• বাংলাদেশের নিউজিল্যান্ড সফর
  • " />

     

    এবাদত হোসেন: বাংলার আকাশ রাখিবেন মুক্ত

    এবাদত হোসেন: বাংলার আকাশ রাখিবেন মুক্ত    

    নিউজিল্যান্ডের সাথে বাংলাদেশের ঘড়ির পার্থক্য সাত ঘণ্টা। মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্টের শেষদিনের খেলা যখন শুরু হয়, বাংলাদেশে তখন ভোর চারটা। ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখে টিভি খুলে বসেছেন অনেকেই, ইতিহাসের সাক্ষী হতে। কেউ সারারাত জেগে ছিলেন, কেউ বা আবার খানিকটা ঘুমিয়ে উঠেছেন। এই শীতের রাতে লেপ-কম্বল মুড়িয়ে না ঘুমিয়ে ক্রিকেট ম্যাচ দেখাটাও কম হ্যাপা নয়, তাও টেস্ট ম্যাচ। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের এই যুগে ক’জনই বা দেখতে চাইবেন!

    কিন্তু দেখেছেন অনেকেই। দেখেছেন, মুশফিকুর রহিমকে কাট করতে। দেখেছেন সেই শটে কাইল জেমিসনের লেন্থ বলটা ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট দিয়ে বাউন্ডারিতে পাঠাতে। চর্মচক্ষে স্বাক্ষী হয়েছেন ইতিহাসের। তখন বোধহয় সবার চোখেমুখে লেপ্টে থাকা ঘুম আনুষ্ঠানিকভাবে উড়ে গেছে। ‘আনুষ্ঠানিক’ শব্দটা বলতে বাধ্য করেছেন এক ডানহাতি পেসার। রিভার্স সুইং, লেট সুইং আর কাট ইন করে ভেতরে ঢোকানো একেকটা ডেলিভারিতে ছড়িয়েছেন রোমাঞ্চ। টেস্ট ক্রিকেটের বিচারে বাংলাদেশের জন্য তা অভাবনীয়ও বটে। টানা ১৪০ এর আশেপাশে বল করে, প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের সর্ষেফুল দেখানো দিন, বাংলাদেশের ক্রিকেটে নিয়মিত আসে না। দীর্ঘদিনের লালিত এই স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ দিয়েছেন এবাদত হোসেন। দারুণ বোলিংয়ে একে একে তুলে নিয়েছেন ছয় উইকেট। মাত্র ৪৬ রানের খরচায়। উদযাপনটাও তার ট্রেডমার্ক হয়ে গেছে। সামরিক কায়দায় স্যালুট।

    টেস্টের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের প্রথমবারের মতো তাদেরই মাটিতে হারিয়ে অবিশ্বাস্য এক ইতিহাস লিখেছে বাংলাদেশ। যে ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায়টা রচিত হয়েছে ইবাদতের হাতে। এক ইনিংস আগে বল হাতে যা করেছেন, তাতে নিউজিল্যান্ডের ব্যাটসম্যানদের ঘুম দৌড়ে পালিয়েছে।

    **

    ২০১৬ সালে একটু নজর ফেরানো যাক। ‘রবি পেসার হান্ট’-এর প্রোমোশনাল ভিডিওটার কথা মনে আছে তো? মাশরাফি, মোস্তাফিজ, আল-আমিন আর জাহানারাকে নিয়ে বানানো। সেই পেসার হান্ট থেকেই উঠে আসা ইবাদতের। পেসার হান্টে রেজিস্ট্রেশন করেছিলেন প্রায় ৩০ হাজার বোলার। সেখান থেকে যাচাই-বাছাই করে সুযোগ পান প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার জন। সেরা ১০০ থেকে শেষ অবধি টিকে থাকেন দশজন। তাদের মধ্যে সবার সেরা, মৌলভীবাজারের এবাদত। পেশাগতভাবে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সৈনিক। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বিমান বাহিনীতে খেলতেন ভলিবল। তবুও সবার চেয়ে বেশি জোরে বল করেন এবাদতই। গতিটাও নজর কাড়ার মতো, ঘন্টায় ১৩৯ কিমি বেগে। সাথে অ্যাকুরেসি, উচ্চতাও পেস বোলিংয়ের জন্য আদর্শ।  

    গতির ঝড় তুলে ডাক পান বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের হাই পারফর্ম্যান্স (এইচপি) ইউনিটের ট্রেনিং ক্যাম্পে। স্বল্প মেয়াদে তখন ফাস্ট বোলিং কনসালটেন্ট হিসেবে বাংলাদেশে আসেন সাবেক পাকিস্তানি পেসার আকিব জাভেদ। এইচপি ক্যাম্পে গতির সাথে নিয়ন্ত্রিত লাইন-লেন্থের কারিশমায় জাভেদের প্রশংসাও আদায় করে নেন এবাদত।

