• আইসিসি বিশ্বকাপ ২০২৩
  • " />

     

    টস জয়, ফিল্ড প্লেসিং ও মাইন্ড গেম : যেভাবে আহমেদাবাদকে স্তব্ধ করে দিলেন কামিন্স

    টস জয়, ফিল্ড প্লেসিং ও মাইন্ড গেম : যেভাবে আহমেদাবাদকে স্তব্ধ করে দিলেন কামিন্স    

    অ্যালান বোর্ডার, স্টিভ ওয়াহ, রিকি পন্টিং, মাইকেল ক্লার্কের  অভিজাত দলে গতকাল নাম সিলগালা হয়ে গেল প্যাট কামিন্সের। ভারতকে তাদেরই ঘরের মাঠে ১ লাখ ২০ হাজার দর্শকের সামনে স্তব্ধ করে কামিন্সের অধীনেই ওয়ানডে বিশ্বকাপের ছয় নম্বর শিরোপাটা জিতল অস্ট্রেলিয়া। অজিদের বিশাল ক্রিকেটীয় রূপকথায় বিশ্বকাপজয়ী পঞ্চম অধিনায়ক এখন কামিন্স। অমরত্বের ছোঁয়াটাও পেয়ে গেছেন। কাগজে-কলমে অজিদের এই দলটা সেরা ছিল না। বিশ্বকাপ শুরু করেছিল টানা দুই হারে। সেই দলটা কীভাবে ঘুরে দাঁড়াল কামিন্সের নেতৃত্বে? কেমন ছিল তার এই দুর্দান্ত যাত্রাটা? 

    এর আগে প্রশ্ন করা দরকার, কেমন অধিনায়ক কামিন্স? তার পূর্বসূরিদের মতো ঠিক প্রথাগত অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক নন।  ডাকাবুকো, প্রতিপক্ষের সাথে কথার লড়াই জমানো, মাইন্ড গেম খেলায় পটু; অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের অধিনায়ক বলতে মানুষ এসবই দেখে এসেছে। আরো পরিষ্কার   করে বললে  মার্ক টেলরের মতো ট্যাকটিক্যালি সলিড, অ্যালান বোর্ডারের মতো স্লেজিংয়ে পটু, স্টিভ ওয়াহ-মাইকেল ক্লার্কের মতো মেন্টাল গেমে প্রতিপক্ষকে বিধ্বস্ত করে দেয়া, রিকি পন্টিংয়ের মতো সর্বজয়ী মানসিকতা; অস্ট্রেলিয়া দলের অধিনায়ক হিসেবে কেউ এলে এসবই খুঁজে বেরিয়েছেন ভক্ত-সমর্থক-ক্রিকেটপ্রেমীরা। 

    কিন্তু কামিন্সের হাসিমাখা চেহারা দেখে ওসব খুঁজে পাওয়ার উপায় নেই। হাঁটাচলা, কথাবার্তায় ঠিক অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়কের রাজকীয় ভাবটা ফুটে উঠে না। তবে মাঠের অধিনায়কত্বে ঠিকই নিজের সেরাটা দিয়ে এসেছেন, দিয়েছেন। ফলটাও পেয়েছে অস্ট্রেলিয়া। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ, অ্যাশেজের পর ওয়ানডে বিশ্বকাপের শিরোপা। একের পর এক এমন সাফল্য পেলে বাকিদের মতো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য না থাকলেও কিছু আসে যায় না।  সর্বশেষ সাফল্য পাওয়া বিশ্বকাপে কেমন করলেন? 

     

    টস জিতে সঠিক সিদ্ধান্ত

    আহমেদাবাদের যে উইকেট ফাইনালটা খেলা হয়েছিল, সেখানে এর আগে খেলেছিল ভারত-পাকিস্তান। তবে পার্থক্য হচ্ছে ফাইনালের উইকেটটা সেভাবে ঢেকে রাখা হয়নি। উইকেট ছিল খানিকটা ধীরগতির, শুষ্ক, জায়গাভেদে টু পেসড; অর্থাৎ পেসার-স্পিনারদের সবাই ই সুবিধা পাবেন। বিশেষত ভারতের দুই স্পিনারকে সামলাতে বেশ বেগ পেতে হতো অজি ব্যাটারদের। কারণ ওয়ার্নার-হেড-মার্শরা বলের লাইনে গিয়েই খেলতে পছন্দ করেন বেশি। লো উইকেটের টার্ন-স্পিন সামলে উঠাটাও কঠিনই হতো।

