• ক্লাব ফুটবল
  • " />

     

    আধুনিক ফুটবলে যেভাবে বদলে গেছেন গোলরক্ষকেরা

    আধুনিক ফুটবলে যেভাবে বদলে গেছেন গোলরক্ষকেরা    

    খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, যখন গোলরক্ষকদের মূল কাজ ছিল শুধুই বলকে প্রতিহত করা, বলকে জালে জড়াতে বাধা দেওয়া। আর যেহেতু মাঠের খেলোয়াড়দের মধ্যে শুধুমাত্র গোলরক্ষকেরাই হাত দিয়ে বলকে স্পর্শ করতে পারেন, তাঁদের জার্সির রঙও অন্যদের চেয়ে আলাদা, তাই তাঁদেরকে দলের অন্য সবার চেয়ে একটু ভিন্ন চোখেই দেখা হতো। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছে।

    আধুনিক গোলরক্ষকেরা দলের ট্যাকটিকসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। গোলরক্ষকের পায়ে বল থাকার সময়টা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ, যে তাঁরা চাইলে দলের খেলার ধরনই পাল্টে দিতে পারেন।

    আধুনিক গোলরক্ষক কী?

    বর্তমানে দলগুলোর আক্রমণের শুরুটা হয় গোলরক্ষককে দিয়ে। আধুনিক গোলরক্ষকেরা তাই শর্ট এবং লং, দুই ধরণের পাসেই পারদর্শী হন। লং পাস মানে এখন শুধুই বলকে উড়িয়ে মেরে বিপদমুক্ত করা নয়, কোন নির্দিষ্ট খেলোয়াড়কে উদ্দেশ্য করে পাস দিয়ে আক্রমণের সূচনাও করা হয় লং পাসের মাধ্যমে। অন্যান্য খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রে লং পাসটা যেমন দলের ট্যাকটিকসের অংশ, গোলরক্ষকদের ক্ষেত্রেও তাই।

    [মার্ক-আন্দ্রে টের স্টেগান; ছবি: গেটি ইমেজেস]

    আধুনিক গোলরক্ষকদের বিবর্তনের নেপথ্যে

    বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে, গোলরক্ষকেরা নিজেদের অর্ধের যেকোন জায়গায় হাত দিয়ে বল স্পর্শ করতে পারেন। ১৯১২ সালে এই নিয়মটা সংশোধিত হয়, গোলরক্ষকদের হাত দিয়ে বল স্পর্শ করার সীমারেখা হিসেবে পেনাল্টি এরিয়াকে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।

    ১৯৯২ সালে ব্যাকপাসের নিয়ম তৈরি হয়। এই নিয়মের অধীনে গোলরক্ষকেরা তাঁদের উদ্দেশ্যে নিজের দলের খেলোয়াড় কর্তৃক পায়ের মাধ্যমে পাস দেওয়া বলগুলো হাত দিয়ে ধরতে বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। তবে যদি নিজ দলের খেলোয়াড়রা পায়ের বদলে মাথা, বুক বা কাঁধ দিয়ে গোলরক্ষকের উদ্দেশ্যে পাস দেন, সেক্ষেত্রে গোলরক্ষকেরা হাত দিয়ে বল ধরতে পারেন।

    এই নিয়মের কারণে, স্বাভাবিকভাবেই গোলরক্ষকদের ভূমিকা ও দক্ষতায় পরিবর্তন আসে। হাতের পাশাপাশি পায়ের কাজেও তাঁদেরকে দক্ষ হতে হয়। নিজের দলের খেলোয়াড়ের কাছ থেকে পাস এলে তাঁদের ভূমিকাটা আর গোলরক্ষণেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং তাঁরাও হয়ে ওঠেন একজন আউটফিল্ড খেলোয়াড়। তাঁদেরও বলটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে জানতে হয়, এরপর সেটাকে সঠিকভাবে পাস দিতে হয় অন্য কোন সতীর্থের উদ্দেশ্যে। এই ব্যাপারটাই পরিবর্তন করে দিয়েছে পুরো খেলাটাকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, কোচদের ট্যাকটিকসের একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে গোলরক্ষক ও তাঁদের দক্ষতা। গোলরক্ষকের পায়ে বল মানেই যেন দলের নতুন আক্রমণের সূচনা।

    আধুনিক গোলরক্ষকদের মধ্যে সেরা কারা?

