• টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০২১
  • " />

     

    টি-টোয়েন্টিতে আফগানিস্তান ব্র্যান্ড: স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ

    টি-টোয়েন্টিতে আফগানিস্তান ব্র্যান্ড: স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ    

    ‘আফগানিস্তানে একমাত্র সুখের বিষয় হচ্ছে ক্রিকেট। আমরা যদি এই টুর্নামেন্টে ভালো করি, তাহলে ভক্তরা সত্যিই খুশি হবে এবং অনেকের মুখেই হাসি ফুটে উঠবে। আর ইন শা আল্লাহ সবকিছু বদলেও যাবে।’ 

    আফগানিস্তানের অস্থিতিশীল অবস্থায় মোহাম্মদ নবী, রশিদরা কদিন আগেও টুইটারে দেশে শান্তির কামনা জানিয়েছিলেন। তালেবান শাসনে অবশ্য মেয়েদের ক্রিকেটে বিধিনিষেধ থাকলেও ছেলেরা তা থেকে মুক্ত। বিশ্বকাপে তাদের অংশগ্রহণ নিয়ে কিছুটা ধোঁয়াশা থাকলেও আইসিসি আফগানিস্তানকে গ্রিন সিগন্যাল দিতে অসম্মতি জানায়নি। বিশ্বকাপের মাসখানেক আগে যদিও স্কোয়াড ঘোষণার পর তাদের অধিনায়ক রশিদ খান দল নির্বাচনে তাকে প্রাধান্য না দেওয়ার অভিযোগে অধিনায়কত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন। তাঁর পরিবর্তে অধিনায়কত্বের ভার কাঁধে নেওয়া মোহাম্মদ নবী বিশ্বকাপের আগেই বলেছিলেন উপরের কথাগুলো।

    উপমহাদেশের ক্রিকেটপাগল অন্য সব দেশের মতো এই একটা জায়গায় এখন আফগানিস্তানও এক- ক্রিকেটই পারে দেশটাকে ঐক্যবদ্ধ করতে। নবী যেমন বলছিলেন, আফগানিস্তানে এখন সুখ বলতেই ক্রিকেট, বিশ্বকাপে তাই তাদের মুখে হাসি ফুটাতে চান ক্রিকেট দিয়েই! 

    ****

    টি-টোয়েন্টিতে আপনি অনেক ধরনের দল দেখতে পাবেন। কেউ বাউন্ডারি হিটিংকে ঘিরে কৌশল সাজায় তো কেউ স্ট্রাইক রোটেটে প্রাধান্য দিয়ে। একেক দল খেলে একেক দর্শনে, একেক দলের খেলার স্টাইল থাকে একেকরকম। আবার একই ধরনের স্টাইলে দুই দলের খেলাটাও অতিস্বাভাবিক বিষয়। যেমন, ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলার ধরনের ছাপ পাওয়া যায় আফগানিস্তানে। অবশ্য টি-টোয়েন্টির যে দলই যেভাবে খেলতে চাক না কেন, সেটা নির্ভর করে তাদের সম্পদের উপর। আবার অনেক সময় নির্দিষ্ট ধরনে খেলার জন্য সম্পদ গড়ে তুলাও হয়ে সেভাবে!

    হাই রিস্ক, হাই রিওয়ার্ড- আফগানদের ওয়েস্ট ইন্ডিজের কৌশলে খেলার কারণ মুলত তাদের সম্পদ। বর্তমান হেড কোচ লেন্স ক্লুজনার বলছিলেন, আফগানিস্তানের অনেক ক্রিকেটারের ক্রিকেটের হাতেখড়িটা একেবারে ক্রিকেট গ্রামার মেনে হওয়ার সুযোগটা হয়নি। টেপ বল, টেনিস বল থেকে অনেক এসেছে, যেখানে ছয়-চার মারাই মূল উদ্দেশ্য ছিল। আফগানিস্তানের অনেক অভিজ্ঞ ক্রিকেটারের ক্ষেত্রেই কথাটা সত্য। শাহজাদ-জাযাইদের খেলাটাও ঠিক সেরকমই। 

    আফগানিস্তান তাই ‘ডট দাও, কিন্ত বাউন্ডারি চাই’ কৌশলে টিকে থেকেছে। এক পরিসংখ্যানে তার প্রমাণও পাওয়া যায়। ২০১৬ সাল থেকে ২০২১ বিশ্বকাপের মাঝের সময়ে আফগানিস্তান ডট দিয়েছে ৩৮.১২% বল, কিন্ত প্রতি ছয়ে আবার বল নিয়েছে মাত্র ১৪.২৮টি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রতি ছয়ে লেগেছে মাত্রই ১২.৯১ বল, ডট দিয়েছে ৪৩.২৪% বল। সুপার টুয়েলভের সব দলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ডট বল পার্সেন্টেজ ওয়েস্ট ইন্ডিজের, কিন্ত প্রতি ছয়ে সবচেয়ে কম বল নিয়েছেও তারা। এই হিসাবে তাদের পরেই আফগানিস্তানের অবস্থান। অর্থাৎ ডট দাও সমস্যা নেই, বাউন্ডারি দিয়ে তা পুষিয়ে দাও!

