• টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ
  • " />

     

    সূর্যকুমারের বিশ্বজয়ী ক্যাচ ও কিছু প্রশ্ন

    সূর্যকুমারের বিশ্বজয়ী ক্যাচ ও কিছু প্রশ্ন    

    দেজা ভ্যু হয়তো একেই বলে!

    বিশ্বকাপের ফাইনাল। প্রতিপক্ষের সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যাটসম্যান ব্যাটিংয়ে। ম্যাচটা দুলছে পেন্ডুলামের মতো। এমন সময়ে একটা কঠিন সুযোগ এলো ভারতের সামনে। অবিশ্বাস্য ক্ষীপ্রতায় ক্যাচটা লুফে নিলেন ভারতীয় ফিল্ডার। একে যদি দেজা ভ্যু না বলি, তবে আর কাকে বলবো!

    বাউন্ডারি লাইনে ওই অবিশ্বাস্য ক্যাচ ধরে সুরিয়াকুমার যাদব যেন ফিরিয়ে আনলেন ৪১ বছর আগের কপিল দেবকেই। ১৯৮৩ বিশ্বকাপের ফাইনালে, মদন লালের বলে পুল করতে গিয়ে টপ এজ হয়েছিল আক্রমণাত্মক ভিভ রিচার্ডসের। মিড উইকেট থেকে প্রায় বিশ গজ উল্টো দৌড়ে অসাধারণ এক ক্যাচ নিয়েছিলেন কপিল দেব। ভারতের ক্রিকেট-রূপকথার সেই উজ্জ্বল মুহূর্তটাই যেন ফিরে এলো সুরিয়াকুমারের ক্যাচে।

    '৮৩-এর কপিল ফিরে এলেন '২৪-এর সুরিয়া হয়ে; Image Source: ICC

    শেষ ওভারে প্রয়োজন ১৬ রান। এমন ক্ষেত্রে ওভারের প্রথম বলটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর হার্দিক পান্ডিয়া কি না করে বসলেন একটা ফুলটস, তাও অফস্ট্যাম্পের বাইরে! ডেভিড মিলার চাইলে মাঠের যেকোন প্রান্ত দিয়ে খেলতে পারতেন শটটা। কিন্তু তিনি বেছে নিলেন লং অফকেই। লং অফ আর সাইট স্ক্রিনের ওপর দিয়েই উড়িয়ে মারলেন বলটা। পুরো গ্যালারি তখন স্তম্ভিত, মাঠের সবগুলো চোখ বলের দিকে। বলটা উড়ে যাচ্ছে বাউন্ডারির ওপারে…

    সুরিয়ার সেই ক্যাচ; Image Source: Getty Images

    সুরিয়াকুমার যাদব অবশ্য বলটা উড়ে যেতে দেখছিলেন না, তিনি দেখছিলেন মাথার ওপর দিয়ে বিশ্বকাপটাই ভেসে যেতে। বাঁ দিকে দৌড়ে এলেন তিনি, একদম ঠিক মুহূর্তে লাফ দিলেন। বলটা আটকে গেল তাঁর হাতে। কিন্তু সাথে সাথে সুরিয়াকুমার বুঝতে পারলেন, বাউন্ডারির ভেতরে ভারসাম্য রাখতে পারছেন না তিনি। বাউন্ডারির বাইরে যেতেই হবে তাঁকে। গেলেনও। কিন্তু এর আগে বলটা ছুঁড়ে দিলেন ভেতরে, আর নিজের পাকে লাগতে দিলেন না বাউন্ডারি দড়িতে। এরপর আবার মাঠে ফিরে এলেন, ক্যাচটা তালুবন্দী করলেন পুনরায়। জানতেন, ক্যাচ নয়, তিনি তালুবন্দী করেছেন বিশ্বকাপটাই। তবুও আম্পায়াররা রুটিন চেক করলেন কিছুক্ষণ, এরপর রায়টা এলো ভারতের পক্ষেই। মিলার আউট! এক ক্যাচ দিয়েই ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দিলেন সুরিয়াকুমার!

    বাউন্ডারিতে পা লাগেনি সুরিয়াকুমারের, আম্পায়ারের রায়; Image Source: ICC

    আর বিতর্কেরও খুব বেশি সুযোগ নেই ক্যাচটা নিয়ে। বাউন্ডারিতে সুরিয়ার পা লেগেছে, এমন কোন শক্ত প্রমাণ নেই। দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক এইডেন মার্করামও জানেন সেটা। আউটের সিদ্ধান্ত নিয়ে আপত্তি না থাকলেও আম্পায়াররা আরো কিছুক্ষণ টিভি রিপ্লে দেখতেই পারতেন, এমনটাই তাঁর মতামত।

    “সত্যি বলতে, আমি এটা এখনও দেখিনি। দেখতে পারিনি। হ্যাঁ, রিপ্লে একটু দ্রুতই হয়েছে। অবশ্যই তারা বেশ নিশ্চিতই ছিল যে এটা আউট এবং এই কারণেই রিপ্লে দ্রুত দেখেছে।”

    -এইডেন মার্করাম, অধিনায়ক, দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট দল

    বাউন্ডারি কি সত্যিই সরে গিয়েছিল ফাইনালে? Image Source: ICC

    তবে রিপ্লেতে উঠে এসেছে আরো একটা ব্যাপার। ক্যাচ নেওয়ার সময়ে সুরিয়াকুমারের পা যেখানে পড়েছিল, সেই জায়গার বাউন্ডারির কুশনটা সরে গিয়ে দেখা যাচ্ছিল মরা ঘাস। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাই অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, বাউন্ডারিটা কি সরে গিয়েছিল তার স্বাভাবিক অবস্থান থেকে? যদি সেটা হয়ে থাকে, তাহলে আইসিসির নিয়মটাই বা কী বলে?

