এবাদতের বলে সাত রান: এক বলে হয়েছে ২৮৬ রানও
চার কিংবা ছক্কা নয়। কেবল দৌড়ে কয় রান নিতে পারেন কোনো ব্যাটসম্যান? তিন রান তো হরহামেশাই দেখা যায়। ওভার থ্রো, বড় বাউন্ডারি কিংবা মিস ফিল্ডিংয়ের জন্য, চার-পাঁচ রানও নিতে দেখা যায়। এমনিতে রানিং বিটুইন দ্য উইকেট নিয়ে, বাধা ধরা কোনো নিয়ম নেই ক্রিকেটে। তবে এক বলে, সাত কিংবা আট রানও দেখেছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট।
এমন অদ্ভুতুড়ে ঘটনার সর্বশেষ সাক্ষী হয়ে আছে বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ টেস্ট। বাংলাদেশের ফিল্ডারদের মিস ফিল্ডিংয়ে এক বল থেকে এসেছে সাত রান।
লাঞ্চ ব্রেকের পরের ঘটনা। তখন ব্যাট করছিলেন উইল ইয়াং। পেসার এবাদত হোসেনের বল তার ব্যাট ছুঁয়ে যেতে থাকে প্রথম স্লিপের দিকে। দ্বিতীয় স্লিপে থাকা লিটন দাস সেটিকে ক্যাচ বানাতে গিয়ে ব্যর্থ হন। তার হাত গলে বল চলে যায় ডিপ ফাইন লেগে। বাউন্ডারি ছুঁইছুঁই অবস্থায় সেখান থেকে উইকেটরক্ষক নুরুল হাসান সোহানের হাতে বল থ্রো করেন তাসকিন আহমেদ। ততক্ষণে তিন রান নিয়েই ফেলেছেন উইল ইয়াং ও টম ল্যাথাম।
ল্যাথামকে রান আউটের উদ্দেশ্যে, সোহান সেই বল বোলিং প্রান্তে থ্রো করেন। সেই থ্রো ফিল্ডারদের ফাঁকি দিয়ে যেতে থাকে বাউন্ডারির দিকে। এবাদত ছুটেছিলেন প্রাণপণে। কিন্তু বলের নাগাল আর পাননি। দৌড়ে তিন রান আর ওভার থ্রো থেকে চার; এক বলে মোট সাত রান।
এর আগে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এক বলে সর্বোচ্চ আট রানের দেখা মিলেছে। দৌড়ে চার রান আর ওভার থ্রো থেকে বাকি চার। এই ঘটনা ঘটেছিল এক যুগেরও আগে, অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের ম্যাচে।
২০০৮ সালে ব্রিজবেন টেস্টে নিউজিল্যান্ডের পেসার লেইন ও’ব্রায়ানের এক বল থেকে আট রান পেয়েছিল অজিরা। অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস পুল করেন ও’ব্রায়ানকে। বাউন্ডারির কাছ থেকে বল ফেরত পাঠান ফিল্ডার। এর আগেই দৌড়ে চার রান নেন সাইমন্ডস ও ক্লার্ক। উইকেটরক্ষক ব্রেন্ডন ম্যাককালাম বল হাতে পেয়ে থ্রো করেন ব্যাটিং প্রান্তে। স্লিপে থাকা ফিল্ডার কোনো সুযোগই পাননি বল ধরার। অতঃপর ওভার থ্রো থেকে বাউন্ডারি। এক বলেই আট রান।
ইংল্যান্ডের ঘরোয়া টুর্নামেন্ট ‘ন্যাটওয়েস্ট টি-২০ ব্লাস্ট’-এও এমন নজির আছে। অবশ্য সেটা এক বলে সাত রানের। ২০১৭ সালে গ্রুপ পর্বের ম্যাচে কেন্টের বিপক্ষে ব্যাট করছিলেন সমারসেটের স্টিভেন ডেভিস। অ্যাডাম মিলনের বলে কভার ড্রাইভ করে ছোটেন তিনি। বাউন্ডারি থেকে ফিরতি থ্রো আসতে আসতেই, দৌড়ে তিন রান। উইকেটরক্ষক স্যাম বিলিংস বোলিং প্রান্তে থ্রো করেন রান আউটের আশায়। ফিল্ডার না থাকায়, ওভার থ্রো’তে চার রান। এই দুইয়ে মিলে এক বলে রান হলো সাত।
ওপরে তো পড়লেন স্বীকৃত ক্রিকেটের কথা। এবার চলুন দেখে নিই ক্রিকেটের এমন আরো কিছু ঘটনা, যা নিয়ে আছে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা। আছে নানান মত।
