• এশিয়া কাপ
  • " />

     

    এশিয়া কাপে যে ছয় প্রশ্নের উত্তর খুঁজবে বাংলাদেশ

    এশিয়া কাপে যে ছয় প্রশ্নের উত্তর খুঁজবে বাংলাদেশ    

    দুয়ারে কড়া নাড়ছে এশিয়া কাপ। ২৭ আগস্ট শ্রীলংকা-আফগানিস্তান ম্যাচ দিয়ে পর্দা উঠতে যাচ্ছে এশিয়ান ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় এই লড়াইয়ের। বড় প্রশ্ন, এশিয়া কাপে কেমন করবে বাংলাদেশ? প্রশ্নের পালে জোর হাওয়া বইছে আরও একটা কারণে। এবারের এশিয়া কাপ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে। ক্রিকেটের এই ফরম্যাটের অংকেই সবচেয়ে বেশি কাঁচা বাংলাদেশ। ক্ষুদ্র এই সংস্করণের মূল সুত্রগুলো এখনো রপ্ত করা হয়ে ওঠেনি বাংলাদেশের।

    এশিয়া কাপের জন্য তারুণ্য আর অভিজ্ঞতার মিশেলে ১৬ সদস্যের দল ঘোষণা করেছে বিসিবি। দলে ফেরানো হয়েছে সাব্বির রহমানকেও। টেস্টের পর সাকিব আল হাসানের কাঁধে বিসিবি তুলে দিয়েছে টি-টোয়েন্টির দায়িত্ব। টেকনিক্যাল কনসালটেন্ট হিসেবে দলের সাথে যোগ দিয়েছেন শ্রীধরন শ্রীরাম। প্রধান কোচ রাসেল ডমিঙ্গোর জায়গায় সাকিবদের দায়িত্ব সামলাবেন তিনিই। 

    আসন্ন অক্টোবরে শুরু হবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। বাংলাদেশের জন্য এশিয়া কাপ হতে পারে বিশ্বকাপের জন্য টিম কম্বিনেশন খোঁজার আদর্শ মঞ্চ। বিশ্বকাপকে সামনে রেখে সব মিলিয়ে এশিয়া কাপে টি-টোয়েন্টির ছয় প্রশ্নের উত্তর খুঁজবে বাংলাদেশ।


    পাওয়ার হিটিংয়ের ধাঁধা মিলবে?

    বাংলাদেশের সাবেক কোচ ও বর্তমান ব্যাটিং পরামর্শক জেমি সিডন্স ফেসবুকে বেশ সক্রিয়। শিষ্যদের সাথে কোচিংয়ের অনেক মুহূর্তই তিনি শেয়ার করেন ভক্তদের সাথে, করেন নানাবিধ আলোচনাও। কদিন আগেই একটা ভিডিও দিয়েছেন তিনি, যেখান দেখা গেছে হাই ব্যাক লিফটে একের পর এক বল সীমানাছাড়া করার চেষ্টা করছেন আনামুল হক বিজয় ও মেহেদী হাসান মিরাজ। মিরাজ আবার ঝালিয়ে নিয়েছেন সুইপ-রিভার্স সুইপটাও। 

    মোদ্দাকথা শিষ্যদের পাওয়ার হিটিং শেখাচ্ছেন অস্ট্রেলিয়ান এই কোচ। এই পাওয়ার হিটিংয়ের দক্ষতা না থাকাতেই টি-টোয়েন্টিতে যত গন্ডগোল বাংলাদেশি ব্যাটারদের। ফলতই প্রভাবটা সরাসরি পড়ে স্কোরকার্ডে। পাওয়ার প্লে কিংবা ডেথ ওভারের পরিসংখ্যানে চোখ বুলালেই ফুটে ওঠে দৈন্যদশা।

    ২০২১ সালের পর ৩৪ ইনিংসে বাংলাদেশের পাওয়ারপ্লের ব্যাটিং গড় মাত্র ১৮.০৬। এই ৩৪ ইনিংসে বাংলাদেশী ব্যাটাররা তুলেছেন ১২৬১ রান। কিন্তু ডট দিয়েছেন ৫৮৪টি! ডেথ ওভারের অবস্থা আরও শোচনীয়। শেষ ৩০ ইনিংসে রান তুলেছে ৯০৯। উইকেট পড়েছে ৬৮টি, ডটবল ২২৫। ব্যাটিং গড় মাত্র ১২.৯৫।

