• ফিফা বিশ্বকাপ ২০২২
  • " />

     

    সাহারা-পাড়ি দিয়ে স্পেন থেকে বিশ্বকাপের মঞ্চে: উইলিয়ামস ভাইদের গল্প

    সাহারা-পাড়ি দিয়ে স্পেন থেকে বিশ্বকাপের মঞ্চে: উইলিয়ামস ভাইদের গল্প    

    ইনাকি উইলিয়ামস আর নিকো উইলিয়ামস দুইজনেরই এবার বিশ্বকাপ অভিষেক হয়েছে। ইনাকি খেলছেন মাতৃভূমি ঘানার হয়ে, নিকো খেলছেন জন্মভূমি স্পেইনের হয়ে। গার্ডিয়ানের সিড লো কে দেওয়া ইনাকি উইলিয়ামসের সাক্ষাৎকার এবং আমাজন প্রাইমের ডকুমেন্টারি সিক্স ড্রিমস অবলম্বনে ইনাকির এই গল্পটা বলেছেন ফুয়াদ নাসের


    "অন্যান্য দিনের মতই আমরা আমাদের বিলবাও এর বাসায় বসে টিভি দেখছিলাম। খবরে দেখাচ্ছিল কীভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছোট ছোট নৌকায় সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আফ্রিকান শরণার্থীরা ইউরোপে আসছে। মেলিয়ার বর্ডারে কাঁটাতারের বেড়া টপকে স্পেইনে ঢোকার চেষ্টা করছে।

    দেখতে দেখতে হঠাৎ আমার মনে হল, আমরা কীভাবে স্পেইনে এলাম এটা আমি জানি না। মাকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, নাহ এখন তোমাকে বলাই যায়।

    বাবা মা এবং আরো ৪০ জন ঘানাইয়ান নাগরিককে একটা ছাদ বিহীন ট্রাকে গাদাগাদি করে বসিয়ে দিয়েছিল আদম পাচারকারীরা। ট্রাকটা ছুটছিল সাহারা মরুভূমির ভেতর দিয়ে, কেন? কারণ এখানে পুলিশি প্রহরা নেই। পাচারকারীদের কেউ তাড়া করবে না।

    মাঝপথেই পাচারকারীরা সবাইকে ট্রাক থেকে নামিয়ে দিল। তোমরা যা টাকা দিয়েছ তা দিয়ে এটুকুই যাওয়া যাবে। বলে তারা ট্রাক নিয়ে চলে গেল। ৪০ জন মানুষ, সাহারা মরুভূমির বুকে, খাবার নেই, পানি নেই। আমার বাবার জুতোও ছিল না। মা'র পেটে তখন আমি।

    ৪০ জনের মাঝে ১১জন পৌঁছাতে পেরেছিল স্পেইনের মেলিয়া বর্ডারে। বাকিদের লাশ মরুভূমিতেই রয়ে গেছে। বর্ডারে কাঁটাতাদের বেড়া টপকানো মাত্রই বাবা আর মাকে সিভিল গার্ড আটক করে। তাদের কাছে স্পেইনে কাজ করার কোন অনুমতিপত্র ছিল না, অবৈধ অভিবাসী হিসেবে তাদের ফেরত পাঠানো হবে আবার ঘানাতে। ভাগ্যের কি লীলা, হাজতে থাকা অবস্থাতেই একজন দয়ালু আইনজীবীর সাথে তাদের দেখা হয়। তিনি পরামর্শ দেন বাবা মা যেন তাদের ঘানার পাসপোর্ট আর পরিচয়পত্র ছিঁড়ে ফেলেন এবং নিজেদেরকে লাইবেরিয়ার যুদ্ধ থেকে পলাতক শরণার্থী হিসেবে দাবী করেন। বাবা মা সেটাই করলেন, পলিটিকাল এসাইলাম পেলেন এবং পেলেন স্পেইনে প্রবেশাধিকার।

    স্পেইন সরকার বাবা মাকে জায়গা করে দিল বাস্ক এলাকায়, পাম্পলোনাতে। সেখানে ইনাকি পারদোনেস নামে একজন চার্চের ফাদার বাবা মার দায়িত্ব নিলেন। তিনি এরপর আমাদের পরিবারেরই অংশ হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর নামেই আমার নাম রাখা।