    জাতীয় দলের সৌরভ কাছ থেকে প্রথম পান ২০১৮ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এক প্রস্তুতি ম্যাচে। নয় ওভারে ১৯ রানে নেন পাঁচ উইকেট। সাথে তিন মেইডেন ওভার। আলো ছড়ানোর মঞ্চ হয়ে আসে সেই মৌসুমের ঘরোয়া ক্রিকেট। বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগে (বিসিএল) পাঁচ ম্যাচে নেন ২১ উইকেট। তবে ব্রেকথ্রু দেয় ২০১৯ সালের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল)। সিলেট সিক্সার্সের হয়ে চিটাগং ভাইকিংসের বিপক্ষে ১৭ রানে চার উইকেট। ঘরোয়া ক্রিকেটের পারফর্ম্যান্স দিয়ে জাতীয় দলের নির্বাচকদের নজর কাড়লেও, বিপিএলের ওই স্পেল ছিল বড় প্রভাবক।

    জাতীয় দলের দরজা খুলে যায় সে বছর ফেব্রুয়ারিতে। নিউজিল্যান্ড সফরের আগে তাসকিন আহমেদ ইঞ্জুরিতে পড়ায় ডাক পান এবাদত। অভিষেক হয়ে যায় টেস্ট ক্রিকেটের রঙিন আঙিনায়। ২৭ ওভার বল করে জোটে মাত্র এক উইকেট, রান খরচা করেন ১০৭। দলও হেরেছিল ইনিংস ব্যবধানে। এমন অভিষেক চাইবেন না কেউই।

    **

    খাবি খাওয়া সেই নিউজিল্যান্ডেই নতুন করে নিজেকে চিনিয়েছেন এবাদত। ফিরে পেয়েছেন নিজেকে। কেউ হয়তো ভাবেনওনি নিউজিল্যান্ডের এই বৈরি কন্ডিশনে এমন আগুনঝরা বল করবেন তিনি। এই ভাবনার পক্ষে যথেষ্ট কারণও আছে। যে ভাবনার খোরাক এবাদত নিজেই যোগান দিয়েছেন।

    বে ওভাল টেস্টের আগে মোট দশ টেস্ট খেলেছেন এবাদত, উইকেট সংখ্যা মাত্র ১১। আর এভারেজ? ৮১.৫৪। অন্তত ১০ টেস্ট খেলা বোলারদের মধ্যে যা সবচেয়ে খারাপ। এমন নির্বিষ এক পেসারের পক্ষে কে-ই বা বাজি ধরবে? এই টেস্টের সেরা একাদশে তার অন্তর্ভুক্তি নিয়েও ভক্তরা ছিলেন নাখোশ। তাসকিন-শরিফুলের সঙ্গে অনেকেই দেখতে চেয়েছেন আবু জায়েদ রাহীকে। প্রথম ইনিংস শেষে তাকে নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছিল আরও। উইকেট পেয়েছিলেন একটা। কিন্তু তাসকিন-শরীফুল মিলে যে চাপে রেখেছিলেন প্রতিপক্ষকে, সেই চাপ উবে যাচ্ছিল ইবাদতের অনিয়মিত লাইন-লেন্থে। আবারও সেই সাদামাটা এবাদতই। 

    এরপর ব্যাটসম্যানদের দৃঢ়তায় বিদেশের মাটিতে প্রথমবারের মতো লিড নিয়েছিল বাংলাদেশ। সেটা টপকাতে গিয়ে বাংলাদেশি পেসারদের আগুনে স্পেলের মুখে নিউজিল্যান্ড। চতুর্থ দিন টম ল্যাথামের উইকেট উপড়ে সকালটা শুরু করেন তাসকিন। এরপরের গল্পটা কেবলই ইবাদতের। পিচের আনইভেন বাউন্স কাজে লাগিয়ে চমকে দিয়েছেন ডেভন কনওয়ে, উইল ইয়াংকে। ব্যাক অফ অ্যা লেন্থে পিচ করিয়ে অস্বস্তিতে রেখেছেন দুজনকেই। ইবাদতের সুইং আর লাইন-লেন্থে বিভ্রান্ত হয়ে বেশ ক’বার আলগা শটও খেলেছেন তারা। ক্রমেই বড় হয়ে ওঠা সেই জুটিও থেমেছে ইবাদতের হাতে। ইনসাইড এজে স্লিপে ক্যাচ দেন কনওয়ে।

    দিনের শেষ সেশনের খেলা চলছে তখন। মাউন্ট মঙ্গানুইতে শেষ বিকেলের সোনালি আলো। পুরো দিনের খেলা শেষে বল তখন বেশ পুরনো। রিভার্স সুইংয়ের ম্যাজিক নিয়ে হাজির হন এবাদত। বলের পিচিং লেন্থ দেখে পুল মারতে গেলেন ইয়াং। সুইং আর বলের রাইজিং পয়েন্টের ধাঁধায় বোল্ড। এর এক বল পরেই বোল্ড হেনরি। তুমুল গতির ফুল লেন্থ ডেলিভারিতে তাকে সুযোগই দেননি এবাদত। এক ওভার পর টম ব্লান্ডেল ফিরেছেন লেট সুইংয়ের কারিশমায়। দুই ওভারে তিন উইকেট।

