• ইংল্যান্ড-দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ
  • " />

     

    বেন স্টোকসের ওয়ানডে যাত্রা: 'লাইফ ইজ শর্ট, আর্ট ইজ লং'

    বেন স্টোকসের ওয়ানডে যাত্রা: 'লাইফ ইজ শর্ট, আর্ট ইজ লং'    

    ১।

    লর্ডস, ২০১৯। ওয়ানডে বিশ্বকাপ ফাইনাল। আরাধ্য শিরোপা তুলে ধরতে ইংল্যান্ডের চাই ৬ বলে ১৫। নিউজিল্যান্ড আর দুই উইকেট নিতে পারলেই মিইয়ে যাবে তাদের ২০১৫ বিশ্বকাপের ফাইনাল হারের দুঃস্মৃতি। শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে দুই বাঁহাতি; ব্যাট হাতে বেন স্টোকস, বোলিংয়ে ট্রেন্ট বোল্ট। বোল্টের প্রথম দুই বলে কোনো রান নেই বেন স্টোকসের ব্যাটে। তৃতীয় বলটা আগের মতো ফুল লেংথেই পড়লো বোল্টের গ্রিপ থেকে। তবে এবার একটু সামনের দিকে। স্টোকস জানতেন ফুল লেংথ বা ইয়র্কারই আসছে। ফ্রন্টফুটে ভরে করে হাটু গেঁড়ে দারুণ এক স্লগে আছড়ে ফেললেন ডিপ মিড উইকেট গ্যালারিতে। 

    পরের বলে ফুলটস, দুই রানের জন্য ছুটছেন আদিল রশিদ আর স্টোকস। স্ট্রাইকিং এন্ডে ফিরতে খানিকটা দেরি স্টোকসের, উইকেট বাঁচাতে তার পপিং ক্রিজে তার  ডাইভ। মার্টিন গাপ্টিলের করা থ্রো’টা ভূপাতিত স্টোকসের ব্যাটে লেগে চলে গেল বাউন্ডারিতে। ইংল্যান্ড পেল ৬ রান। সাথেসাথেই স্টোকস দুই হাত তুলে জানিয়ে দিলেন ‘অনিচ্ছাকৃত’। পরের বলে দুই রান নিতে গিয়ে রান আউট আদিল। দুই দল দাঁড়িয়ে রইল সহজ এক সমীকরণের সামনে। ১ বল ২ রান। স্টোকস ফুলটস পেয়েও মারলেন না। লং অনে আলতো পুশে একবার জায়গা বদল করে ফেলেছেন, দ্বিতীয়বার করতে গিয়ে রান আউট মার্ক উড। নিশামের করা থ্রো’র চেয়ে জোরে ছুটতে পারেননি উড; ম্যাচ হলো টাই।

    সুপার ওভার! বিশ্বকাপ ফাইনালে সুপার ওভার। বাঁচা-মরার লড়াইয়ের সেই মঞ্চে আবারও স্টোকস। সুপার ওভারে ১৫ তুললো ইংল্যান্ড, অর্ধেকের বেশিই ইংলিশরা পেল স্টোকসের ব্যাট থেকে; ৮ রান। এরপরের চিত্রটা মনে আছে নিশ্চয়ই? গাপ্টিল রান আউট হলেন জেসন রয়ের থ্রো’তে জস বাটলারের হাতে। প্রথমবারের মতো ওয়ানডে বিশ্বকাপ জিতল ইংল্যান্ড। সমান ১৫ রান করেও বাউন্ডারির হিসেবে নামের পাশে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বসলো স্টোকসদের। ওয়ানডের স্টোকসকে মনে রাখতে সেই বিশ্বকাপের ফাইনালই যথেষ্ট স্মৃতির যোগান দেবে আপনাকে। 

     

    ২।

    লর্ডস ময়দানে ট্রফি নিয়ে এক দফা উল্লাসের পর ড্রেসিংরুমেও চললো ইংলিশদের মচ্ছব। মাঠের খেলার মতো উদযাপনেও অনন্য স্টোকস। এক হাতে বিশ্বকাপ ট্রফি, আরেক হাতে ক্যাপ খোলা বিয়ারের বোতল। সেই মুহূর্তটা ফ্রেমবন্দী হয়ে রইল প্রযুক্তির আশীর্বাদে। জার্সিতে তখনো লেগে রয়েছে ক্রিকেটের মক্কার ধুলো। ওসব ঝেড়ে ফেলার সময় কই? এতদিনেও বিশ্বকাপ জিততে না পারার গ্লানি তো মুছেছে! 

