• ক্লাব ফুটবল
  • " />

     

    উলত্রাস সুর: স্বয়ং পেরেজ নিষিদ্ধ করেছিলেন যাদের। ফুটবলের পাগলা ফ্যানরা। পর্ব ১

    উলত্রাস সুর: স্বয়ং পেরেজ নিষিদ্ধ করেছিলেন যাদের। ফুটবলের পাগলা ফ্যানরা। পর্ব ১    

    বাড়িতে টেলিভিশনের সামনে সোফায় বসে বা ফোন হাতে নিয়ে বিছানায় শুয়ে ফুটবল ম্যাচ দেখতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন বেশিরভাগ দর্শক-সমর্থক। কিন্তু ফুটবলের পাগলাটে সমর্থকদের কি আর এমন ‘নিরানন্দ’ পরিবেশে খেলা দেখতে ভালো লাগে! তাই মাঠে যাওয়া, গ্যালারিতে হই-হুল্লোড় করা, প্রিয় দলের সাফল্য উদযাপন করা, সমমনা সমর্থকদের সাথে যোগাযোগ করা, এই ব্যাপারগুলো চলেছে যুগে যুগে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ফুটবল শুধুই বিনোদনের মাধ্যম হিসেবেই থেমে থাকেনি। আর্থ-সামাজিক অবস্থা, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, জাতীয়তাবাদ আর সময়ে সময়ে জাতিগত ঐক্যের মাধ্যম হিসেবেও সামনে এসেছে চর্মগোলকের খেলাটা। সমর্থকদের মধ্যেও ছড়িয়েছে ব্যাপারগুলো, আর তৈরি হয়েছে ক্লাব এবং জাতীয় দলগুলোর একের পর এক পাগলাটে সমর্থকদল বা ফ্যান গ্রুপ।

    ফুটবলের এমন সব বিখ্যাত পাগলাটে সমর্থকদলের গল্প নিয়েই প্যাভিলিয়নের এই আয়োজন, “ফুটবলের পাগলা ফ্যানরা”। এই সিরিজের প্রথম পর্বে থাকছে ইউরোপীয় পরাশক্তি রিয়াল মাদ্রিদের সমর্থকদল “উলত্রাস সুর”-এর গল্পগুলো।

    স্প্যানিশ ‘উলত্রাস’ শব্দটাকে অনেকভাবেই অনুবাদ করা যায়। গোঁড়া, চরমপন্থী, বা সহজ ভাষায়, সীমা অতিক্রমকারীদেরই সাধারণভাবে উলত্রাস বলা হয়। আর “সুর” শব্দটাকে ইংরেজিতে অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘সাউদার্ন’। সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর গ্যালারির দক্ষিণ পাশটা দখলে নেওয়ার কারণেই মূলত রিয়াল মাদ্রিদের এই সমর্থকগোষ্ঠীর নাম ‘উলত্রাস সুর’।

    উলত্রাস সুরের শুরুটা আজ থেকে প্রায় ৪৪ বছর আগে। এই শুরুর পেছনের প্রেক্ষাপটটা একটু জানিয়ে রাখা যাক।

    রিয়াল মাদ্রিদের হোম ভেন্যুর নাম যে সান্তিয়াগো বার্নাব্যু, সেটা তো সবাই জানে। তবে ১৯৫৫ সালে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর নামে নামকরণ করার আগ পর্যন্ত রিয়ালের স্টেডিয়ামের নাম ছিল নুয়েভো চামার্তিন স্টেডিয়াম। ওই স্টেডিয়ামে কোন কৃত্রিম আলোকসজ্জা বা ফ্লাডলাইটের ব্যবস্থা ছিল না বিধায় সব ম্যাচ অনুষ্ঠিত হতো দিনের আলোতে।

