'ওপেনার স্টার্ক'কে কি ভুলে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া?
ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের রমরমা যুগে আজকাল স্টার্কের মতো ক্রিকেটারদের পাওয়া যায়? একের পর এক ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের আবির্ভাবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটই হুমকির মুখে। দেশের ক্রিকেট নাকি ফ্র্যাঞ্চাইজি বড়, অনেক ক্রিকেটারই জন্ম দিয়েছেন এ বিতর্কের। এইতো কদিন আগে ট্রেন্ট বোল্টও নিউজিল্যান্ডের কেন্দ্রীয় চুক্তি থেকে নিজের নাম সরিয়ে নিয়েছিলেন। কেন? পরিবারের জন্য সময় বের করা, সাথে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলোর জন্যেও!
মিচেল স্টার্কেরও একাউন্টে কম ধন জমা হতো না, যদি তিনিও সেভাবে সময় বের করতেন। তাকে নিয়ে যখন চাহিদা তুঙ্গে, তখনই কোন প্রলোভন তাকে টানেনি। সেই ২০১৫ সালে সবশেষ আইপিএলে খেলেছিলেন। এরও আগে বিগ ব্যাশে সবশেষ নিজের চেহারা দেখিয়েছিলেন এই পেসার। এসব লিগের সময়টা কাজে লাগান স্টার্ক 'ফ্রেশ' হতে, যাতে আন্তর্জাতিক সূচিতে নিজের সর্বোচ্চ দিতে কোন ব্যাঘাত না ঘটে!
অথচ ক্রিকেট বাস্তবতা এখন বলে ভিন্ন কিছু। ক্রিকেটারদের প্রাধান্যের তালিকায় এগিয়ে থাকে 'কম সময়ে বেশি আয়' এর ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটই। সে কারণে টি-টোয়েন্টি লিগে খেলতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে 'না' করা আর কোন অবাক করার মতো ঘটনা না! আন্তর্জাতিক সূচির ফাঁকফোকরে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে খেলার সুযোগ নিতেন ক্রিকেটারা। আর এখন? উল্টোটা। ফ্র্যাঞ্চাইজিকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে আন্তর্জাতিক সূচিতে কাটছাঁট করছেন ক্রিকেটাররা। এই যখন বাস্তবতা, স্টার্কের মতো ক্রিকেটাররা তো ব্যাতিক্রমই!
অস্ট্রেলিয়ার তিন ফরম্যাটেরই অটো-চয়েজ (এখনও?) স্টার্কের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাম্প্রতিক সময় ভালো যাচ্ছে না। বিশ্বকাপে নিজেকে আবিস্কার করেছেন এক জটিল অবস্থায়। এক ম্যাচে তো নিজের জায়গা খুঁজে পেলেন বেঞ্চেই। হ্যাঁ, একাদশের বাইরের কেউ একজনই হয়ে যেতে হয়েছিল স্টার্ককে। এটাকে শুধু 'সারপ্রাইজ' বললেই হয় না! আফগানিস্তানের বিপক্ষে 'জিততেই হবে, তাও বড় জয়' এমন ম্যাচেই কিনা নেই মিচেল স্টার্ক। অনেক সাবেক ক্রিকেটার অবাক হয়েছিলেন বটে, কেউ কেউ ক্ষোভ উগরে দিতেও দ্বিধাবোধ করেননি। এমনকি প্রতিপক্ষ দলের কোচ জনাথন ট্রটকেও তো 'স্টার্কের অনুপস্থিতি' অবাক করেছিল!
স্টার্ককে নিয়ে বিস্ময়ের শুরু আসলে এর আগে থেকেই। অস্ট্রেলিয়া বোলিং করতে নেমেছে, বল হাতে ইনিংসের শুরু করতে প্রস্তত স্টার্ক, নিয়মিত এক চিত্র। বিশ্বকাপের আগে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি, প্রথম ওভারে বল স্টার্কের হাতে নেই! এমন দৃশ্য শেষ কবে দেখেছেন, নিশ্চিত কেউ মনে করতে পারতেন না তখন!