    মার্ক-আন্দ্রে টের স্টেগান (জার্মানি, বার্সেলোনা)

    [ছবি: Wyscout]

    আক্রমণ বিল্ড-আপের ক্ষেত্রে বার্সেলোনার এই জার্মান গোলরক্ষক হয়ে ওঠেন একজন অতিরিক্ত আউটফিল্ড খেলোয়াড়। বল পায়ে দারুণ পারদর্শী হওয়ায় তিনি ওয়ান-টাচ পাসে দারুণ স্বচ্ছন্দ, কখনো কখনো একটু ঝুঁকি নিয়ে ওয়ান-টু করে নিজের দলের আক্রমণটা শুরু করে দেন।

    এডারসন (ব্রাজিল, ম্যানচেস্টার সিটি)

    [ছবি: Wyscout]

    আধুনিক ফুটবলে এডারসনের মতো গোলরক্ষক খুঁজে পাওয়া কঠিন। কোচ হিসেবে পেপ গার্দিওলার চাওয়া থাকে একেবারেই ব্যতিক্রমী একজন গোলরক্ষক, আর এডারসন সেই ভূমিকায় পুরোপুরি ফিট। বল পায়ে দারুণ পারদর্শী এডারসনের ভিশনও দারুণ। ফাঁকায় দাঁড়ানো সতীর্থকে খুঁজে নিতে পারেন খুব দ্রুত, আর লং-রেঞ্জ পাসিংয়ে তিনি অনন্য। একটা দারুণ লং পাস দিয়েই নিজের দলের স্ট্রাইকারকে খুঁজে 

    পাওয়ার দক্ষতা রাখেন তিনি। চাপের মুখেও তিনি শান্ত থাকতে পারেন। কখনো টার্ন করে, কখনো ফেইন্ট করে প্রতি পক্ষের স্ট্রাইকারকে কাটিয়ে দলকে চাপমুক্ত করেন তিনি। মাঝমাঠ বরাবর ঝুঁকিপূর্ণ পাস দিতেও আপত্তি নেই এডারসনের।

    অ্যালিসন (ব্রাজিল, লিভারপুল)

    [ছবি: Wyscout]

    লিভারপুলের বিল্ড-আপে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন দলের ব্রাজিলীয় গোলরক্ষক অ্যালিসন বেকার। সময়ে সময়ে দুই সেন্টারব্যাকের মাঝে নিজেকে তৃতীয় সেন্টারব্যাকের অবস্থানে নিয়ে যান তিনি, দলের খেলাতে প্রদান করেন —। এডারসনের মতো অত বেশি ঝুঁকি নেন না অ্যালিসন, তবে তিনি এডারসনের তুলনায় বল পায়ে বেশি শান্ত এবং ধীরস্থির। মাঠের এক পাশ থেকে অপর পাশে খেলা সুইচ করার ক্ষেত্রেও তিনি ভূমিকা রাখেন।

    থিবো কোর্তোয়া (বেলজিয়াম, রিয়াল মাদ্রিদ)

    [ছবি: Wyscout]

    এই তালিকার অন্যান্য গোলরক্ষকদের মতো বল পায়ে এতটা ভালো নন থিবো কোর্তোয়া, দলে তাঁর ভূমিকাও কিছুটা ভিন্ন। দলের বিল্ড-আপের চেয়ে রক্ষণকাজেই বেশি ভূমিকা রাখেন তিনি। রিয়াল মাদ্রিদ যখন আক্রমণে ওঠে গোলের জন্য, কোর্তোয়া তখন পরিণত হন সুইপার কিপারে। স্বাভাবিকভাবেই এই ব্যাপারটা রিয়াল মাদ্রিদের আক্রমণাত্মক ফুটবলটা অব্যাহত রাখতে সাহায্য করে, কেননা বল হারানোর সাথে সাথেই মিডফিল্ডারদের কাছে বলটা পুনরায় পৌঁছে দেন কোর্তোয়া।

    অন্যান্য

    বায়ার্নের জার্মান গোলরক্ষক ম্যানুয়েল নয়্যার, প্যারিস সেইন্ট-জার্মেইনের ইতালীয় গোলরক্ষক জিয়ানলুইজি দোনারুমা, রিয়াল বেতিসের চিলিয়ান গোলরক্ষক ক্লদিও ব্রাভো, প্রত্যেকেই আধুনিক গোলরক্ষকের উদাহরণ।

    নিজ দলের পায়ে বল থাকাকালীন আধুনিক গোলরক্ষকের ভূমিকা

    আগেই যেমনটা বলা হয়েছে, আধুনিক ফুটবলে গোলরক্ষকের ভূমিকাও একজন আউটফিল্ডে খেলোয়াড়ের মতো। অন্যান্য খেলোয়াড়ের মতো তিনিও বিল্ড-আপে অংশ নেন। কেউ কেউ তো আবার গোলের সুযোগ সৃষ্টি করেন, অ্যাসিস্টও পেয়ে যান কেউ কেউ।

    [ম্যানুয়েল নয়্যার; ছবি: গেটি ইমেজেস]

    আধুনিক গোলরক্ষকদের কাজ শুরু হয় একেবারে নিজেদের পোস্টের সামনে থেকে। সেন্টারব্যাক বা নিচে নেমে আসা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারদের কাছে বল পাস দেন গোলরক্ষক, ক্ষেত্রবিশেষে সেটা যায় ফুলব্যাক বা ওয়াইড মিডফিল্ডারদের কাছেও। এই প্রথম পাসটা দেওয়ার পরই গোলরক্ষক নিজের অবস্থান পরিবর্তন করে নেন, এবং পুনরায় পাস রিসিভ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যান। এরপর প্রয়োজনে ছোট, মাঝারি বা বড় পাস দিতে হয় গোলরক্ষককে। দল আক্রমণে উঠছে কিনা, গোলের জন্য কতটুকু মরিয়া, বা নিজেদের খেলোয়াড়রা কোথায় ফাঁকায় দাঁড়িয়ে আছেন, এসব বিবেচনায় রেখে পাস দেন গোলরক্ষকেরা।

