• ক্লাব ফুটবল
  • " />

     

    দ্য ইয়েলো ওয়াল: ডর্টমুন্ডের আবেগ, ডর্টমুন্ডের পরিচয়। ফুটবলের পাগলা ফ্যানরা। পর্ব ২

    দ্য ইয়েলো ওয়াল: ডর্টমুন্ডের আবেগ, ডর্টমুন্ডের পরিচয়। ফুটবলের পাগলা ফ্যানরা। পর্ব ২    

    প্রায় এক যুগ আগের কথা।

    ‘ডের ক্লাসিকার’-এ বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের মুখোমুখি হতে সিগনাল ইদুনা পার্কে গিয়েছিল জার্মান পরাশক্তি বায়ার্ন মিউনিখ। ম্যাচের আগে বায়ার্নের বিশ্বকাপজয়ী মিডফিল্ডার বাস্তিয়ান শোয়েনস্টাইগারকে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে ডর্টমুন্ডের কোন কোন খেলোয়াড়কে নিয়ে তিনি চিন্তিত। উত্তরে শোয়েনস্টাইগার কোন খেলোয়াড়ের নাম বলেননি, বলেছিলেন, “ডর্টমুন্ডের ‘দ্য ইয়েলো ওয়াল’ আমাকে সবচেয়ে বেশি ভয় পাইয়ে দেয়।”

    ফুটবলের এমন সব বিখ্যাত পাগলাটে সমর্থকদলের গল্প নিয়েই প্যাভিলিয়নের এই আয়োজন, “ফুটবলের পাগলা ফ্যানরা”। এই সিরিজের দ্বিতীয় পর্বে থাকছে জার্মান পরাশক্তি বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের সমর্থকদল “দ্য ইয়েলো ওয়াল”-এর গল্পগুলো।

    তবে বার্সেলোনার ‘বইসোস নয়েস’ বা রিয়াল মাদ্রিদের ‘উলত্রাস সুর’-এর মতো ডর্টমুন্ডের ‘দ্য ইয়েলো ওয়াল’-কে অবশ্য সেই অর্থে কোন ফ্যানক্লাব বলা যায় না। বরং ডর্টমুন্ডের পাগলাটে সমর্থকরাই ম্যাচের দিন হোম ভেন্যু সিগনাল ইদুনা পার্কে তৈরি করেন এই ‘হলুদ দেয়াল’। তাই ইয়েলো ওয়াল সম্পর্কে জানতে হলে, সংক্ষেপে জানা প্রয়োজন সিগনাল ইদুনা পার্ক সম্পর্কে।

    Image Source: Getty Images

    বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের হোম ভেন্যুর অফিশিয়াল নাম সিগনাল ইদুনা পার্ক, এটা তো সবাই জানেন। ২০০৫ সালের আগ পর্যন্ত এই স্টেডিয়ামের নাম ছিল “ওয়েস্টফালেনস্তাদিওন”। ১৯৭১ সালে এই স্টেডিয়ামটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, আর এর তিন বছর পর প্রথম ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় এখানে। পরবর্তীতে, ১৯৭৪ এবং ২০০৬ সালের ফিফা বিশ্বকাপের ম্যাচ এখানে অনুষ্ঠিত হয়েছে, অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০০১ সালের উয়েফা কাপের ফাইনালও। 

    সিগনাল ইদুনা পার্কের দক্ষিণ পাশের প্রায় ২৫,০০০ দর্শক ধারণক্ষমতার অংশটাকে বলা হয় “সুডট্রিবিউনে”। সত্তরের দশকে এই অংশের ধারণক্ষমতা ছিল ১২,০০০ এর মতো। পরবর্তীতে নব্বইয়ের দশকে ডর্টমুন্ড ট্রফি জিততে শুরু করলে স্টেডিয়াম পুনঃসংস্কার করে এর ধারণক্ষমতা বাড়ানো হয়। এই অংশেই অবস্থান নেয় দ্য ইয়েলো ওয়াল। আর গ্যালারির এই অংশে অবস্থান করে হলুদ দেয়াল তৈরি করা সংগঠনটির নাম ‘দ্য ইউনিটি’, যদিও, হলুদ দেয়ালের মতো এর পর্দার পেছনের কারিগররা ততটা বিখ্যাত নন।

    ২০০৪ সালের কথা।

    মাঠে আর মাঠের বাইরে ডর্টমুন্ডের তখন বেহাল অবস্থা। অর্থনৈতিকভাবে দুরবস্থা চলছে, মাঠের পারফরম্যান্সও সুবিধার না। এমনই এক সময়ে, দ্য ইউনিটি ঠিক করলো গ্যালারিতে বিশাল মোজাইক তৈরি করার। আর সেজন্য তারা বেছে নিলো অস্কার ওয়াইল্ডের সেই বিখ্যাত উক্তিকে, “আঁধার পথ ধরে হেঁটে যায় অনেকেই, কিন্তু তাদের কয়জন তাকায় আকাশের উজ্জ্বল তারাদের দিকে?” (উই অল আর ইন দ্য গাটার বাট সাম অব আস আর লুকিং অ্যাট দ্য স্টারস)