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওই ম্যাচের আগে যে ৫৩ ম্যাচ খেলেছিলেন স্টার্ক, মাত্র দুটিতেই প্রথম দুই ওভারে বল উঠেনি তার হাতে। ইনিংসের প্রথম বলটাই তার হাত থেকে ছুটেছে ৪০ ম্যাচে। এরপরের ম্যাচেই অবশ্য প্রথম ওভারে ফিঞ্চ বল দিয়েছিলেন স্টার্ককে। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেও, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ওভারে ১৪ রান দিয়ে ফেলেন স্টার্ক। এরপর শ্রীলংকার পর আয়ারল্যান্ড ম্যাচেও স্টার্ক দেখেন, প্রথম দুই ওভারে বল করছেন অন্য কেউ!
ইংল্যান্ড ম্যাচের আগে স্টার্কের খেলা ৫৩ ম্যাচের ৪০টিতেই প্রথম ওভারে বল করেছেন তিনি। প্রথম ওভারে তার ইকোনমি ৫.০৫, গড় ২২.৪। ইনিংসের উদ্ভোধনী ওভারেই উইকেট এনে দিয়েছেন ৯টি। প্রথম দুই ওভারে বল করেছেন ৫১ ম্যাচে, এতে ৫.১৬ ইকোনমিতে বল করে উইকেট দিয়েছেন ১৩টি। নতুন বলের ত্রাস সেই ‘ওপেনার’ স্টার্ককেই পরে ভুলে গেল অস্ট্রেলিয়া?
বিস্ময়পর্বের শুরু যে ম্যাচ দিয়ে, সেটির পরে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে পাঁচ ম্যাচ খেলেছেন স্টার্ক, যাতে প্রথম দুই ওভারে বোলিং করেছেন মাত্র দুটি ম্যাচে। যেসময়ে সারাটা জীবন নিজে বল হাতে ছুটেছেন, সেখানে দূরে দাঁড়িয়ে অন্য কাউকে বল করতে দেখছেন। ক্রিকেট মাঠে অনেকটাই অপরিচিত এক দৃশ্যের সঙ্গে পরিচিতি ঘটছিলো স্টার্কের! স্টার্ককে অস্ট্রেলিয়া দেখছিলো অন্য রুপে, অন্য ভূমিকায়।
এতদিন পাওয়ারপ্লেতে নিজের সেরাটা দেখিয়ে আসছিলেন স্টার্ক, মাঝের সময়ে বল করেছেন অল্প। এবার তার মূল কাজটা হয়ে উঠলো মাঝের সময়ে আর শেষে। যে ম্যাচ দিয়ে স্টার্কের নতুন ভূমিকার সূচনা, সে ম্যাচের আগে স্টার্ক যতটি ওভার করেছেন, তার অর্ধেকই ছিল পাওয়ারপ্লেতে। তখন ক্যারিয়ারের ৮১ শতাংশ ম্যাচেই পাওয়ারপ্লেতে করেছেন দুইয়ের বেশি ওভার।
শুরু আর শেষের মাঝে যে দশ ওভার, তাতে ক্যারিয়ারের ৩৪ শতাংশ ম্যাচেই বলই করেননি স্টার্ক। ৭ থেকে ১৬ ওভারের মধ্যে এক ওভারের বেশি করেছেন মাত্র ৮ ম্যাচে। শেষের চার ওভারের মধ্যে ৪১ ইনিংসে বল করে উইকেট নিয়েছেন ২৮টি।নতুন ভুমিকায় স্টার্ককে বেশিরভাগ বোলিং করতে হচ্ছিল তার অচেনা মিডল ওভারে। এর আগে মিডল ওভারে ২১% বল করা স্টার্ক এরপর তার ওভারের ৩৯% করেছিলেন মাঝের সময়ে। এই সময়ে স্টার্ককে প্রথমে বোলিংয়ে না আনলেও পাওয়ারপ্লেতে যে একেবারে আনছিলেন না, তা নয়। তবে যা-ই করেছেন, তার অধিকাংশই এসেছে পাওয়ারপ্লের শেষের অর্ধে। পাওয়ারপ্লেতে যে ৭ ওভার বল করেছেন, তার পাঁচটিই এসেছে ৪-৬ ওভারের মধ্যে।