    Image Source: Getty Images

    সেই নুয়েভো চামার্টিন স্টেডিয়ামটা অবশ্যই এখনকার সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর মতো উন্নত ছিল না। গ্যালারির সব অংশেও সবসময়ে সমানভাবে সূর্যালোক পড়তো না। রিয়াল মাদ্রিদ তাই চাইতো ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে গ্যালারির অপেক্ষাকৃত ছায়াঘেরা অংশের দিকে আক্রমণ করতে। সেই দিকটাই ছিল মাঠের দক্ষিণ দিক, আর ওই অংশে টিকেটের দাম কম হওয়ায় জনসমাগম হতো বেশি। পরবর্তীতে স্টেডিয়ামের সংস্কার এবং উন্নয়ন হয়েছে কয়েকবার, কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা হয়েছে, দিনের পরিবর্তে বেশি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে রাতে, তবে গ্যালারির দক্ষিণ প্রান্তে দর্শকদের ওই উপস্থিতির ধারাটা রয়েই গেছে।

    গ্যালারির দক্ষিণ প্রান্তে জড়ো হওয়া দর্শকদের সংগঠনের মধ্যে প্রথম দিকে ছিল ‘লা পেনা দে লাস বান্দেরাস’ বা ‘দ্য সাপোর্টার্স গ্রুপ অব ফ্ল্যাগস’। বর্তমানে অবশ্য তাদেরকে ‘লা ক্লাসিকা’ বা ‘দ্য ক্লাসিক ওয়ান’ বলা হয়। কিন্তু কিছুদিন পর, ১৯৮০ সালে, ওই সংগঠন থেকে কিছু সমর্থক আলাদা হয়ে যান এবং তৈরি করেন ‘উলত্রাস সুর’ নামক সমর্থকদল। অতি ডানপন্থী মানসিকতার এই সমর্থকেরা অনুপ্রাণিত ছিলেন ইংল্যান্ড আর ইতালির চরমপন্থী সমর্থকদের থেকে। হোসে লুইস ওচাইতা নামক এক ‘পাগলাটে’ সমর্থকের নেতৃত্বে যাত্রা শুরু হয় উলত্রাস সুরের, আর শুরু থেকেই তাঁরা অনুসরণ করতেন স্প্যানিশ স্বৈরশাসক জেনারেল ফ্রাঙ্কোকে। 

    উলত্রাস সুরের নেতা ওচাইতা মানুষ হিসেবে খুব একটা সুবিধার ছিলেন না। বিভিন্ন সময়ে মাঠে এবং মাঠের বাইরে গণ্ডগোল করে নিষেধাজ্ঞা পেয়েছেন তিনি। ১৯৯৮ সালে জার্মানিতে ম্যাচ চলাকালে নাৎসি পতাকা উড়িয়ে গ্রেফতার হন তিনি। এছাড়া রিয়াল মাদ্রিদ আর বার্সেলোনার মধ্যে বাস্কেটবল ম্যাচে রেফারিকে আক্রমণ করে তিন বছরের জন্য নিষেধাজ্ঞা পেয়েছিলেন। তাঁর অধীনে উলত্রাস সুর হয়ে ওঠে আরো বেশি রাজনৈতিক এবং বর্ণবাদী, আর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে সদস্যসংখ্যা। 

    Image Source: Getty Images

    রিয়াল মাদ্রিদের তৎকালীন সভাপতিরাও বৈধতা দেন উলত্রাস সুরকে। সাবেক সভাপতি র‍্যামন মেন্দোজা (১৯৮৫-১৯৯৫) এবং লরেঞ্জো সাঞ্জ (১৯৯৫-২০০০) তাঁদের সাথে ছবিও তুলেছিলেন। মোটামুটি ২০০০ সাল অবধি বার্নাব্যুতে নিজেদের কার্যালয় ছিল উলত্রাস সুরের। নিজেদের বর্ণবাদী এবং সহিংস বার্তাসমেত ব্যানারগুলো সেখানেই রেখে দিতেন তাঁরা। আর শুধু গ্যালারিতে থেকে টিফো, ড্রাম বাজানো, সমগ্র স্টেডিয়াম ধোঁয়াচ্ছন্ন করে তোলা, আতশবাজি ফুটানো বা প্রতিপক্ষকে মানসিকভাবে পর্যদুস্ত করা আর স্লোগান দেওয়াই নয়, এ সময়ে উলত্রাস সুর জড়িয়ে পড়ে অন্যান্য অপরাধেও। অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের পাগলাটে সমর্থকদল ফ্রেন্তে আতলেতিকো আর বার্সেলোনার বইসোস নয়েসের সাথে নিয়মিত সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তেন তাঁরা। মিডিয়ায় উলত্রাস সুরের বিপক্ষে লেখালেখি শুরু হলেও, ক্লাব এবং মাদ্রিদের অন্যান্য সমর্থকদের কাছে এর জনপ্রিয়তা ছিল অক্ষুণ্ণ।