এক বলে ২৮৬ রান। বলা চলে ক্রিকেটের বিখ্যাত পৌরাণিক কাহিনিগুলোর একটা। ১৮৯৪ সালের ১৫ জানুয়ারি ‘পাল মল গ্যাজেটস নামের’ এক সান্ধ্যকালীন পত্রিকা সংবাদ প্রকাশ করে, এক বলে ২৮৬ রান নেয়ার ঘটনা ঘটেছে ক্রিকেট মাঠে।
প্রকাশিত সেই সংবাদে লেখা হয়, ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার বানবুরিতে ভিক্টোরিয়ান একাদশ খেলছিল স্ক্র্যাচ একাদশের বিপক্ষে। বোলিংয়ে গিয়ে প্রথম ডেলিভারিটাই ব্যাটসম্যানের মাথার ওপর দিয়ে করেন স্ক্র্যাচ একাদশের বোলার। উড়ন্ত সেই বল আটকা পড়ে উঁচু জারাহ গাছের এক ডালে। তারা আপিল করে ‘লস্ট বল’ -এর। আম্পায়ার জানিয়ে দেন, বল যেহেতু দৃষ্টিসীমায় আছে, সেহেতু ‘লস্ট বল’ হিসেবে গণ্য হবে না।
ব্যস! ভিক্টোরিয়ান একাদশের দুই ব্যাটসম্যান জায়গা পরিবর্তন করেন ২৮৬ বার। অবশ্য এর আগে গাছের ডাল থেকে বল নামানোর সব চেষ্টাই করেছে স্ক্র্যাচ একাদশ। কুঠার দিয়ে গাছ কাটার চেষ্টা করেও সফল হননি তারা। শেষ পর্যন্ত রাইফেলের গুলিতে বল ফিরিয়ে আনা হয় মাঠে। যদিও সেই ঘটনা কোথাও নতিভূক্ত করা নেই। এমনকি তৎকালীন অস্ট্রেলিয়ান কোনো সংবাদ মাধ্যমেও এই ঘটনার উল্লেখ নেই।
এক বলে ১৭ রানের ঘটনাও আছে। ১৯৯০ সালে অস্ট্রেলিয়ায় এই ঘটনার জন্ম দেন গ্যারি চ্যাপম্যান। ক্লাব ক্রিকেটের সেই ম্যাচ খেলা হচ্ছিল আউটফিল্ডে লম্বা ঘাসের এক মাঠে। চ্যাপম্যান শট খেলার পর বল গিয়ে আটকা পড়ে ঘাসের আড়ালে। প্রতিপক্ষের ফিল্ডার বল খুঁজে পেতে পেতে দৌড়েই সংগ্রহ করেন ১৭ রান। এই ঘটনার স্বচ্ছতার প্রমাণ দিচ্ছে গিনেজ বুক অফ রেকর্ডস। ১৯৯২ সালের সংস্করণের ২৪৭ নং পৃষ্ঠায় এর উল্লেখ আছে।
এমন ঘটনা আছে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেও। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অবশ্য এক বলে ১০ রানের বেশি নেয়ার ঘটনা আনুষ্ঠানিকভাবে নতিভূক্ত নেই। সেই অনুসারে, ১৮৭৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম শ্রেণির ম্যাচে এক বলে দশ রান নেন প্রয়াত ইংলিশ ক্রিকেটার অ্যালবার্ট হর্ন্সবি। এর ২৭ বছর পর এই রেকর্ডে ভাগ বসান স্যামুয়েল উড নামের আরেক ক্রিকেটার।
এরপর ১৮৯৪ সালে সামারভিল গিবনি নামের এক লেখক জানান এক বলে ৯৩ রানের ঘটনা। সে বছর ২৬ মে পেকহ্যাম পুশার্সের প্রতিপক্ষ ছিল ক্যাম্বারওয়েল অ্যালবিয়ন। দক্ষিণ লন্ডনে অনুষ্ঠিত সেই ম্যাচে এক বলে ৯৩ রান নেন পেকহামের দুই ব্যাটসম্যান ব্রাউন ও আর্চার। এই ঘটনায় বল অবশ্য গাছে আটকায়নি। ব্যাটসম্যান শট খেলার পর, বল আটকে যায় রুক পাখির বাসায়। সেখান থেকে ফিরিয়ে আনতে আনতেই, ৯৩ রান।
গিবনির সেই লেখা ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। ছাপা হয় নিউজিল্যান্ডের এক পত্রিকাতেও। চারপাশে শোরগোল ফেলে দিলেও, এই ঘটনার প্রমাণস্বরুপ নেই কোনো স্কোরকার্ড কিংবা অন্যকিছু। এর বিপক্ষে সাক্ষ্য দিচ্ছে দক্ষিণ লন্ডনের তৎকালীন পত্রিকা ‘দ্য সাউথ লন্ডন অবজার্ভার’।
১৮৯০-এর দশকে দক্ষিণ লন্ডনের সব ঘটনার সাথে পেকহামের ক্লাব ক্রিকেটের খবরও ফলাও করে প্রচার করতো এই পত্রিকা। কিন্তু গিবনির লেখা সেই ম্যাচ নিয়ে কোনো সূত্রই পাওয়া যায়নি।