    আর দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করলে ফ্লাড লাইটের নিচে বল স্কিড করবে, ব্যাটে আসবে তুলনামূলক জলদি। রানও তোলা যাবে জলদি। আর ডিউ ফ্যাক্টর তো ছিলই। ভারতীয় স্পিনারদের বলে গ্রিপ করাটাও হতো কঠিন। তাই সব মিলিয়ে টস জিতে বোলিংয়ের সিদ্ধান্ত ছিল কামিন্সের। যেটা শিরোপা জেতায় হয়ে উঠেছিল এক্স ফ্যাক্টর। উইকেটের গতি-প্রকৃতি বুঝতে পারা, সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া; এর পেছনে আছে কামিন্সের দারুণ হোমওয়ার্ক।  

    বোলিং চেঞ্জ

    রোহিত শর্মা পুরো টুর্নামেন্টে যেভাবে খেলেছেন ফাইনালেও শুরুটা ঠিক সেভাবেই করেছিলেন। নিজের উইকেটের পরোয়া না করে হাত খুলে খেলতেন ইনিংসের প্রথম বল থেকেই। ৩০ বলে ততক্ষণে ফিফটির কাছেই পৌছে গেছেন। দুই স্ট্রাইক বোলার মিচেল স্টার্ক ও প্যাট কামিন্সকে সরিয়ে পাওয়ারপ্লেতে নিয়ে আসেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েলকে। এক ওভার পর সেই ম্যাক্সওয়েলই এনে দেন সাফল্য। আগের দুই বলে একটা করে ছক্কা আর চার মেরে রোহিত তখন আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। 

    সেই সুযোগটার অপেক্ষাতেই ছিলন ম্যাক্সওয়েল আর কামিন্স। ফ্লাইটেড ডেলিভারিটা এগিয়ে এসে খেলতে চাইলে মিস হিট হয় রোহিতের। কভার পয়েন্ট থেকে দৌড়ে গিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে দুর্দান্ত এক ক্যাচে রোহিতকে ফেরান ট্রাভিস হেড। সেখানেই ভারতের ওপর অজিদের চেপে বসা। কামিন্সের পরিকল্পনাটাই ছিল এমন,  রান লিক হলে হোক। উইকেটটা চাই। হলোও তাই। 

     

    দুরদর্শী পরিকল্পনা

    ৮১ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে ভারত তখন ব্যাকফুটেই। বিরাট কোহলি-লোকেশ রাহুল ব্যাট করছিলেন সাবধানে, দেখে শুনে। ওভারপ্রতি রানরেটও ছিল কম, ২-৩-এর ঘরে। ৯৭ বল পর পেয়েছিল বাউন্ডারির দেখা। সেই সময়টায় কামিন্স টানা বল করিয়ে গেছেন ট্রাভিস হেড-ম্যাক্সওয়েল-মিচেল মার্শদের মতো পার্ট টাইমারদের দিয়ে। উদ্দেশ্যে ছিল ডেথ বোলিংয়ের জন্য স্টার্ক-হ্যাজলউডদের ওভারগুলো বাঁচিয়ে রাখা। সেই দুরদর্শী পরিকল্পনা কাজে লেগেছে কামিন্সের। শেষদিকে তাই বোলিংয়ের অনেকগুলো অপশন ছিল কামিন্সের হাতে। কতটা কার্যকরী হলো এই সিদ্ধান্ত?  শেষ দশ ওভারে পাঁচ উইকেট হারিয়ে ভারত তুলতে পেরেছিল মাত্র ৪৩ রান। 

     

    ফিল্ড প্লেসিং

    কামিন্সের সেরা ফিল্ড প্লেসিংয়ের হাইলাইটস হয়ে রইল ফাইনাল ম্যাচটা। ম্যাচের ১০ থেকে ৩০ ওভারের মধ্যে ভারত খেলেছে বেশ ধীরেসুস্থে। ইনিংসের সেই পর্যায়ে কামিন্স ফিল্ড সাজিয়েছেন বিশেষ একটা ফর্মুলায়। মিড ওভারে সাধারণত সিংগেল-ডাবলসেই খেলতে চায় ব্যাটিং দল। এই কথা মাথায় রেখে কামিন্স উইকেটের দুই পাশের সার্কেলের সমান্তরালে ফিল্ডার রাখেননি। লং অনে ফিল্ডার থাকলে মিড উইকেট ছিল সার্কেলের মাঝে। আবার মিড উইকেট থেকে ডিপ মিড উইকেটে ফিল্ডার সরালে কামিন্স লং অনের ফিল্ডারকে নিয়ে আসতেন মিড অনে। বোলাররাও বল করে গেছেন সেই অনুযায়ী। যে কারণে সিংগেল বের করতে হিমশিম খেয়েছেন কোহলির মতো ব্যাটারও।  

