• " />

     

    উসমান খাওয়াজা : এভাবেও ফিরে আসা যায়!

    উসমান খাওয়াজা : এভাবেও ফিরে আসা যায়!    

    দল থেকে বাদ পড়তে কেমন লাগে? উত্তরটা অনেক ক্রিকেটারই দিতে পারবেন। তবে বারবার দল থেকে বাদ পড়তে কেমন লাগে, সে প্রশ্নের উত্তর সম্ভবত খুব বেশি কেউ দিতে পারবেন না। উসমান খাওয়াজার উত্তর এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মার্ক পাওয়ার সম্ভাবনাই রাখে। খাওয়াজার চেয়ে বেশি কেউ বাদ পড়েছেন নাকি, সেটি নিয়েই যে বরং কুইজ হতে পারে। 

    অ্যাশেজের প্রথম টেস্ট শেষে খাওয়াজার গড় দেখতে পাবেন আটচল্লিশের উপরে। ক্যারিয়ার পরিসংখ্যান দেখে কারো অনুমান করার উপায় নেই, সেই খাওয়াজাকেই এত এত বার দলে আসা-যাওয়াতেই ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। কতবার? সাত, সাতবার। এতবার বাদ পড়ার মানে ফিরে আসার গল্পও কম নয়। আর ফিরে আসার গল্প তো সবসময়ই দুর্দান্ত মনে হয়। খাওয়াজা সেখানে ফিরেছেন বারবার, তবে শেষবারেই এসে লিখেছেন সবচেয়ে দুর্দান্ত গল্প।

    ফিরে আসার সে গল্পের শুরুটাই তো কম নাটকীয় না! ঘরের মাঠে গেল অ্যাশেজের স্কোয়াডে ছিলেন খাওয়াজা, কিন্ত একাদশের নিয়মিত সদস্য তখনও খাওয়াজা নামের কেউ নন। পুরো সিরিজেই খেলার সম্ভাবনাটা তাই ছিল ক্ষীণ। চতুর্থ টেস্টের আগে হুট করে সে দুয়ার খুলে যায় হেডের অনুপস্থিতিতে। খাওয়াজা হয়তো বিষয়টাকে সেভাবে দেখতে চাইবেন না, তবে এটিই তো সত্য, কোভিড যন্ত্রণার মধ্যে সবচেয়ে উপকারিতা তার করেছে ট্রাভিস হেডের ওই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়াই। হেডের জায়গায় মিডল অর্ডারে জায়গা পেয়ে পরে যা করেছেন, তাতে তাকে একাদশের বাইরে রাখার কথা কেউ ভাবলে তাকে অন্তত বীরপুরুষ কেউ বলবে না। এক টেস্টে দুই দুইটা সেঞ্চুরি, এর চাইতে ভালো উপায়ে আর ফিরে আসা যায়! 

    সিডনি টেস্টের পরে ট্রাভিস হেডও ফিরে আসেন। খাওয়াজা থাকেন একাদশে, মার্কাস হ্যারিসের জায়গায় ওপেনার হিসেবে। এবার চলে আসুন ২০২৩ অ্যাশেজে। এজবাস্টনে প্রথম টেস্টে খাওয়াজা পেয়ে গেলেন ইংল্যান্ডে তার প্রথম সেঞ্চুরি। অথচ এই অ্যাশেজে অজি ড্রেসিং রুমেই থাকবেন কি না, ভাবতে পারেননি, সেখানে অ্যাশেজে ওপেনিং করবেন, সেটা তো ভাবতে না পারারই বিষয়। ৪৪ টেস্ট। ২৮৮৭ রান, চল্লিশের মতো গড়, ৮ শতক। খাওয়াজা মেনেই নিয়েছিলেন, ৪৪ টেস্টের এই ক্যারিয়ার পরিসংখ্যানেই সমাপ্ত তার টেস্ট জীবন। কখনো আর ফেরা হবে না, মনকে বুঝিয়েই জীবন গাড়িতে চড়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। 

    এরপর এলো ২০২২ সালের সেই কামব্যাকের সিডনি টেস্ট। ২০২৩ অ্যাশেজের প্রথম টেস্ট পর্যন্ত, ফিরে আসার পর যে ১৮ ম্যাচে খেলেছেন খাওয়াজা, তাতে প্রায় ৬৮ গড়ে ১৮২৭ রান। ৩২ ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে ১৫টিতেই খেলেছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংস। আগে যেখানে ৮ শতক করেছিলেন ৪৪ ম্যাচে, ফিরে আসার এ পর্বেই পেয়ে গেছেন সাতটি সেঞ্চুরি। দুর্দান্ত কামব্যাকের গল্প, তাইতো? ঘরের মাঠে সেঞ্চুরি তো হাঁকিয়েছেনই, ভারতেও পেয়েছেন শতক, পাকিস্তানে রানের ফোয়ারাই ছুটিয়েছেন, ইংল্যান্ড ছিল বাকি! কিন্ত ইংল্যান্ডের মানে যে খাওয়াজার কাছে দুঃস্মৃতিই হবে। বাঁহাতি এই ব্যাটার কি আর এমনিই বলেন, টপ অর্ডার ব্যাটারদের জন্য বিশ্বে সবচাইতে কঠিন জায়গা ইংল্যান্ড। 