সময় | পাওয়ারপ্লে | মিডল ওভার | ডেথ ওভার |
অক্টোবর ১২ এর আগে (মোট ২০১ ওভার) |
৪৯% ১০১ ওভার |
২১% ৪২.৩ ওভার |
২৯% ৫৭.৩ ওভার |
অক্টোবর ১২ এর পরে (মোট ১৮ ওভার) |
৩৯% ৭ ওভার |
৩৯% ৭ ওভার |
২২% ৪ ওভার |
ভিন্ন প্রতিপক্ষের সাথে কন্ডিশন, সবমিলিয়ে সব অবস্থায় প্রস্তত হওয়ার লক্ষ্য ছিল অস্ট্রেলিয়ার। একই ধাঁচে অভ্যস্ত না হয়ে ভিন্ন পরিস্থিতিতেও যেন তারা মানিয়ে নিতে পারে। একাদশ নিয়ে ‘ফ্লেক্সিবল’ হওয়া, স্টার্ককে ভিন্ন ভূমিকায় দেখার কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল এটিই। অস্ট্রেলিয়ার কাছে নতুন বলের দায়িত্ব পালনের জন্য অন্য বিকল্পও ছিল। তবে স্টার্কের ভূমিকা বদলে তার বিগত পারফরম্যান্সেরও কি একেবারেই প্রভাব ছিল না?
২০২১ সাল থেকে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ২৩ ম্যাচ খেলেছেন স্টার্ক। এতে অধিনায়ক প্রথম দুই ওভারেই বল হাতে দিয়েছেন ২০ ম্যাচে। যাতে তিনি তার পুরনো দিনের ভয়ঙ্কর চিত্রের স্মৃতিই শুধু মনে করিয়েছেন! এসময়ে বাঁহাতি এই পেসারের উইকেট সংখ্যা যে ছিল মোটেই তিন। বোলিং গড় ছিল ৪৩.৭! যা ২০২১ এর আগের সময়ে ১৪.৯! সেসময়ে ৩৩ ইনিংসে প্রথম দুই ওভারে বল করে উইকেট নিয়েছিলেন ১০টি। ইকোনমিতে ফারাকও কম নয়, ৬.৫৫ আর ৪.৫২। ২০২১ এর আগে আর পরে নতুন বলের স্টার্কে পার্থক্যটা স্পষ্টই!
শুধু নতুন বলই কেন, দুই সময়ের পুরোপুরি দুই স্টার্ককে তুলনা করলেও তো সেই তফাতটা ফুটে উঠে। ২০২১ সালের আগে ৩৫ ইনিংসের মাত্র ৫টিতে নয়ের বেশি ইকোনমি ছিল স্টার্কের। অর্থাৎ, প্রায় ৮৫ ভাগ ম্যাচেই তার ইকোনমি থেকেছে নয়েরও কম! আর ২০২১ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৪৮ শতাংশ ম্যাচেই তার ইকোনমি ছিল নয়ের বেশি। ২৩ ইনিংসের ১১টিতেই! তার মানে একসময়ে যার টি-টোয়েন্টি ভাগ্যে ‘খরুচে’ দিন আসছিল কালেভদ্রে, সেই স্টার্ককেই তা দেখা দিচ্ছিল হরহামেশা!