    ডেথ ওভারে যখন টেইলএন্ডাররা ব্যাটিংয়ে আসার পর সার্কেলের ভেতরেই ছিল মিড অন, মিড অফ, মিড উইকেট আর কভার। ফাঁদ পেতে রেখেছিলেন কামিন্স। এমন ফিল্ড প্লেসিং দেখে যেকোনো ব্যাটারই মারতে চাইবে, খেলতে চাইবে সোজা ব্যাটে। রান বেরিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি সামনে রেখেও কামিন্স তার বোলারদের বল করিয়ে গেছেন এই ফিল্ড প্লেসিংয়েই। প্রলুব্ধ হয়ে শামি সোজা ব্যাটে খেলতে গিয়েই ক্যাচ দিয়েছিলেন উইকেটের পেছনে। 

     

    মাইন্ড গেম

    ভিরাট কোহলির উইকেটটা পেয়েছিলেন কামিন্সই। পেসারদের শর্ট বল, বাউন্সারগুলো খেলতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল কোহলিকে। ম্যাক্সওয়েলকে সরিয়ে নিজে বোলিংয়ে এসে কোহলিকে শুরুই করলেন বাউন্সার দিয়ে। ডিপ থার্ডম্যানে ফিল্ডার সেট করে রেখেছিলেন, সেখানে গাইড করে সিংগেল নিয়ে ওভারে শুরু করেন কোহলি। এক বলের ব্যবধানে আবারও কোহলি স্ট্রাইকে গেলে কামিন্সের হাত থেকে ছুটে যায় শর্ট অফ লেংথের ডেলিভারি। 

    তবে প্রথম শর্ট বলের মতো অফস্টাম্পের বাইরে সেটা পিচ করাননি। পিচিং লেংথ ছিল খানিকটা ভেতরে শরীর বরাবর। কোহলির শট খেলার জায়গাও তাই কমে আসে। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে অ্যাঙ্গুলার ব্যাটে থার্ড ম্যানে খেলতে গেলে ব্যাটের কানা ছুয়ে বল লাগে উইকেটে। বোল্ড হন কোহলি। কোহলি জানতেন শর্ট বল বা বাউন্সার আসছে। হয়তো একই লাইনে আশা করেছিলেন, তাই আগে থেকেই তৈরি ছিলেন মানসিকভাবে। কামিন্স ঠিক সেখানেই নিজের মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। আর ফাইনালের আগে সংবাদ সম্মেলনে যেভাবে বলেছিলেন, এক লাখ ৩০ হাজার দর্শকদের চুপ করিয়ে দিতে পারলে বেশ লাগবে তার, সেটাও হয়ে উঠেছে ফাইনালের পর চর্চিত বিষয়। 

    ভালো অধিনায়ক কতটা ভালো পারফর্মার? 

    এবার বিশ্বকাপে ১১ ম্যাচে নিয়েছেন ১৬ উইকেট। তবে এই ১৬ উইকেটের শেষ দুটি নিয়েছেন ফাইনালের মঞ্চে। কোহলি-আইয়ারের উইকেট নিয়েছেন মাত্র ৩৪ রানের খরচায়। স্বীকৃত ব্যাটার নন। তবুও আফগানিস্তানের বিপক্ষে নিশ্চিত হেরে যাওয়া ম্যাচটা বাঁচিয়েছেন ম্যাক্সওয়েলের পাগলাটে ব্যাটে চড়ে। ম্যাক্সওয়েলের ২০১*-এর সাথে তাই আলাদা করে মনে রাখতে হবে কামিন্সের ৬৮ বলে ১২* রানের ইনিংসটাও। 

    কামিন্স এই বিশ্বকাপজয়ী দলের সেরা পারফর্মার নন। তবে যখনই দরকার পড়েছে তখনই উদ্ধার করেছেন দলকে। হোক সেটা বল হাতে বুদ্ধিদ্বীপ্ত কোনো স্পেলে কিংবা ম্যাচ বাঁচানো ব্যাটিং ইনিংসে। আর সাথে অধিনায়কত্বের মাস্টারক্লাস তো আছেই।