    জনপ্রিয়তায় ভাটার টান লাগতে শুরু করে ১৯৯৮ সালে। ওই বছর ইউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদের মুখোমুখি হয়েছিল বরুশিয়া ডর্টমুন্ড। সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে ম্যাচ শুরুর আগে উলত্রাস সুরের তাণ্ডবে ভেঙে পড়ে স্টেডিয়ামের দক্ষিণ পাশের গোলপোস্ট, আর সেটা সারিয়ে খেলা শুরু করতে করতে লেগে যায় অতিরিক্ত প্রায় ৭৫ মিনিট। ফলস্বরূপ, ইউয়েফা এক ম্যাচের জন্য দর্শকদের উপস্থিতি নিষিদ্ধ করে বার্নাব্যুতে, সাথে ছিল প্রায় সাত লক্ষ ইউরো জরিমানা।

    ২০০৫ সালে রেসিং সান্তান্দারের বিপক্ষে ম্যাচে উলত্রাস সুরকে দেখা গিয়েছিলো বর্ণবাদী ব্যানার নিয়ে মাঠে আসতে। ম্যাচের পরে লেফটব্যাক রবার্তো কার্লোস আবার নিজে জার্সি দিয়েছিলেন ওচেইতাকে, যদিও পরবর্তীতে এই কাজের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন তিনি।

    ভরা সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে উলত্রাস সুরের এসব উন্মত্ত আচরণ সমর্থকদের কাছে এর আবেদনকে কমিয়ে দেয়। তবে উলত্রাস সুর থাকে বহাল তবিয়তেই। বিশেষ করে ২০১০ থেকে ২০১৩ এর মধ্যে, রিয়াল মাদ্রিদের ম্যানেজার হোসে মরিনহো ছিলেন উলত্রাস সুরের বড় ভক্ত।

    এল ক্লাসিকো মানেই তখন রমরমা ব্যাপার। এক পাশে পেপ গার্দিওলার সর্বজয়ী বার্সেলোনা, আরেকপাশে হোসে মরিনহোর ‘গ্যালাকটিকো’ রিয়াল মাদ্রিদ। প্রতিটা ক্লাসিকোই তখন জন্ম দিতো নতুন নতুন ঘটনার। ২০১১ সালে, স্প্যানিশ সুপারকোপাতে অনুষ্ঠিত এমনই এক ক্লাসিকোতে হাতাহাতির এক পর্যায়ে বার্সার সহকারী ম্যানেজার টিটো ভিলানোভার চোখে খোঁচা দিয়েছিলেন মাদ্রিদ ম্যানেজার হোসে মরিনহো। সেই ঘটনায় মরিনহো প্রচণ্ড বিতর্কিত হলেও তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল উলত্রাস সুর। বার্নাব্যুতে ব্যানার দেখা গিয়েছিল, “ইয়োর ফিঙ্গার পয়েন্টস দ্য ওয়ে”।

    মরিনহোর তরফ থেকেও উলত্রাস সুরের সাধুবাদ শোনা গিয়েছিল বারবার। জুন ২০১৩, যখন মরিনহোর সাথে মাদ্রিদের সম্পর্ক শেষ হওয়ার পথে, তখন তাঁর মুখে শোনা গিয়েছিল কেবল গ্যালারির দক্ষিণ প্রান্তের প্রশংসা। দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার সময়ে উলত্রাসের কাছ থেকে ফুলেল শুভেচ্ছাও পেয়েছিলেন তিনি, আর মিডিয়ার সামনে বলেছেন, “উলত্রাস সুর না থাকলে স্টেডিয়ামটা খালি খালি লাগে!”