    ধুলোবালি ভরা সেই ছবিটাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে গতকাল এলো স্টোকসের অ্যাকাউন্ট থেকে। কদিন আগেই ৩ বছর পুর্তি হলো ইংলিশদের বিশ্বকাপ জয়ের। প্রথম দেখায় যে কেউ ভাববেন, সেই স্মৃতি রোমন্থন করতেই বোধহয় ছবি পোস্ট করেছেন স্টোকস। কিন্তু নস্টালজিয়ায় ভোগার আগে সেখান ছেদ করলো ছবির সাথে জুড়ে বসা মাঝারি সাইজের একটা ডিজিটাল  চিরকুট। যেখানে লেখা আছে ওয়ানডে ক্রিকেট থেকে স্টোকসের সরে যাওয়ার ঘোষণা। 

    ৩। 

    আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের আপাতত সবচেয়ে বড় খবর, ওয়ানডে ক্রিকেট থেকে স্টোকসের অবসর। অল্প কথায় সামগ্রিক চিত্রটা ফুটিয়ে তুলতে চাইলে বাংলা ব্যকরণের ‘বিনা মেঘে বজ্রপাত’ বাগধারাটির ব্যবহার করাই যায়। কে ভেবেছিল মাত্র ৩১ বছর বয়সেই ওয়ানডে ক্রিকেটকে চিরতরে বিদায় বলে দিবেন স্টোকস? বিশেষত স্টোকসের ক্যারিয়ারের সূর্য জ্বলছে মাঝগগণে। এর ওপর কদিন আগেই বুঝে নিয়েছেন টেস্ট দলের অধিনায়কত্বও। 

    টুইট করা সেই অবসর ঘোষণায় স্টোকস বলেছেন, ‘জীবনের কঠিনতম সিদ্ধান্ত এটা। তবে এই ফরম্যাটে দলের জন্য নিজেকে শতভাগ উজাড় করে দিতে পারছি না, এটা ভাবতেই ব্যাপারটা সহজ হয়ে গেল। ইংল্যান্ডের জার্সির আসলে এর চেয়ে বেশি কিছু প্রাপ্য। তিন ফরম্যাটে আমার পক্ষে খেলা আর সম্ভব হচ্ছে না। টানা ক্রিকেটের ব্যস্ততায় শরীর যে সায় দিচ্ছে না তা নয়। তবে আমার ধারণা আমি আরেকজন ক্রিকেটারের জায়গা দখল করে আছি। যে আসবে সে জসকে (বাটলার) আমার চেয়ে ভালো কিছু দিতে পারবে।’

    ৪। 

    স্টোকসের জন্ম নিউজিল্যান্ডের ক্যান্টারবুরিতে। কিন্তু পারিবারিক সূত্রে বেড়ে উঠেছেন ইংল্যান্ডের ডারহামে। পেশাদার ক্রিকেটটাও সেখানেই শুরু, আর একটা অংশও আজ শেষ করতে যাচ্ছেন সেই ডারহামের চেস্টার-লি-স্ট্রিটে ১০৫তম ওয়ানডে। ১১ বছরের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ব্যাপ্তি ১০৪ ম্যাচ। পরিসংখ্যান হয়তো অতকিছু সাক্ষ্য দেবে না পক্ষে। ওয়ানডেতে ইংল্যান্ডের হয়ে তার চেয়ে বেশি রান করেছেন ১৯জন ব্যাটার। তবুও স্টোকসের নামটা মানুষ মনে রাখবে দীর্ঘদিন। নেপথ্যে বড় মঞ্চের চাপ সামলে নিজের সামর্থ্যের ছাপ। 