    চতুর্থ দিন যেখানে শেষ করেছিলেন, পঞ্চম দিন সেখান থেকেই শুরু করলেন। এদিনের হাইলাইটস হতে পারে রস টেলরের ডিসমিসালটা। শেষদিনের দ্বিতীয় ওভারে বল হাতে নেন এবাদত। প্রথম ডেলিভারি ছিল ফুল লেন্থে। সেই বলে হয়েছিল দুই রান। পরের বল একই লাইনে থাকলেও টেলরের জন্য লেন্থটা কমিয়ে আনেন তিনি। গুড লেন্থ ডেলিভারিটা দারুণ সুইং করে ব্যাট-প্যাডের ফাঁক গলে উড়িয়ে দেয় স্টাম্প। এমন বুদ্ধিদ্বীপ্ত আর আগ্রাসী একটা স্পেলের অপেক্ষাতেই যেন ছিল বাংলাদেশ।

    বিদেশের মাটিতে পাঁচ উইকেট। তাও ক্যারিয়ারের প্রথম। চমকে দেয়া এই স্পেলের পর এবাদতের এভারেজ নেমে এসেছে ৫৬-তে। উইকেট সংখ্যা ১৮। এক স্পেলেই অনেকখানি বদলে গেছেন বোলার এবাদত। এই বদলে যাওয়া এবাদতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমানে দাবড়ে বেরিয়েছেন বাকিরাও। কিউইদের টেল-এন্ডারদের বিদায় জানিয়েছেন তাসকিন। শেষ তিন উইকেটের দুটোই নিয়েছেন তিনি।

    এই টেস্টের আগে নিউজিল্যান্ডের মাঠে মোট ৩২টি ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ। জয় নেই একটিতেও। ৩৩-তম ম্যাচে এসে ধরা দিয়েছে বহুল আকাঙ্ক্ষিত সেই জয়। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার মতো বড় দল যেখানে পাত্তা পায়নি, সেখানে টেস্টের চ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে বাংলাদেশ রীতিমতো দাপুটে জয় তুলে নিয়েছে। কেউ বলছেন অবিশ্বাস্য, কেউ বলছেন অঘটন। সে যা-ই হোক, স্কোরস্কার্ডে জয়ী দলের নামটা তো বাংলাদেশ।

    **

    টেস্টের প্রথম দিন টস করতে নামার সময় বে ওভালের অদূরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা মাউন্ট মঙ্গানুইয়ের মাথা ছুঁইছুঁই আকাশে পরাজয়ের কালো মেঘ মুমিনুল দেখেছিলেন কিনা কে জানে। এই ভাবনার পেছনে কারণ, পক্ষে নেই পরিসংখ্যান কিংবা নিজেদের পারফর্ম্যান্স। নেই তেমন কোনো সুখস্মৃতি।

    কনওয়ে-ইয়াং কিংবা টেলর-রবীন্দ্রর গড়ে ওঠা জুটির সাথে মাউন্ট মঙ্গানুইয়ের শিরছোঁয়া ঈশান কোণেও মাঝেমাঝে এসে উঁকি দিচ্ছিল নিউজিল্যান্ডের সেই কালো মেঘ। সেই কালো মেঘ বেশিক্ষণ হাওয়ায় ভাসতে দেননি এবাদত। পরিশ্রম করেছেন, তার ফলটাও পেয়েছেন। গত দুই বছরে ধরে কাজ করছেন পেস বোলিং কোচ ওটিস গিবসনের সঙ্গে।

    সাবেক এই বিমান বাহিনী সৈনিক প্রতিটা উইকেট উদযাপন করেন ব্যাটসম্যানকে সামরিক কায়দায় স্যালুট ঠুকে। ম্যাচ প্রেজেন্টেশনেও বলেছেন একেকটা স্যালুটে দেশের সাথে বিমান বাহিনীকেও রিপ্রেজেন্ট করেন তিনি। সতীর্থেরাও তাকে মজা করে ডাকেন বায়ুসেনা। নিউজিল্যান্ড মানেই যে বৈরি, কঠিন কন্ডিশনে দিনশেষে হারের মেঘে ঢেকে যাওয়া নয়, সেই বার্তাটা বেশ ভালোভাবেই দিতে পেরেছে বাংলাদেশ। যে বার্তার বাহক হয়ে একের পর এক স্যালুট দিয়েছেন এবাদত। বিমান বাহিনীতে থাকলে হয়তো উড়ে বেড়াতেন আকাশে। ভাগ্যের চাকার ঘূর্ণনে এবাদত উড়ে বেড়াচ্ছেন ক্রিকেটের বিশাল দুনিয়ায়। সদ্য সমাপ্ত এই টেস্টে বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন ‘বাংলার আকাশ তিনি রাখিবেন মুক্ত’।

    বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভক্তরাও তো তাই চাইবেন। যতবার পরাজয়ের কালো মেঘে ঢাকা পড়বে এদেশের ক্রিকেটাকাশ, ততবারই স্যালুট ঠুকে তা থেকে মুক্ত করবেন তিনি।