    তবে মাঠে এবং মাঠের বাইরে উলত্রাসের বাড়াবাড়ি ভালো নজরে দেখছিলেন না রিয়াল মাদ্রিদের প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ। উলত্রাস নেতা ওচাইতার সাথে ক্লাবের সম্পর্কও খারাপ হতে থাকে। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে বার্নাব্যুতে উলত্রাস সুরের আগমন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে দেন পেরেজ।

    উলত্রাস সুরও বসে থাকেনি। উল্টো পেরেজের বিপক্ষে ক্যাম্পেইন শুরু করেন তাঁরা। পেরেজকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়, অভিযোগ আসে পেরেজের স্ত্রীর সমাধিতে হামলা করার।

    Image Source: Getty Images

    “আমি জানি কারা আমার স্ত্রীর সমাধিতে রঙ করেছে, আঁকিবুকি করেছে, লেখালেখি করেছে। কিন্তু তাতে আমার সিদ্ধান্ত বদল হবে না। ওরা এখানে আসতে পারবে না,” ২০১৪ সালে স্প্যানিশ রেডিও স্টেশন কাদেনা সারকে বলেছিলেন পেরেজ।

    ওই ২০১৩ সালেই নতুন ফ্যান গ্রুপ গঠন করে রিয়াল মাদ্রিদ, “গ্রাডা ইয়োভেন দে আনিমাসিওন” বা “ইয়াং সাপোর্টিং স্ট্যান্ড”। এখন এই সংগঠন পরিচিত হয়েছে “গ্রাডা ফ্যান্স আরএমসিএফ” নামে। উলত্রাস সুর বা এই ধরনের অতি ডানপন্থী কোন সংগঠনের সাথে সংযুক্তি না রেখে বরং তরুণ মাদ্রিদিস্তাদের গ্যালারির দক্ষিণ প্রান্তে জায়গা দেওয়াই ছিল এই সংগঠনের উদ্দেশ্য। 

    ২০১৪ এর জানুয়ারিতে, উলত্রাস সুর চেষ্টা করেছিল নতুন ভাবে বার্নাব্যুতে প্রবেশ করার। গ্রাডার সদস্যদের ভয় দেখিয়ে নিজেরা জায়গা করে নিতে চেয়েছিল গ্যালারিতে। কিন্তু রিয়াল মাদ্রিদ তাদের সিদ্ধান্তে ছিল অনড়। তাই উলত্রাসের সদস্যরা গ্যালারির অন্যান্য আসন দখলের চেষ্টা করলেও তা সফল হয়নি। অনেকেই ইতোমধ্যে নিষিদ্ধ ছিলেন, তাঁরাও গ্যালারিতে প্রবেশের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তাই উলত্রাসের অবস্থান হয় স্টেডিয়ামের বাইরে।

    ওদিকে গ্রাডার নতুন সদস্যদের জন্য নীতিমালা জারি করে রিয়াল মাদ্রিদ। দক্ষিণ গ্যালারির নিচের অংশে শুধুমাত্র মাদ্রিদের সাদা জার্সি পরা দর্শকদেরই প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়, পাশাপাশি মূলত তরুণরাই সেখানে ঢুকতে পারতেন। বর্ণবাদী, রাজনৈতিক বা অন্য যেকোন ধরনের উসকানিমূলক স্লোগান পুরোপুরি নিষিদ্ধ করে শুধু খেলায় মনোযোগ দেওয়ার ব্যাপারটাতে জোর দেওয়া হয়। 

    Image Source: MovistarLigadeCampeones

    সব মিলিয়ে, এই মুহূর্তে শুধু অ্যাওয়ে বা নিরপেক্ষ মাঠে অনুষ্ঠিত রিয়াল মাদ্রিদের ম্যাচগুলোতে গ্যালারিতে উলত্রাস সুরের কিছু সদস্যের উপস্থিতির কথা জানা যায়। কিন্তু মোটাদাগে এখন আর লস ব্লাঙ্কোসদের সাথে উলত্রাস সুরের কোন সাংগঠনিক সম্পর্ক নেই। তবে এখনো, ম্যাচের আগে এবং পরে, সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর বাইরে ড্রাম বাজিয়ে, স্লোগান দিয়ে, পরিবেশটা ধোঁয়াচ্ছন্ন করে তুলে ঠিকই নিজেদের উপস্থিতি জানান দেয় উলত্রাস সুর, সাথে যেন প্রতিপক্ষকেও বুঝিয়ে দেয়, “আমরা ছিলাম, আমরা আছি, আমরা থাকবো!”