বিশ্বকাপে আলো ছড়িয়ে দাম বেড়ে গেল যেসব ফুটবলারের...
প্রতি চার বছরে বিশ্বমন্ডলে আবির্ভূত হয় ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’। দর্শকদের যেমন আনন্দ-বেদনায় কাটে পুরো এক মাস তেমনি হাজারো আবেগ-অনুভূতির মধ্য দিয়ে যেতে হয় অংশগ্রহণকারী দলগুলোকেও। হার-জিত, আবেগের মূর্ছনা একটা টুর্নামেন্টে থাকবেই। তবে বিশ্বকাপের জন্য মুখিয়ে থাকার আরেকটি উপলক্ষ যেটা খেলোয়াড় ও দর্শকদের একই মাত্রায় আলোড়িত করে সেটা সম্ভবত নতুন খেলোয়াড়ের আগমন। তরুণ খেলোয়াড়েরা যেমন বিশ্ব মঞ্চে নিজেদের তুলে ধরতে মুখিয়ে থাকেন, তেমনি দর্শকরাও একাগ্রচিত্তে অপেক্ষা করেন ফুটবল বিশ্বের নতুন কুড়িদের জন্য। তবে এখানে শুধু দর্শক নয়, নজর থাকে ক্লাবগুলোরও। বিশ্বকাপটা সেই অর্থে ভাগ্য বদলে বহু খেলোয়াড়ের। আপাতদৃষ্টিতে খালি হাতে অনেকে ফিরলেও বিশ্বকাপের পর যেন তাদের দুনিয়াটাই পালটে যায়।
তবে প্রযুক্তির আগমনের পর সেটা কতটা প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন থেকে যায় সেখানে। যেখানে বিশ্বের কোণায় কোণায় স্কাউট রয়েছে, যেখানে ক্লাবের হর্তাকর্তারা খেলোয়াড়দের চাক্ষুষ না দেখে শুধু কিছু ভিডিও দেখেই এজেন্টদের সাথে মুঠোফোনে আলাপ সেরে রাখছেন সেখানে বিশ্বকাপ পর্যন্ত কি আদৌতে অপেক্ষা করতে হয় ক্লাবগুলোকে? উত্তরটা হ্যাঁ, না দুটোই হতে পারে। তবে বড় ক্লাবগুলো মূলত যেটা চায় তার জন্য বিশ্বকাপের চেয়ে বড় মন আর কী হতে পারে! বিশ্বমঞ্চে যে বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করার সামর্থ্য রাখে, দর্শকদের প্রত্যাশার ভারে নুহ্য না হয়ে স্বীয় মহিমায় মাতিয়ে তোলে পুরো দুনিয়া সেরকম একজন খেলোয়াড়কেই তো চায় বড় ক্লাবগুলো। খেলোয়াড়দের ভাগ্যটা খুলে যায় আসলে এখানেই। স্কাউটিং করার পর অনেক খেলোয়াড়কেই তালিকাভুক্ত করা হলেও চুক্তিপত্রে কলমের কালি পড়ে এই বিশ্বকাপের পরেই।
আর এবারের বিশ্বকাপে সেটা মাথায় রাখতেই হবে। জানুয়ারির দলবদলের সূচীর ঠিক আগেই হচ্ছে বিশ্বকাপ। বেখাপ্পা এই সময়টায় বিশ্বকাপ হওয়ার কারণে যেমন অনেক খেলোয়াড় পড়েছেন ইনজুরির কবলে, তেমনি বিশ্বকাপে অনেকেই চিনিয়েছেন নতুন আঙ্গিকে। ক্লাবগুলোকে তাই চিন্তার খোরাক জোগাতে বাধ্য এই বিশ্বকাপ।