    'বাউন্ডারি-হিটিং এবং প্রতিপক্ষকে বাউন্ডারির হিসাবে ছাড়িয়ে যাওয়াটা টি-টোয়েন্টিতে সফল হওয়ার সম্ভাবনার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।' আফগানিস্তানের সঙ্গে বিশ্বকাপে কনসালটেন্ট কোচ হিসেবে যোগ দেওয়া ২০১০ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ী কোচ এন্ডি ফ্লাওয়ারের দর্শনের সাথেও মিলে যায় তা। 

    ****

    ছক্কা-হিটিং কেন্দ্রিক মনোভাব অবশ্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণই। এবং সেটা জেনেই দলগুলো সেভাবে খেলে। অনেক সময় বেশিরভাগ ক্রিকেটারদের খেলার ধরনটাই সেরকম থাকে বলে তাতে বদল আনাও কষ্টকর হয়ে পড়ে। তবে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয় চ্যালেঞ্জিং কন্ডিশনে, কোয়ালিটি আক্রমণের সামনে। শামির সুইংয়ের সাথে বুমরাহর পেসের সঙ্গে বিচক্ষণতায় দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন জাযাই। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচেও মিলনে-বোল্টদের বাউন্সারে কুপোকাত হতে হয়েছে তাদের। পাকিস্তানের সঙ্গেও এই এপ্রোচে হিতে বিপরীত হয়েছিল। ৫৩ রানেই ৬ উইকেট হারিয়ে বিপদে পড়া আফগানিস্তানকে উদ্ধার করেছিলেন নবী-নাইব মিলে।

    তুলনামুলক দুর্বল বোলিং অ্যাটাকের সামনে আফগানদের এই গেম সফল হলেও বিপদে পড়তে হয় ভালো আক্রমণের সামনে। আফগানিস্তান দ্রুত উইকেট হারিয়ে অনেকসমই ঘুরে দাড়াতে পারেনি সেজন্যে। নিয়মিত ভালো বোলিং আক্রমণের মোকাবিলা না করারও এতে প্রভাব থাকতে পারে। তবে তাদের অনেক ক্রিকেটারই ফ্র‍্যাঞ্চাইজি লিগে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পান, সেদিক দিয়ে আবার তারা সে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারছেন।

    ১৮ বলে ফিফটি হাঁকানোর পরে শোয়েব মালিক বলেছিলেন, শেষ ওভারগুলোয় তার মাথায় ছিল, বাউন্ডারি পেলে পেলাম, কোনমতেই ডট দেওয়া যাবে না! স্ট্রাইক রোটেশনের গুরুত্ব আসলে কোনমতেই কমার নয়। কোচ ক্লুজনারেরও ভাবনায় আছে, বাউন্ডারি হিটিংকে প্রাধান্য দেওয়ার সাথে সাথে স্ট্রাইক রোটেটে মনযোগী হওয়ার ব্যাপারটা। এ নিয়ে কাজও করছেন তিনি৷ রাহমানুল্লাহ গুরবাজ, নাজিবুল্লাহ জাদরানদের খেলায় তা কিছুটা ফুটেও উঠেছে। 

    ****

    নাভিন-উল-হক সিপিএল,এলপিএল, ব্লাস্ট ফ্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে ঘুরে বেড়িয়েছেন। গেলবারের ইংল্যান্ডের টি-টোয়েন্টি ঘরোয়া লিগ ব্লাস্ট মৌসুমে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী ছিলেন তিনি। বেশ কয়েকটা ভ্যারিয়েশন আছে তার অস্ত্রাগারে। জাযাই-শাহজাদরাও ক্রিকেটবিশ্বে অপরিচিত কেউ নয়। উঠতি তরুণ রাহমানুল্লাহ গুরবাজ দেড়শোর বেশি স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করেন। বিপিএল, টি-টেন এসব লিগেও খেলা হয়ে গেছে তার।

    আফগানিস্তান ক্রিকেটের যেমন একটা গল্প আছে, আফগানিস্তানের দলেরও সবারই আছে। হামিদ হাসানের সঙ্গে ইনজুরির সখ্যতা ছিল বেশ। ২০১৯ সালের বিশ্বকাপে পাকিস্তানের সাথে ম্যাচে হেরে অবসর নিয়েছিলেন। সে বিশ্বকাপেই ধারাভাষ্যেও যোগ দিয়েছিলেন। আর সেসবের ফাকে ট্রেনিংটাও চালিয়ে গেছেন। যার সুফলের প্রমাণ, পাচঁ বছর পর আবার তিনি ফিরেছেন জাতীয় দলে। বয়সের ভারে রান আপ কমাতে হয়েছে, তবে গতিতে হেরফের ঘটেনি। আফগানিস্তানের কিংবদন্তি আসগর আফগান যেদিন অবসর নিলেন, সেদিন সেই ২০১৬ বিশ্বকাপের পর দুই গালে আফগানিস্তানের পতাকা নিয়ে আফগানিস্তানের জার্সিতে আরেকটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলতে নামলেন হামিদ, মুজিবের ইনজুরিতে সুযোগ পেয়ে একশো চল্লিশের বেশি গতির ইয়র্কারে মুন্সিয়ানা দেখিয়ে ৪ ওভারে মাত্র ৯ রান দিয়ে নিয়ে নিলেন ৩ উইকেট। নবী-রশিদ-মুজিব ত্রয়ী বাদে সবমিলিয়ে আফগানিস্তান দলটা কম শক্তিশালী ছিল না। এ দলের বাইরে থাকা কাইস ও নূর নিয়মিতই বিগ ব্যাশে খেলে থাকেন। 