    জিয়াউর রহমান, সাব্বির রহমান, শামীম পাটোয়ারীদের দিয়ে পাওয়ার হিটিংয়ের চেষ্টা করাও হয়েছে। কিন্তু ফল পক্ষে আসেনি। তাই বিজয়-মিরাজদের ঝালিয়ে নিয়েই পোক্ত করার চেষ্টা সিডন্সের। এশিয়া কাপে সিডন্সের শিষ্যরা নিশ্চয়ই চাইবেন পাওয়ার হিটিং দিয়ে  এই পরিসংখ্যানগুলো ছাপিয়ে যেতে। 

    এক্স ফ্যাক্টর হবেন সাব্বির? 

    তিন বছর পর জাতীয় দলে ফিরেছেন সাব্বির রহমান। সর্বশেষ টি-টোয়েন্টি খেলেছেন ২০১৯ সালে আফগানিস্তানের বিপক্ষে। এই তিন বছরে নিয়মিতই খেলেছেন ঘরোয়া ক্রিকেটে। গত বিপিএলে ৬ ম্যাচে করেছেন ১০৯ রান। সর্বোচ্চ ৩২। অবশ্য ওয়ানডে ফরম্যাটের ডিপিএলে ভালো ছন্দেই ছিলেন তিনি। ১৫ ম্যাচে ৫১৫ রান। প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নুও বলেছেন, সেই পরিসংখ্যান দেখেই তারা সাব্বিরকে দলে রেখেছেন।

    সাব্বিরের অন্তর্ভূক্তির নেপথ্যে নির্বাচকদের ভাবনায় কাজ করতে পারে সাব্বিরের এক্স ফ্যাক্টর হয়ে ওঠার সম্ভাবনা। ২০১৬ এশিয়া কাপের টুর্নামেন্ট সেরা হয়েছিলেন সাব্বির। বলা চলে সেবার শ্রীলংকার বিপক্ষে একাই লড়াই করেছিলেন ব্যাট হাতে। নিদাহাস ট্রফির ফাইনালেও দলের বিপদে হাল ধরেছিলেন। অবশ্য ৪৪ ম্যাচ অভিজ্ঞ সাব্বিরের স্ট্রাইকরেট ১২০.৮১। এই ৪৪ ম্যাচের সাব্বির ৯৪৬ রান করেছেন ২৪.৮৯ গড়ে। এক ইনিংসে সর্বোচ্চ স্কোর ৮০। 

    টি-টোয়েন্টির ন্যাচারাল স্ট্রোকমেকার, পাওয়ার হিটার বলতে যা বোঝায়, বাংলাদেশের বিচারে সাব্বিরকে সেই তকমা দেয়া হয়েছিল আগেই। কিন্তু তাকে ভুগিয়েছে অধারাবাহিক ব্যাটিং আর সময়মত জ্বলে ওঠতে না পারা। সাব্বির এবার নিশ্চয়ই চাইবেন এক্স ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে। আর নজর কাড়ার জন্য এশিয়া কাপের চেয়ে বড় মঞ্চ আর কী হতে পারে! 

    আনকোরা ওপেনিং জুটি; সম্ভাবনা না শংকা? 

    তামিম ইকবাল নেই, টি-টোয়েন্টিকে বিদায় বলেছেন।  ব্যাটিং অর্ডারের নেতা হয়ে উঠেছেন লিটন দাস। কিন্ত বিধিবাম! জিম্বাবুয়ে সিরিজে চোট পেয়ে ছিটকে গেছেন এশিয়া কাপের স্কোয়াড থেকে। জিম্বাবুয়ে সিরিজ দিয়ে সাত বছর পর দলে ফেরা আনামুল হক বিজয়ের সঙ্গী হিসেবে নির্বাচকরা বেছে নিয়েছেন পারভেজ হোসেন ইমনকে। লিটন ইনজুরিতে না পড়লে ইমন হয়তো ব্যাকআপ ওপেনার হিসেবেই থাকতেন। তবে তার মতো তরুণকে বড় মঞ্চে সুযোগ দেয়ার দুরদর্শিতা নির্বাচকরা দেখিয়েছেন। 