    স্তব্ধ হয়ে সব শুনলাম আমি। এখন আমি জানি বাবা কেন খুঁড়িয়ে হাঁটেন, সাহারা মরুভূমি খালি পায়ে পার করেছেন তিনি। এখন আমি জানি, আমি কোথা থেকে এসেছি। আমি জানি, কেন আমার নাম ইনাকি। আমার যখন টানা ২৪০ ম্যাচ খেলার রেকর্ড হল(১৭ এপ্রিল ২০১৬ এর পর থেকে বিলবাওয়ের সব ম্যাচ পুরো ৯০ মিনিট খেলেছেন ইনাকি) এর মাঝে অনেক ডাক্তার অনেক ফিজিও আমাকে পরীক্ষা করেছে। তারা বলেছেন, ইনাকি তোমার রিকভারি করার ক্ষমতা অসম্ভব রকম ভাল। এখন আমি জানি, যার মা তাকে পেটে করে সাহারা মরুভূমি পায়ে হেঁটে পার করেছে সে ৯০ মিনিট মাঠে দৌড়াতে পারবে না? আলবাত পারবে!

    আমার বয়স যখন দশ কি বারো, বাবা কাজের খোঁজে লন্ডনে চলে গেলেন। বাবা স্টামফোর্ড ব্রিজে টিকেট চেকার, ক্লিনার এ ধরনের কাজ করতেন আর স্টেডিয়াম থেকে খেলার ছবি দিতেন। আমি ছোট, নিকো তখন আরো ছোট। আমরা কী অত বুঝতাম? শুধু টের পেতাম সবার বাবা তাদের সাথে থাকে, আমাদের বাবা থাকে খালি ছবিতে আর ফোনকলে। কতটা দুর্ভাগা আমরা!

    মা'র গল্প শুবে আমি টের পেলাম কতটা সৌভাগ্যবান আমি। এই যে বিলবাওতে জন্ম হয়েছে আমার, এ কারণে আমি এখন একজন বাস্ক। অ্যাথলেটিক বিলবাও এর একাডেমি আর দলের কড়া নিয়ম, বাস্ক ছাড়া কেউ সুযোগ পাবে না। আমি আর নিকো বিলবাও একাডেমিতে বড় হয়েছি। আমি বিলবাওয়ের প্রথম কালো খেলোয়াড়। কত বর্ণবাদী গালি সহ্য করতে হয়েছে আমাকে, নিকোকে। এখন সবাই আপন করে নিয়েছে আমাদের, ওদের মত আমরাও একজন গর্বিত বাস্ক।

    একসময় ঈশ্বরের উপর খুব রাগ হত, এত অবিচার কেন? পাম্পলোনাতে ফেস্টিভালের সময় অনেক টুরিস্টরা আসতো, তারা ভাল পোষাক পরে, ভাল খাবার খায়। আমি চার্চের অনুদানের জামা পরি, খাবার না থাকলে ইনাকি দাদুর বাড়িতে গিয়ে খাই। আমি এখন বুঝলাম, ঈশ্বর তাঁর পক্ষ থেকে দুনিয়াতে কিছু ভাল মানুষ পাঠিয়েছেন। ঐ মেলিয়ার সেই আইনজীবিটা যিনি মা বাবাকে রক্ষা করেছিলেন, বা ইনাকি দাদু যিনি আমাদের আগলে রেখেছেন। আমার অ্যাথলেটিকের টিমমেটরা, যারা মাঠের দর্শকদের সামনে বুক চিতিয়ে বলেছে - ইনাকিকে আরেকটা বর্ণবাদী কথা বলা হলে তারা আর কোন ম্যাচ খেলবে না। দুনিয়াতে এদের মত, আমার মা, বাবা আমার ভাইদের মত মানুষ আছে বলেই এখনো আমরা টিকে আছি। রাগ পুষে রাখা যাবে না, রাগে কি হয়? ভালোবাসায় জীবন বাঁচে। "