    স্কটল্যান্ড-নামিবিয়ার সাথে ম্যাচেই তারা দেখিয়ে দিয়েছে- কেন তারা সেমিফাইনালে চোখ রাখার সাহস করে। পাকিস্তানের সঙ্গে ম্যাচেও একটা সময় তারা জয়ই দেখতে পাচ্ছিল। শেষ দুই ওভারে যখন ২৪ লাগত, আসিফ আলী এক ওভারেই তা নিয়ে নিলেন। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে রোহিত-রাহুলদের ভালো ব্যাটিংয়ের সাথে দায় আছে আফগানদের এলোমেলো বোলিংয়েরও। ২১১ রান লক্ষ্যতাড়ায় ব্যাটারদের আর কিছু করার থাকে না! পাকিস্তানের সাথে ম্যাচেও ব্যাটিংয়ে বিপদে পড়লেও কোনমতে উদ্ধার করেছিলেন নবী-নাইব। তবে ১৪৭ রানের পুঁজি নিয়েও জয়ের এত কাছে যেতে পেরেছিলো বোলিংয়ের কারণেই। নিউজিল্যান্ডের সাথে ম্যাচেও তাদের ভুগিয়েছে সেই ব্যাটিংই। নাজিব ৭৩ করলেন বলে আফগানিস্তান পৌছুতে পেরেছিল ১২৪ পর্যন্ত। 

    স্পিন আক্রমণ বেশ শক্তিশালী হলেও পেস আক্রমণ সামর্থ্যের প্রমাণ রাখতে পারেনি। নাভিন নামিবিয়ার সাথে ২৪ রানে ৩ উইকেট নিলেও সবমিলিয়ে তার ইকোনমি ছিল ৯। হামিদ নামিবিয়া ম্যাচ বাদে আর কোন উইকেট নিতে না পারলেও তার ইকোনমি ৫.১৮ এর উপরে যায়নি। করিম জানাত পাকিস্তানের বিপক্ষে 'আসিফ আলীর ম্যাচ' এর দিনেও আগের তিন ওভারে ২৪ রান দিয়ে তার শেষ ওভার করতে এসে দিয়ে দিয়েছিলেন ২৪ রান। ওই ওভারের পরের তিন ম্যাচ মিলে তিনি করতে পেরেছেন মাত্র তিন ওভার! মুজিবকে ইনজুরিতে ভারতের বিরুদ্ধে বড় ম্যাচে হারিয়েছে তারা৷ আফগানিস্তানের স্পিনত্রয়ী স্বভাবতই করেছে ভালো। যদিও বোলার নবী তেমন প্রভাব রাখতে পারেননি। ওভারপ্রতি ৮.০৮ রান দিয়ে নিয়েছেন এক উইকেট! 

    ব্যাটিংয়ে টপ অর্ডারের তিন ব্যাটসম্যানের মধ্যে সর্বোচ্চ স্ট্রাইক রেট ছিল গুরবাজের ১১৯.৭১। শাহজাদ, জাযাই, গুরবাজের সম্মিলিত স্ট্রাইক রেট ছিল ১১৪.২৮। পাচঁ ম্যাচ করে খেলে কেউই একশের বেশি রান করতে পারেনি। 

    ****

    আফগানিস্তানের ক্রিকেটাররা তাদের দর্শকদের কথা ভাবে, লেন্স ক্লুজনার বলেছিলেন এক সাক্ষাৎকারে। নবী-রশিদরা আফগানিস্তানের দর্শকদের সেমিফাইনালের স্বপ্ন পূরণ করতে পারেননি। তবে তারা তাদের দর্শকদের হাসিমুখ করার অনেক মুহুর্তই এনে দিয়েছেন। রশিদ যখন র‍্যাংকিংয়ের নাম্বার ওয়ান ব্যাটসম্যানের স্টাম্প ভেঙ্গে দিলেন, কিংবা স্কটল্যান্ডের সাথে যখন রশিদ-মুজিব খেলানেলা করলেন, অথবা শামিকে যখন গুরবাজ পরপর দুই বলে সীমানা ছাড়া করলেন…

    নবী আশা করেছিলেন, 'সবকিছু বদলে যাবে'। সবকিছু বদলাক আর নাই বদলাক, পুরুষদের ক্রিকেটে ধরাবাধাহীন তালেবান শাসনে এই আফগানিস্তানেও ক্রিকেটপ্রেম বদলাবে না নিশ্চিত, আর সেই সাথে বলা যায় আফগান ক্রিকেটের উত্থানও চলতেই থাকবে!