    বিজয় ওয়ানডেতে ছন্দে ফিরেছেন, কিন্তু তার শেষ ছয় টি-টোয়েন্টির ইনিংস একেবারেই আদর্শ নয়। সব মিলিয়ে খেলেছেন মোট ১৯ ম্যাচ। স্ট্রাইকরেট ১১৫.৪৮। তার সঙ্গী পারভেজ ইমন খেলেছেন একটি ম্যাচ। অভিষেকে ফিরেছিলেন মাত্র ২ রান করে। তবে বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকে শুরু করে ঘরোয়া ক্রিকেটে সক্ষমতার আলো ছড়িয়েছেন বাঁহাতি এই ব্যাটার। শেষ মুহূর্তে ডাকা হয়েছে আরেক ওপেনার নাঈম শেখকে, যিনি গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ব্যর্থতার পর বাদ পড়েছিলেন। প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন যার দলে অন্তর্ভুক্তির কারণ দেখিয়েছেন 'উপায় নেই বলে'।

    বিজয়-ইমন; দুই ওপেনারের সম্মিলিত অভিজ্ঞতা মাত্র ২০ ম্যাচের। এখানেই জুড়ে দেয়া যায় আরেকটি প্রশ্ন, নতুন এই ওপেনিং জুটি কি টি-টোয়েন্টির নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলবে বাংলাদেশের জন্য? নাকি সেই পুরনো ছবিই আঁকা হবে টুর্নামেন্টজুড়ে? তরুণ ওপেনাররা বড় ইনিংস না খেললে ঘুরেফিরে ভরসা করতে হবে সাকিব-মুশফিকদের ব্যাটেই। 

    ডেথ ওভারে মোস্তাফিজই সমাধান? 

     

    সর্বশেষ জিম্বাবুয়ে সিরিজে গতির ঝড় তুলে নিজের উপস্থিতির জানান দিয়েছিলেন হাসান মাহমুদ। তিন ম্যাচে নিয়েছিলেন ৫ উইকেট। এশিয়া কাপের স্কোয়াডেও জায়গা করে নিয়েছিলেন ডানহাতি এই পেসার। কিন্তু ফিল্ডিং অনুশীলনে ডান পায়ের গোড়ালিতে চোট পেয়ে বাদ পড়েছেন তিনি। পেস আক্রমণের ধার কিছুটা হলেও কমেছে বাংলাদেশের। পেস আক্রমণ এখন চার সদস্যের; মোস্তাফিজুর রহমান, তাসকিন আহমেদ, এবাদত হোসেন ও মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন। 

     

    অভিজ্ঞতার সামগ্রিক বিচারে নেতৃত্বে থাকবেন মোস্তাফিজই। চলতি বছরে খেলেছেন মোট সাত টি-টোয়েন্টি, উইকেট পেয়েছেন পাঁচটি। এর মধ্যে ডেথ ওভারে ৫ ইনিংসে বল করে ২ উইকেট নিয়েছেন ৯.৮৫ গড়ে। বাংলাদেশের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলতে হতে পারে মোস্তাফিজের এই পরিসংখ্যান। তবুও পাওয়ারপ্লে- ডেথ ওভারে মোস্তাফিজের বাঁহাতেই আস্থা রাখবেন অধিনায়ক সাকিব। তাসকিন এই বছর টি-টোয়েন্টি খেলেছেন দুইটি। গড়ে রান গুনেছেন প্রায় ১২.৫০ গড়ে। সাইফউদ্দিন ফিরেছেন ইনজুরি কাটিয়ে। আর এবাদত এখনো টি-টোয়েন্টি খেলেননি। মোস্তাফিজের ওপর গুরুদায়িত্ব। অবশ্য আরব আমিরাতের উইকেট-কন্ডিশন বিবেচবনায় টিম ম্যানেজমেন্ট-অধিনায়ক বোলিং আক্রমণ কীভাবে সাজান, সেটাই মূল চ্যালেঞ্জ। 

    নতুন ‘কোচ’’ কেমন করবেন ?

