বৈরী বাংলাদেশে ম্লান ক্রীড়া-উৎসব
এই তো মাত্র দুই সপ্তাহ আগের কথা।
কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো ইউরো আর কোপা আমেরিকার ফাইনাল। দীর্ঘ এক যুগ পর ইউরোর শিরোপা পুনরুদ্ধার করলো স্প্যানিশরা, কোপা আমেরিকার রুপোলি ট্রফিটা রইলো আর্জেন্টিনার কাছেই। আর ইউরো-কোপাতে এই দুই দলের জয় মানেই আগামী বছর অনুষ্ঠিতব্য ফিনালিসিমাতে দুই স্প্যানিশ ভাষাভাষী দলের লড়াই। সেই লড়াইতে মুখোমুখি হবেন দুই দলের দুই কোচ লুইস দে লা ফুয়েন্তে আর লিওনেল স্কালোনি, যাঁরা আবার সম্পর্কে গুরু-শিষ্য। ওদিকে লিওনেল মেসি আর লামিন ইয়ামালের লড়াইটা বার্সেলোনা-ভক্তদের বাড়তি আবেগে ভাসাবেই, এক বছর বয়সী ছোট্ট ইয়ামালকে মেসির গোসল করানোর দৃশ্যটাও মনে পড়বে অনেকের।
কিন্তু, সেই আবেগ, সেই উন্মাদনার ছিটেফোঁটাও কি গত দুই সপ্তাহে চোখে পড়েছে আপনার?
স্পেনের তরুণ নিকো উইলিয়ামস, লামিন ইয়ামালরা জিতলেন ক্যারিয়ারের প্রথম ইউরোটা। ওদিকে লিওনেল মেসি আর আনহেল ডি মারিয়া শিরোপা জিতে শেষ করলেন তাঁদের কোপা আমেরিকা ক্যারিয়ার। দুটো ঘটনার একটাও কি পর্যাপ্ত উদযাপিত হয়েছে বাংলাদেশে?
উত্তরটা আপনি জানেন, “না”।
মেসি-ইয়ামালদের সাফল্যও তেমন উদযাপিত হয়নি বাংলাদেশে; Image Source: Getty Images
বাংলাদেশে স্পেনের সমর্থকগোষ্ঠী খুব বড় না বিধায় তাদেরকে না হয় আর্জেন্টিনার সাথে একই বন্ধনীতে রাখলাম না। আর্জেন্টিনার ‘২২ বিশ্বকাপ বা ‘২১ কোপা আমেরিকার জয়ের উদযাপন বাদই দিলাম, ‘২২-এর ফিনালিসিমা জয়ের উদযাপনের কাছাকাছি কিছুও কি এবারের কোপা আমেরিকা জয়ের পরে হয়েছে? বাস্তব জীবনের কথাও বাদ রাখলাম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে?
এর উত্তরও আপনি জানেন। “না”।
জমজমাট ইউরো-কোপার পরে এবং পরবর্তী ক্লাব মৌসুম শুরুর আগে বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমী, অথবা মোটাদাগে ক্রীড়াপ্রেমীদের এমন নিষ্ক্রিয়তা আপনি যখন দেখেছেন, তখনও সম্ভবত এই দেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এতটা বিস্তার লাভ করেনি। বিশেষত ফেসবুককেন্দ্রিক খেলাধুলা-সংশ্লিষ্ট গ্রুপ এবং পেইজগুলোর কল্যাণে মানুষের মধ্যে ক্রীড়া-উন্মাদনাটা আপনি দেখেছেন বছরব্যাপীই।
সেই আপনিই যদি মোটামুটি পনেরো-ষোল দিনের ‘কোমা’ থেকে উঠে ফেসবুকে লগ ইন করেন, নিশ্চিতভাবেই চমকে যাবেন। ফুটবল, ক্রিকেট, বা যেকোন ধরনের খেলাধুলা বিষয়ক গ্রুপগুলো এখন একেবারেই নিস্তেজ, খেলাধুলা-সংশ্লিষ্ট ওয়েব পোর্টালগুলোর কার্যক্রমও কমে এসেছে অনেকটা। মেসির কোপা আমেরিকা জয়ের উদযাপনটা বলতে গেলে একেবারেই হয়নি। ‘গ্রেটেস্ট শো অন দ্যা আর্থ’ খ্যাত অলিম্পিক যে চলছে, সেই খবরটাও রাখছেন না খুব বেশি মানুষ। ‘প্রায়োরিটি লিস্টে’ খেলাধুলা বা বিনোদন এখন একেবারেই পেছনের দিকে।
এর কারণটাও আপনি জানেন।