    ক্রিকেট আইনের ১৯.৩ ধারায় বলা হয়েছে এ সম্পর্কে। “রিস্টোরিং দ্যা বাউন্ডারি” নামক ওই আইনে বলা আছে, বাউন্ডারি যদি কোন কারণে সরে যায়, সেক্ষেত্রে বাউন্ডারি হিসেবে বিবেচনা করতে হবে এর আগের অবস্থানকেই। আর পাশাপাশি, বল ডেড হওয়ার সাথে সাথে, দ্রুততম সময়ে বাউন্ডারিকে ফিরিয়ে আনতে হবে আগের জায়গায়।

    এবার ফেরা যাক সুরিয়াকুমারের ওই ক্যাচের ব্যাপারে। বাউন্ডারির কুশনের সামনে একটা মরা ঘাসের দাগ দেখা গেছে, যেটা থেকে দুটো সিদ্ধান্তে আসা যায়। প্রথমত, ওই দাগটা হতে পারে ওই মাঠে অনুষ্ঠিত টুর্নামেন্টের আগের কোন ম্যাচের বাউন্ডারির দাগ। দ্বিতীয়ত, বাতাস বা অন্য যেকোন কারণে বাউন্ডারি সরে যেতে পারে এই ম্যাচ চলাকালে। কিন্তু এখন পর্যন্ত দ্বিতীয় সম্ভাবনার পেছনে কোন শক্ত প্রমাণ পাওয়া যায়নি, আম্পায়াররা তাই কুশনকেই ধরেছেন বাউন্ডারি হিসেবে। সুরিয়ার ক্যাচটাও তাই পুরোপুরি ফেয়ার, অন্তত এখন পর্যন্ত।

    পাকিস্তান-নেদারল্যান্ডস ম্যাচে সরে গিয়েছিল বাউন্ডারি; Image Source: ICC

    তবে বাউন্ডারি সরে যাওয়ার ঘটনা আগেও ঘটেছে ক্রিকেটে। ২০২৩ বিশ্বকাপে পাকিস্তান-নেদারল্যান্ডস ম্যাচে দেখা গিয়েছিল বাউন্ডারিকে নির্ধারিত জায়গা থেকে সরে যেতে। তবে ওই পরিবর্তিত বাউন্ডারিতে কোন ছক্কা বা আউটের ঘটনা না ঘটায় এটা নিয়ে পরে আর তেমন কথাবার্তা হয়নি।

    কুশল মেন্ডিসের 'ফেয়ার' ক্যাচ নিলেন ইমাম-উল-হক; Image Source: ICC

    প্রায় একই ব্যাপার ঘটেছিল ওই বিশ্বকাপের পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা ম্যাচেও। কুশল মেন্ডিসের স্লগ সুইপটা বাউন্ডারিতে তালুবন্দী করেছিলেন পাকিস্তানি ফিল্ডার ইমাম-উল-হক। ক্যাচ নিয়ে যখন গড়িয়ে পড়ছেন ইমাম, তখন তাঁর হাতের নিচে দেখা গিয়েছিল আগের বাউন্ডারির মরা ঘাসের দাগ। কিন্তু ওই দাগটা ছিল ওই টুর্নামেন্টের আগের কোন ম্যাচের, অর্থাৎ পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা ম্যাচে বাউন্ডারি সরে যাওয়ার কোন ঘটনা ঘটেনি। আম্পায়াররাও তাই মেন্ডিসকে আউট বলেই ঘোষণা করেছিলেন। এবং সেই একই কারণে, অর্থাৎ শক্ত ও নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া না যাওয়ায়, সুরিয়াকুমারের ক্যাচটা নিয়েও আপাতত বিতর্কের অবকাশ নেই।

    তবে দক্ষিণ আফ্রিকা চাইলে ভাগ্যকে দুষতেই পারে। এই টুর্নামেন্টের বাংলাদেশ আর ইংল্যান্ডের বিপক্ষের ম্যাচে প্রায় একই অবস্থায় দুটো দুর্দান্ত ক্যাচ নিয়ে ম্যাচ ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন অধিনায়ক এইডেন মার্করাম। মাহমুদউল্লাহ ও হ্যারি ব্রুকের ওই দুটো ক্যাচ একটু এদিক ওদিক হলেই টুর্নামেন্টের চিত্র বদলে যেতে পারতো।

    মার্করামের ওই দুই ক্যাচেই খুলেছিল প্রোটিয়াদের ভাগ্য; Image Source: ICC

    সেই দক্ষিণ আফ্রিকাই ভাগ্যের সহায়তাটা পেলো না ফাইনালের মহাগুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে। মিলারের শটটা যদি আর এক গজ বেশি যেত, সুরিয়ার হাত ফসকে বলটা যদি সীমানাদড়ির ওপারে গিয়ে পড়তো, বা তাঁর পা যদি বাউন্ডারিতে লেগে যেতো।

    মাথা নিচু করেই মঞ্চ থেকে নামতে হলো মার্করামকে; Image Source: Getty Images

    দিনশেষে এটাই ক্রিকেটের সৌন্দর্য, যেখানে গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলাটার ফলাফলটা গড়ে দিতে পারে বাউন্ডারি দড়ি আর সুরিয়াকুমারের পায়ের ওই সামান্য দূরত্বটাই, দক্ষিণ আফ্রিকার অশ্রু-মেশানো হতাশা আর ভারতের শিরোপা-উল্লাসের মধ্যে পার্থক্যও!