তবে ক্লাবগুলোর জন্য সময়টা এক অর্থে দোটানায় ভোগার মত। এই রদবদলের সময়টাতে ক্লাবগুলো একান্ত প্রয়োজন না হলে খরচে খুব একটা আগ্রহী থাকে না। তার ওপর কোভিডের প্রলয়ঙ্কারি আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি অনেক ক্লাবই এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এরই মধ্যে তাদের তালিকায় থাকা অনেক পছন্দের খেলোয়াড় দেখিয়ে চলেছে তাদের কারিশমা, সেই সাথে নজর কেড়েছে স্বনামধন্য বেশ কিছু ক্লাবেরও। একেকটি গোল, অ্যাসিস্টের সাথে খেলোয়াড়ের বাজার মূল্য বেড়ে যাচ্ছে তরতর করে। আবার অনেক ইনজুরি ক্লাবগুলোকে বাধ্য করবে নতুন খেলোয়াড় দলে ভেড়াতে। সব মিলিয়ে এবারের জানুয়ারির বাজারটা হতে পারে ইতিহাসের সবচেয়ে সরগরম রদবদলের একটি। আর সেখানে নিশ্চিতভাবেই নজর কাড়বেন তরুণ খেলোয়াড়েরা। আগেও হামেস রদ্রিগেজ, জিলবার্তো সিলভা, এনার ভ্যালেন্সিয়ারা বিশ্বকাপ দিয়ে যেমন নিজেদের নিয়ে এসেছিলেন পাদপ্রদীপের তলে, তেমনি এবারও ভাগ্য খুলে যেতে পারে বেশ কিছু খেলোয়াড়ের।
কোডি গাকপো (নেদারল্যান্ডস)
বিশ্বকাপের আগ থেকেই আলোচনার শিরোমণি ছিলেন, বিশ্বকাপে টানা তিন ম্যাচে তিন ধরণের গোল দিয়ে নিজের মূল্যটা চড়িয়ে নিয়েছেন সন্দেহাতীতভাবেই। গাকপো বিশ্বকাপে এসেছিলেন আর্লিং হালান্ডের চেয়েও বেশি গোলে ভুমিকা রেখে। বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি নজর ছিল বোধহয় তার ওপরেই। ধুঁকতে থাকা এক ডাচ আক্রমণভাগের দায়িত্ব বুঝে নিয়ে যেভাবে তিনি নিজেকে মেলে ধরেছেন তাতে তার ৪৫ মিলিয়ন ইউরোর বাজার মূল্যে যে ঊর্ধ্বগামী এক পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে সেটা বলাই বাহুল্য। পিএসভির এই ফরওয়ার্ডকে কোন ক্লাব লুফে নেয় সেটাই এখন দেখার বিষয়।
আন্দ্রিয়েস নোপার্ত (নেদারল্যান্ডস)
ডাচ গোলরক্ষকের বিশ্বকাপে আসার ঘটনাটাই হৃদয়স্পর্শী। পরিবার তাকে ছেড়ে দিতে বলেছিলেন ফুটবল, একটা সময় তার ছিল না কোনও ক্লাব, তবুও নোপার্ত হাল ছাড়েননি। বিশ্বকাপের আগেই লুই ভ্যান গালের জহুরীর চোখ ঠিকই খুঁজে নিল তাকে। হিরেনভিনের ২৮ বছর বয়সী এই গোলরক্ষকের বয়সটা ঠিক এই খেলোয়াড়দের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তবে গোলরক্ষকদের জন্য ২৮ তো খুব একটা চিন্তার বিষয়ও নয়। সেই সাথে এই বিশ্বকাপে তার অসাধারণ পরিসংখ্যান তো তার হয়েই কথা বলছে। অপ্টার পরিসংখ্যান অনুযায়ী গড়ে প্রতি ম্যাচে এখন পর্যন্ত ১.৫ গোল প্রতিহত করেছেন তিনি, যা ভয়চেক শেজনির পরে সবচেয়ে বেশি। সেই সাথে শট নেওয়ার পর প্রত্যাশিত গোলের বিপরীতে গোলের সেই প্রচেষ্টা ঠেকিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা নোপার্তের ১.৮ - যা শেজনি ও কোর্তোয়ার পরে তৃতীয় সর্বোচ্চ। নোপার্তের ভাগ্যটা তাই ভোজবাজির মত পালটে যেতেই পারে।
মোহামেদ কুদুস (ঘানা)