বাংলাদেশে যেকোন ধরনের খেলাধুলার সবচেয়ে বড় দর্শকগোষ্ঠীটা অবধারিতভাবেই এই দেশের কিশোর-তরুণরা। সাধারণভাবে স্কুলজীবন থেকে খেলাধুলার প্রতি ভালোবাসার যে বীজটা বপন হয় শিশু-কিশোরদের মনে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সেই বীজ থেকে জন্মানো চারাগাছটা পরিণত হয় বিশাল মহীরুহে। আর বাংলাদেশের কিশোর-তরুণরা এখন ভালো নেই। কোটা-সংস্কার থেকে শুরু হওয়া আন্দোলনটা এখন ছড়িয়ে গেছে অনেকটা, আর এর সামনের সারিতেও রয়েছে এই তরুণরাই। মৃত্যুর মিছিলেও নেতৃত্ব দিচ্ছে তারাই। অবুঝ শিশু আর সম্ভাবনাময় কিশোরদের মৃত্যুগুলো ছাপ রেখে যাচ্ছে জনমনে, কিন্তু সংখ্যার বিচারে অনেক এগিয়ে এই বিদ্রোহী তরুণরাই। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাট আর টিকটক প্রজন্মের তরুণরাই নিজেদের অধিকার আদায়ে এগিয়ে এসেছেন, পুলিশের বন্দুকের সামনে বুক পেতে দিচ্ছেন নির্ভয়ে, খেয়াল রাখছেন সহপাঠী-সহযোদ্ধাদের, দমে যাচ্ছেন না অত্যাচারীর গুম-গ্রেফতার-হত্যা-নিপীড়নেও। ‘রাষ্ট্র-সংস্কার’-ই যখন তরুণদের মূল লক্ষ্য, খেলাধুলার ন্যূনতম আলোচনাও সেখানে অনাকাঙ্ক্ষিত। কোপা-ইউরো-অলিম্পিক, টি-টোয়েন্টি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ অথবা ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবলের প্রাক-মৌসুম, তরুণদের মনোযোগ কাড়তে ব্যর্থ সবই।
নির্ভীক আবু সাঈদ, বুক যেন বাংলাদেশের হৃদয়; Image Source: Collected from Facebook
তরুণদের এই অগ্রযাত্রায় পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন সমাজের অপেক্ষাকৃত বয়স্করাও। শিক্ষক, আইনজীবী, পেশাজীবী থেকে শুরু করে সাধারণ রিকশাচালক, সিএনজিচালক বা শ্রমিকরাও এখন তরুণদের দাবির সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। তরুণদের চিন্তায়, মননে, মস্তিষ্কে এখন শুধুই বাংলাদেশ আর বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি। খেলাধুলো চুলোয় যাক, সবার আগে তো দেশ, তাই না!
যুগসন্ধিক্ষণের এই ক্ষণে, খেলাধুলা দিয়ে এই তরুণদের মনোযোগকে হয়তো সরানো যাবে না, সরানো উচিতও না। কিন্তু এটুকু বলে দেওয়াই যায়, পরিস্থিতি শান্ত হলে, আবারও আগের মতো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে গেলে, এই তরুণরাই হবেন বিশ্ব ক্রিকেট আর ফুটবলের বড় সমঝদার। আবারও রাত জেগে খেলা দেখা হবে, প্রিয় দল নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হবে, চায়ের কাপে ঝড় উঠবে। এই ইউরো-কোপার বকেয়া আলোচনাগুলো আবারও প্রাণ ফিরে পাবে। অলিম্পিকের উত্তেজনাপূর্ণ কোন ইভেন্টের ফাইনাল দেখতে টিভির সামনে ভিড় করবে তারা। ক্লাব ফুটবলের প্রাক-মৌসুম দেখে আন্দাজ করবে প্রিয় দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে। মেসি-রোনালদো বা বার্সেলোনা-রিয়াল মাদ্রিদ তর্কগুলো জমে উঠবে আবার। বাংলাদেশের ক্রিকেটও হয়তো ফিরে পাবে তার দর্শকদের।
আর এর আগ পর্যন্ত, সকল অত্যাচারীর বিপক্ষে সাহসের সাথে দাঁড়ানো এই অকুতোভয় তরুণসমাজকে না হয় অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে শুভকামনা জানানো যাক!
[প্রকাশিত সকল বক্তব্য ও মতামত লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত।]