মাঠের বাইরেও, সেটিই দেখিয়ে দিলেন পোলার্ড। আর বাংলাদেশ কিনা পাঠিয়ে দিল সংবাদ সম্মেলনে সাধারণত অনভ্যস্ত একজনকেই! কারণ একটাই, 'প্রফেশনাল' হয়েও প্রফেশনালদের মতো সমালোচনা নিতে পারা! কিন্ত ক্রিকেটারদের জীবনে তো সমালোচনা অবিচ্ছেদ্য একটা অংশই! খারাপ খেললে সমালোচনা হবে, ক্রিকেটাররা সে বুলি আওড়ালেও তা কতটুকু মানেন সে নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ থেকে যায়! আর এতেই তো ফুটে উঠে বাংলার 'আসল' রুপ- মাঠেও যেমন, মাঠের বাইরেও তেমন!
মিরপুরে অস্ট্রেলিয়ার নাজেহাল অবস্থা। এরপর দ্বিতীয় সারির কিউদেরও একই হাল। বাংলাদেশের স্বপ্নের সীমানায় তাই ঢুকে পড়ে বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল। অবশ্য এই স্বপ্ন বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি দলের শক্তির বিচারেই জন্মায়নি! কিছু জয় দেখে জনমানষের মনে সেমিফাইনালের স্বপ্ন উঁকি দিয়েছিল, তো কেউ কেউ 'পিচ' নিয়ে এতটাই বিরক্ত ছিলেন যে কখনো সুপার টুয়েলভের আগেই বাংলাদেশের বিদায় চেয়ে বসেছেন! কিন্ত সেই অস্ট্রেলিয়া সিরিজ বা নিউজিল্যান্ডের সাথে সিরিজেই শুধু ব্যাটিং পিচে খেললেই যে আহামরি পরিবর্তন চলে আসতো, তাও বলা যায় না! কারণ পার্থক্যটা যে মূলেই, দক্ষতায়!
ইংলিশরা তো দেখিয়ে দিয়ে গেল তাই! যে ইংলিশরা ২০১৫ বিশ্বকাপে আমাদের সাথেই হারের পর তাদের খেলায় এনেছিল আমূল পরিবর্তন, পরিকল্পনার সুফল ভোগা ইংল্যান্ডের সাথেই এমন হারের পর আমাদের গায়েও লাগুক পরিবর্তনের হাওয়া, অবশ্যই তা পরিকল্পনার মোড়কে! তবেই আমরা সত্যিকার অর্থেই স্বপ্ন দেখতে পারি। বাংলাদেশের দলটা দেখেই তখন আমরা স্বপ্ন দেখতে পারবো! ইংলিশরা যেমন তাদের এই দল দেখেই স্বপ্ন দেখতে পারে!
ইংলিশদের সাদা বলের বিপ্লবের গল্পে যে বাংলাদেশেরও একটা জায়গা আছে, ইংল্যান্ডেরও তেমনি থাকুক বাংলাদেশের গল্পে!