    ২০১৩ সালে প্রথমবার ইংল্যান্ডের মাটিতে অ্যাশেজের মঞ্চে তার আগমন। তিন ম্যাচ খেলতে পারেন সেবার, পরেরবার সুযোগ হয়নি, এরপর ২০১৯ সালেও এসে তিন ম্যাচ। এই টেস্টের আগে সবমিলিয়ে যে সাত টেস্ট খেলেছেন ইংল্যান্ডে, তাতে তার ব্যাটিং গড় ১৭.৭৮। ১৪ ইনিংসে করতে পারেননি একটির বেশি ফিফটি। ক্যারিয়ারের সেরা সময়ে থেকেই এবার ইংল্যান্ডে পা রেখেছিলেন, কিন্ত বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশীপের ফাইনালেও ব্যর্থ ঠেকলেন। এজবাস্টন টেস্টে এসেই যেন সবকিছু যেন পুষিয়ে দিলেন! ইংল্যান্ডের মাটিতে এর আগে যেখানে সবমিলিয়েই ৫০৩ বল টিকতে পেরেছেন কেবল, এজবাস্টনে এক ম্যাচেই খেলে ফেললেন ৫১৮ বল। 

    রক্ষণে এতটাই মজবুত ছিলেন খাওয়াজা, পুরো টেস্টে তার উইকেট নেওয়া দুঃসাধ্যই মনে হয়েছে। আগ্রাসী ফিল্ডিং সাজিয়ে আক্রমণ করেছে ইংলিশ পেসাররা, প্রলুব্ধ করার নানান উপায় খুঁজেছে, পারেনি তাকে টলাতে। খাওয়াজার স্কোরিং অপশন বন্ধ করেছে, প্রলুব্ধ করেছে আগ্রাসী হতে, ভিন্ন কিছু করতে, খাওয়াজা ভিন্ন কিছু না করে নিজের টিকে থাকার খোলসেই বন্দী থেকেছেন। পেসারদের বিপক্ষে রক্ষণে তো শক্ত ছিলেনই, সাথে পুলের-মতো-বল না হলেও সেসবে পুলে কয়েকটি চার বের করেছেন দারুণভাবে। ডাউন দ্যা উইকেটে এসে মঈন আলীর অফ স্পিনে কয়েকটা বাউন্ডারি তুলে নিতে ফুটওয়ার্কের দারুণ প্রদর্শনীই দেখিয়েছেন।

    প্রথম ইনিংসে সেঞ্চুরির পরের উদযাপনটা ছিল বহুদিন মনে রাখার মতো। আবেগে ভরপুর উদযাপনের এক সময় তো ব্যাটও ছুড়ে ফেলেছিলেন। দেখে মনে হচ্ছিল, কোন রেসলার এইমাত্র লড়াইয়ে জিতলেন! খাওয়াজার মতে সাধারণের চেয়ে বেশ আবেগী হওয়ার পেছনে কাজ করতে পারে ‘ইংল্যান্ডে রান করতে পারে না’ মতবাদ! দুই ইনিংসেই খেলেও গেছেন আসলে কোনও রেসলার বা ফাইটারের মতোই! ডিফেন্স করে গেছেন যুদ্ধে নামা কোন সংকল্পবদ্ধ সৈনিকের মতো, যেন ক্রিজে থাকাটাই তার জীবনের একমাত্র কাজ। 

    তবে প্রথম ইনিংসে ১৪১ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ৬৫ রান করে ইংল্যান্ডের মাটিতে পেয়ে গেছেন প্রথম ম্যান অব দ্যা ম্যাচ। একই টেস্টে এক ইনিংসে সেঞ্চুরির সঙ্গে আরেক ইনিংসে ফিফটি, গত ত্রিশ বছরেই ইংলিশদের ডেরায় অস্ট্রেলিয়ার কোন ওপেনারের তা করার সাধ্য হয়নি। সেই ১৯৮৯ সালে মার্ক টেলরের পর এবারই প্রথম খাওয়াজা। 

    উসমান খাওয়াজা কিন্ত ক্রিকেটকে কেবল ভালোবেসেই যান না। ভালোবাসেন ঠিক, তবে ক্রিকেটের সাথে তার সম্পর্কটাকে তিনি দেখেন ‘লাভ-হেট রিলেশনশিপ’র মতোই। আজ তুমি টপ অব দ্যা ওয়ার্ল্ড, তো কাল মাটিতে, এই কারণেই মূলত। 

    অভিষেক হয়েছে তার সেই ২০১১ সালে, এখন পর্যন্ত ম্যাচ খেলেছেন মোটে ৬২টি। তার অভিষেকের পর থেকে অস্ট্রেলিয়া যত ম্যাচ খেলেছে, তাতে খাওয়াজা ছিলেন না অর্ধেকের বেশি ম্যাচে। ২০২৩ অ্যাশেজের প্রথম টেস্ট পর্যন্ত যে ১২৮ ম্যাচে নেমেছে অজিরা, তার মধ্যে ৬৬টিতেই ছিলেন না খাওয়াজা। ক্যারিয়ারের শেষ অংশে এসেই কেবল দলে নিয়মিত হতে পেরেছেন, তবে সেখানেই জন্ম দিচ্ছেন দুর্দান্ত সব মূহুর্তের। 

    শেষবেলায় তার ইংল্যান্ডের ‘দুর্নাম’ও মিটিয়ে দেওয়ার কাজ শুরু করে দিয়েছেন। যে অ্যাশেজকে নিজের শেষ মনে করছেন, সেটিতে শুরু করেছেন অসাধারণ দুই ইনিংসে। খাওয়াজার ঠিকানা এখন কোথায় জানেন? 

    টপ অব দ্যা ওয়ার্ল্ড!