বিশ্বকাপের আগেই নিজেকে নেইমারের সমকক্ষ খেলোয়াড় দাবী করে অনেকের চক্ষুশূল হয়েছিলেন। তবে এরপর তার পা জোড়া তার হয়ে কথা বলেছে মাঠেই। বিশ্বকাপের আগেই আয়াক্সের হয়ে টানা ৪ চ্যাম্পিয়নস লিগ ম্যাচে গোল করে এসেছিলেন। বিশ্বকাপে এসেও কমেনি সেই ধার। গ্রুপ এইচের সবচেয়ে সফল ড্রিবলিংয়ের রেকর্ড তার অধীনে (৯), সেই সাথে রয়েছে ২ গোল ও ১ অ্যাসিস্ট। এমনিতেই আয়াক্স তাদের তরুণ তুর্কিদের একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর বড় ক্লাবগুলোকে বুঝিয়ে দেন, তার ওপর বিশ্বকাপে নিজের খেলা দিয়ে কুদুস সুবিচার করেছেন নিজের তকমার। বিশ্বকাপ শেষে তাই কুদুসকে লুফে নিতে পারে কোনও বড় দল।
টাইলার অ্যাডামস (যুক্তরাষ্ট্র)
বিশ্বকাপে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের সবচেয়ে তরুণ অধিনায়ক তিনি। তবে দায়িত্বের ভারের বিন্দুমাত্র চাপ তার খেলায় পড়েনি। বিশেষত ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটায় যেন পারক-জি-সুংয়ের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন লিডসে খেলা এই মিডফিল্ডার। ধারাভাষ্যকাররাও যেন সবখানে সেদিন অ্যাডামসকেই খুঁজে পাচ্ছিল। ২৩ বছর বয়সী এই মিডফিল্ডার প্রতি ম্যাচেই যুক্তরাষ্ট্রএর ক্ষিপ্র ফুটবলের মধ্যমণি ছিলেন। অ্যাডামসের বাজার মূল্য ১৭ মিলিয়ন ইউরো হলেও বর্তমান ফুটবলে তার মত রক্ষন-আক্রমণের এক অটূট সেতুবন্ধনকে খুঁজে নিবে যে কোনও বড় দলই।
এনজো ফার্নান্দেজ (আর্জেন্টিনা)
লিওনেল মেসির পর সবচেয়ে কনিষ্ঠ আর্জেন্টাইন হিসেবে বিশ্বকাপে গোল দিয়ে ইতিমধ্যে নজর কেড়েছেন এনজো। পোল্যান্ডের বিপক্ষে কাস্তেবাকা সেই শটে রোমাঞ্চ ছড়িয়েছেন বিশ্বজুড়ে আর্জেন্টাইন ভক্তদের হৃদয়ে। সেই সাথে ২১ বছর বয়সী বেনফিকার এই মিডফিল্ডার এবারের আসরে প্রতি নব্বই মিনিটে প্রত্যাশিত গোল ও অ্যাসিস্টের তালিকায় আছেন ১৩ নম্বরে। মিডফিল্ডে তার পাসিংয়ের প্রভাবটা একদম স্পষ্ট। বিশ্বকাপ শেষে বা এই মৌসুমের শেষে তাই এনজোর দ্বারে কড়া নাড়তে পারে বেশ কিছু বড় ক্লাব।
জুড বেলিংহাম (ডর্টমুন্ড)
তরুণ এই ইংলিশ মিডফিল্ডার কাটাচ্ছেন স্বপ্নের এক বিশ্বকাপ। ইরানের বিপক্ষে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পর কাল সেনেগালের বিপক্ষে ছিলেন উজ্জ্বল। ডর্টমুন্ড থেকে তাকে আনার জন্য জোর লড়াই চলছে লিভারপুল ও রিয়ালের মধ্যে, শোনা যাচ্ছে এমন। ধারণা করা হচ্ছে, অন্তত ১০০ মিলিয়ন পাউন্ড গুণতে হতে পারে তাকে আনার জন্য। বিশ্বকাপের এই পারফরম্যান্স দামটা আরও বাড়িয়েই দিয়েছে।