    শ্রীধরন শ্রীরাম বাংলাদেশের সাথে কাজ করবেন টি-টোয়েন্টি কনসালটেন্ট হিসেবে। কিন্তু আদৌতে তার কাজটা কোচেরই। রাসেল ডমিঙ্গোকে টি-টোয়েন্টি পরিকল্পনার বাইরে রাখাটাই এই যুক্তির পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। দীর্ঘদিন কাজ করেছেন অস্ট্রেলিয়া দলের সঙ্গে। ছিলেন স্পিন বোলিং কোচ। গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপজয়ী অস্ট্রেলিয়ার সহকারী কোচের দায়িত্বও সামলেছেন। এর বাইরে দিল্লি ডেয়ারডেভিলস, রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর কোচিং প্যানেলেও ছিলেন। সব মিলিয়ে দারুণ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কোচই এনেছে বাংলাদেশ। 

    তার সঙ্গে বিসিবির চুক্তিও আগামী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ পর্যন্ত। এশিয়া কাপই বাংলাদেশের সাথে তার প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট। স্বল্প সময়ের মধ্যে শিষ্যদের মধ্যে কতটা বদল আনতে পারেন সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা। এই প্রশ্নের উত্তরে, কতটা দ্রুত তার সঙ্গে সাকিবরা মানিয়ে নেন সেটাই আসবে সবার আগে। 

    টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগামী আসর অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানকার কন্ডিশন, উইকেট নিয়ে বিশদ ধারণা দেয়ার জন্য শ্রীরাম দারুণ একজন, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। দীর্ঘদিন অস্ট্রেলিয়ায় কাজ করার সুবাদে সেসব তার নখদর্পনেই। তবে আসল কাজটা ক্রিকেটারদের, সেটা বলাই বাহুল্য। 

    মানসিকতায় বদলে আনবেন সাকিব?

    গতকাল মিরপুরে দারুণ এক সংবাদ সম্মেলন করেছেন সাকিব। পুরোটা সময়জুড়েই সংবাদকর্মীদের দিয়ে গেছেন লেখার উপাদান, সংবাদের নানান ‘অ্যাঙ্গেল’। কথা বলেছেন নিজের অধিনায়কত্ব, দল নিয়ে ভাবনা, এশিয়া কাপ নিয়ে পরিকল্পনাসহ আরও অনেক কিছু নিয়েই। 

    টি-টোয়েন্টিতে সাকিবের কাছে বাংলাদেশের সামগ্রিক চিত্রটা পরিষ্কার। অকপটেই বলেছেন, গেল ১৫-১৬ বছরে তেমন কোনো উন্নতি নেই। ফিল্ডিংয়েও ত্রাহি দশা। সাকিব নজর দিয়েছেন সেদিকেও। বলেছেন, রাতারাতি বদলে ফেলা সম্ভব ফিল্ডিংয়ের ধরন। এর জন্য বদলানো চাই সবার মানসিকতা। 

    অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই সবার সাথে কথা বলেছেন সাকিব। এশিয়া কাপ নিয়েও যে কথা হয়েছে তা নিশ্চিতই।  সাকিবের কথাতেও ছিল সেই ছাপ, ‘আলাদা করে কাউকে বলে দেওয়ার কিছু নেই। আমরা ফোর-ফাইভের স্টুডেন্ট নই যে আমাদের শিখিয়ে দিতে হবে। ওই জায়গায় আমরা আসলে নেই।’ 

    মানসিকতায় বদল আনতে সাকিব নিজের জায়গায় শতভাগই দিয়েছেন, দিচ্ছেন। বাকি কাজটা তার সতীর্থদের। একটা বার্তাও দিয়ে রেখেছেন তাদের উদ্দেশ্যে, ‘“আমরা যদি তাদের এই আত্মবিশ্বাসটা দিতে পারি যে তারা দলের অংশ এবং তারা দলে থাকবে। তাহলে আগে হোক বা পরে, সুফল পাওয়া সম্ভব।’

    এশিয়া কাপ ও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপকে সামনে রেখে সাকিবের এই বার্তাগুলোই জানান দেয় ইতিবাচক মানসিকতার।