    ক্রিকেটে ব্যস্ত সূচির ধকল সামলে স্টোকস চাইলে খেলে যেতে পারতেন অনায়াসে। চাইলে খেলতে পারতেন সামনের ওয়ানডে বিশ্বকাপেও। কিন্তু দূরদর্শী আর স্পষ্টভাষী ব্যক্তিত্বের হওয়াতেই কোনো রাখঢাক রাখেননি। সরাসরিই বলেছেন শতভাগ দিতে না পারার কথা। এর সাথে স্টোকস এটাও জানেন এতদিনে দারুণ একটা ওয়ানডে কাঠামো দাঁড়িয়ে গেছে তাদের। যেখানে পারফর্ম করাই শেষ কথা। স্টোকস বুঝেছেন, তাই সরেও দাঁড়িয়েছেন। মন দিয়েছেন টেস্ট আর টি-টোয়েন্টিতে। তবে তার মানসিক স্বাস্থ্যও একটা বড় ভূমিকা রাখতে পারে এই বিষয়ে। বেশ কয়েকবারই মানসিক ক্লান্তিতে ভুগে ক্রিকেট থেকে ছুটি নিয়েছেন। তবে সেটা ক্রিকেটের সাথে থাকার জন্যই। স্টোকসের মতো 

    কদিন আগে অবসর নিয়েছেন স্টোকসদের বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক এউইন মরগান। আন্তর্জাতিক  ক্রিকেট থেকে অবসরের নেপথ্যেতার ভাবনাতেও ছিল একই ছাপ; শতভাগ দিতে না পারা। 

    এই সিদ্ধান্তটা ছিল বদলে যাওয়া স্টোকসের বদলে যাওয়া মানসিকতার প্রতিফলন। শুরুর দিকে রগচটা বলেই পরিচিতি ছিল তার। মাঠে কিংবা মাঠের বাইরেও বেশ কয়েকবার উগ্র মেজাজের জন্য সমালোচিত হয়েছেন। 

     

    ৫।

    ২০১৪ সালে উইন্ডিজের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজে আউট হয়ে মেজাজ হারিয়ে ড্রেসিংরুমের লকারে ঘুষি মেরে কবজি মচকে ফেলেন স্টোকস। ব্যাটিং ফর্মটা একদমই ভালো যাচ্ছিল না সেবার। সেই রাগ-হতাশা ঝাড়তে গিয়ে ইনজুরিতে পড়ে খেলা হয়নি ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ।

    ২০১৭ সালে ব্রিস্টলের সেই রাত? এক পানশালায় সমকামী দম্পতির জন্য মারামারি করেছিলেন স্টোকস। জেল খেটেছেন সেবার। অথচ পরদিন ম্যাচ ছিল উইন্ডিজের বিপক্ষে। সেই লড়াইয়ের জেরে জরিমানা গোণার পর স্পন্সরও খুইয়েছিলেন স্টোকস। ছুটতে হয়েছিল কোর্ট-কাচারিতেও। মিডিয়া থেকে ইংলিশ ক্রিকেটপাড়া সবখানেই ছিল তার সমালোচনা। সেসব পাশ কাটিয়েই ঘুরে দাঁড়িয়েছেন, স্টোকস এখন কতই না পরিণত।  

    স্টোকস সাহসী, সিংহহৃদয় নিঃসন্দেহে। তবে কমতি ছিল ধৈর্য্যে। সেটাও তো রপ্ত করে ফেলেছেন। এই স্টোকস ধৈর্য্য ধরতে জানেন, জানেন সেটা কাজে লাগিয়ে কার্যোদ্ধার করতেও। ২০১৯ বিশ্বকাপের ফাইনাল এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ। ইনিংসের শেষ ওভার, সুপার ওভার;সাহসিকতা ধৈর্য্যশীলতা আর বিচক্ষণতা মিলে স্বয়ংসম্পন্ন এক স্টোকসকে দেখা গিয়েছিল।  রগচটা সেই তরুণ এখন পরিপক্ক এক মানুষ। যার কেবল ওয়ানডে যাত্রাটাই থেমে গিয়েছে।