২০১২ সালে অভিষেকের পর থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পাওয়ারপ্লেতে ওভারপ্রতি ছয়ের কম রানে বল করেছিলেন স্টার্ক। প্রথম ছয় ওভারে দুর্দান্ত স্টার্ক নিয়েছিলেন ২৩ উইকেট। কিন্ত ২০২১ সাল থেকে এ পর্যন্ত নিতে পারলেন মাত্র ৬ উইকেট। এসময়ে তার ৪১.৫ গড় অস্ট্রেলিয়ার ভাবনার কারণ না হয়ে পারে না! ২০২০ সাল পর্যন্ত যে স্টার্কের ডেথ ওভারে ইকোনমি ছিল নয়ের নিচে, সেই স্টার্কের গেল বছর দুয়েকে শেষ চার ওভারে ইকোনমি দশের উপরে!
পর্যায়/সময় |
২০১২-২০২০ | ২০২১-বর্তমান | ||||
উইকেট | ইকোনমি | গড় | উইকেট | ইকোনমি | গড় | |
পাওয়ারপ্লে (১-৬) | ২৩ | ৫.৯৬ | ১৯.২ | ৬ | ৭.৩২ | ৪১.৫ |
মিডল (৭-১৬) | ৭ | ৭.৩৩ | ২০.৪ | ৮ | ৮.৬০ | ৩২.২ |
ডেথ (১৭-২০) | ১৭ | ৮.৭২ | ১৯.২ | ১২ | ১০.৬২ | ২১.২ |
গেল বছরের বিশ্বকাপজয়েও সেই পুরনো আতঙ্ক ছড়ানো স্টার্ককে পায়নি অস্ট্রেলিয়া। সাত ইনিংসে ৯.১৯ ইকোনমিতে বল করে নিয়েছিলেন ৯ উইকেট। এই বিশ্বকাপের আগেও ঠিক সেই চেনা রুপে ছিলেন না। তবুও তার উপর বিশ্বাস না রাখার কোন কারণ ছিল না! অস্ট্রেলিয়া রেখেছেও। আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে অবশ্য তাকে বাইরে রাখার সিদ্ধান্তের কারণ ‘কৌশলগত’, বলেছিলেন অজিদের সহকারী কোচ ড্যানিয়েল ভেট্টোরি।
অস্ট্রেলিয়ার সাথে স্টার্কের বিশ্বকাপও ওই ম্যাচেই শেষ। তিন ম্যাচে তিন উইকেটে। উইকেট শিকারীদের তালিকায় প্রথম পঞ্চাশে নেই তার নাম। শেষ যেবার অস্ট্রেলিয়ায় বিশ্বকাপ হয়েছিল, তার ২২ উইকেটের বেশি ছিল না কারও! অস্ট্রেলিয়ার জন্য নিবেদিতপ্রাণ স্টার্ক হয়তো স্বপ্ন দেখেছিলেন, এবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে স্মরণীয় কিছু করার। যে স্টার্ককে ফ্র্যাঞ্চাইজির কাড়ি কাড়ি টাকার বদলে দেশের হয়ে অবদান রাখার আকাঙ্কাই টানে বেশি, সেই তাকেই কি তাহলে উপেক্ষিত করে ফেললো অস্ট্রেলিয়া? ঘরের মাঠে প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অজিদের খেলা স্টার্ককে বাইরে বসে দেখতে হয়। পারফরম্যান্স যা বলে, তাতে উত্তরের জায়গায় নিশ্চিন্তে ‘হ্যাঁ’ বসাতে দ্বিধা না হয়ে উপায় নেই!
অস্ট্রেলিয়া একাদশের ভেতরে ঢুকলেও, ইনিংসের সূচনায় অন্য কেউ, দেখতে হয় স্টার্ককে। স্টার্কের জন্যেই কেন, দর্শকদের জন্যও হয়তো তা ছিল নতুন কিছুর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ব্যাপার। ওপেনার স্টার্কে অভ্যস্ত চোখ যে দেখছিল ভিন্ন কিছুই!