    ট্যাকটিকাল দৃষ্টিকোণ থেকে, নিজেদের অর্ধে খেলোয়াড়ের ওভারলোড সৃষ্টিতে গোলরক্ষকেরা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। প্রতিপক্ষের গোলরক্ষক তো নিশ্চয়ই স্ট্রাইকারকে মার্ক করার জন্য বেশি উপরে উঠে আসবেন না, তাই পজেশন থাকা অবস্থায় চাইলেই নিজেদের অর্ধে নিউমেরিক্যাল সুপিরিয়রিটি তৈরি করা সম্ভব। অর্থাৎ গোলরক্ষক যদি বিল্ড-আপে অংশ নেন, নিজেদের অর্ধে ‘১১ বনাম ১০’ অবস্থা তৈরি করে আক্রমণে ওঠা সম্ভব। যদি প্রতিপক্ষ খুব প্রেসিং ফুটবলও খেলে, সেক্ষেত্রেও নিজেদের অর্ধে একজন খেলোয়াড় ফ্রি থাকছেন, ফলে প্রতিপক্ষের প্রেসটা হয়ে যাবে অকার্যকর।

    নিজ দলের পায়ে বল না থাকলে আধুনিক গোলরক্ষকের ভূমিকা

    একটা ব্যাপার স্বীকার করতেই হবে, ফুটবল খেলা আর তাতে গোলরক্ষকের ভূমিকা যতই বিবর্তিত হোক না কেন, গোলরক্ষকের মূল কাজ এখনো ঐ আদি এবং অকৃত্রিম, গোল বাঁচানো। তাই আধুনিক গোলরক্ষককে এটা মাথায় রাখতেই হবে, দল বল পজেশনে থাকলে তিনি যদি বেশি উপরে উঠে যান, দল পজেশন হারানোর সাথে সাথে প্রতিপক্ষ ফাঁকা গোলপোস্ট পেয়ে যাবে।

    তবে এটাও সত্য, আধুনিক গোলরক্ষকেরা অতীতের তুলনায় বেশি ঝুঁকি নেন। ডিফেন্সিভ লাইনটাও এখন বেশ উপরে থাকে, গোলরক্ষকদের শুরুর অবস্থানও মাঠের তুলনামূলক উপরের দিকে থাকে। সুইপার কিপার বলতে যা বোঝায়, এখনকার গোলরক্ষকেরা ম্যাচের শুরুতেই সেখানে অবস্থান করেন।

    [ক্লদিও ব্রাভো; ছবি: গেটি ইমেজেস]

    আধুনিক গোলরক্ষকেরা রক্ষণের জন্য পাকে অনেক বেশি ব্যবহার করেন, বল পেয়েই সাথে সাথে রান নেওয়ার জন্য এবং লং রেঞ্জ পাস দিয়ে বল ক্লিয়ার করার জন্য প্রস্তুত থাকেন। গোলপোস্টের কাছাকাছি অবস্থান করলে এই লবগুলো দেওয়া কঠিন, তাই গোলরক্ষকেরা সুযোগ পেলেই ছুটে এসে বল ক্লিয়ার করেন। এ কারণেই দুই পা এবং মাথা, সবগুলো ক্ষেত্রেই গোলরক্ষককে পারদর্শী হতে হয়।

    আত্মবিশ্বাস আর দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, এই দুটো ব্যাপারই আধুনিক গোলরক্ষকের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এক মুহূর্তের সিদ্ধান্তহীনতা ডেকে আনতে পারে বিপর্যয়, সেকেন্ডেরও ভগ্নাংশ সময়ই পর্যাপ্ত হতে পারে গোল হজমের জন্য। আধুনিক গোলরক্ষকেরা ঝুঁকি নেন বেশি, তাই ভুল হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি।

    দলে আধুনিক গোলরক্ষক থাকার সুবিধা

    দলে একজন আধুনিক গোলরক্ষক থাকলে বিল্ড-আপের ক্ষেত্রে আউটফিল্ডে একজন বাড়তি খেলোয়াড় পাওয়া যায়। নিচ থেকে খেলা তৈরির ক্ষেত্রে সংখ্যাতাত্ত্বিক সুবিধা পাওয়া যায়। ফাঁকায় দাঁড়ানো মিডফিল্ডারকে দ্রুত পাস দিয়ে আক্রমণে গতি আনা যায়।

    [জিয়ানলুইজি দোনারুমা; ছবি: গেটি ইমেজেস]

    দলে আধুনিক গোলরক্ষক থাকার অসুবিধা

    আধুনিক গোলরক্ষক থাকার কিছু ঝুঁকিও রয়েছে। গোলরক্ষকের মাধ্যমে আক্রমণ শুরু করলে নিজেদের পোস্টের সামনেই বল হারানোর ঝুঁকি থাকে। একটা ভুল পাসই যথেষ্ট হতে পারে বিব্রতকর গোল হজমের জন্য।