    ম্যাচ চলাকালে দ্য ইউনিটি অবস্থান নিতো মাঠের দক্ষিণ পাশে, গোলরক্ষকের ঠিক পেছনে। তাদের মূল উদ্দেশ্যই ছিল যথাসম্ভব স্লোগান দিয়ে দলকে উজ্জীবিত রাখা। সেই সময়েই একটা বুদ্ধি খেলে যায় দ্য ইউনিটির নেতা ড্যানিয়েল লোর্চারের মাথায়। গ্যালারির ধারণক্ষমতা, সমর্থকদের আগ্রহ, সক্ষমতা এবং প্রভাবের কথা বিবেচনা করে একটা নতুন আইডিয়া উপস্থাপন করেন। দ্য ইউনিটির পাশাপাশি অন্যান্য দর্শকদেরও যদি উজ্জ্বল হলুদ জার্সি আর পতাকা নিয়ে মাঠে আসার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করা যায়, সেক্ষেত্রে খেলোয়াড়রা হয়তো আরো বেশি উজ্জীবিত হবেন। সেই আইডিয়া থেকেই যাত্রা শুরু হয় দ্য ইয়েলো ওয়ালের।

    Image Source: Getty Images

    কিন্তু হলুদ জার্সি বললেই তো আর হলো না। সবাই ঠিক একই রঙের জার্সি-পতাকা ব্যবহার না করলে তো ইয়েলো ওয়াল ‘পারফেক্ট’ হবে না। লোর্চার এবং দ্য ইউনিটির অন্যান্য সদস্যরা তাই যোগাযোগ করলেন একটা ডেনিশ কোম্পানির সাথে। প্রায় তিন মাইল কাপড় কিনে নেন, তৈরি করা হয় প্রায় চার হাজার পতাকা। সপ্তাহান্তে সেলাই মেশিন ভাড়া করে নিজেরাই সেটা ব্যবহার করতে শিখে নেন, এরপর শুরু হলো পতাকা-জার্সি তৈরি। সব মিলিয়ে, ইয়েলো ওয়ালের প্রস্তুতি নিতে নিতে পেরিয়ে গেল প্রায় পুরো মৌসুমটাই।

    তবে সেটাই ছিল শুরু। আর এখন তো দ্য ইয়েলো ওয়াল হয়ে গেছে সিগনাল ইদুনা পার্ক আর বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের সমার্থক। ব্যানার তৈরি, টিফো প্রদর্শন, স্লোগান দেওয়া, ড্রাম বাজানো, স্টেডিয়াম ধোঁয়াচ্ছন্ন করে তোলা… প্রতিপক্ষের মনে ভয় তৈরির জন্য সব কিছুই করতে রাজি ইয়েলো ওয়ালের ডর্টমুন্ড-সমর্থকরা। বিশেষ করে ইয়েলো ওয়ালের টিফোগুলো বরাবরই আকর্ষণীয়। বিদায়ের দিনে ওই টিফো দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন ইয়ুর্গেন ক্লপ। মার্কো রয়েসের শেষ হোম ম্যাচে তাঁর জার্সি নম্বর ‘১১’ নিয়েও তৈরি হয়েছিল টিফো। এই কয়েকদিন আগে, সেল্টিকের বিপক্ষের ম্যাচে চ্যাম্পিয়নস লিগের পরিবর্তিত ফরম্যাটের বিপক্ষে প্রতিবাদস্বরূপ “ইউয়েফা মাফিয়া” টিফো বানিয়ে আলোচনার জন্ম দেয় দ্য ইয়েলো ওয়াল।

    ইয়েলো ওয়ালের ব্যাপারে বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের সাবেক ম্যানেজার ইয়ুর্গেন ক্লপ বলেছিলেন, “দুই মিটার উঁচু একটা অন্ধকার টানেল থেকে বেরিয়ে আপনি যখন মাঠে প্রবেশ করবেন, মনে হবে যেন আপনি আরেকবার জন্মগ্রহণ করছেন। আপনি বেরিয়ে আসার সাথে সাথে পুরো জায়গাটা যেন বিস্ফোরিত হবে। অন্ধকার গহ্বর থেকে আলোর সমুদ্রে প্রবেশ করবেন আপনি। এরপর আপনি তাকাবেন বাঁয়ে, দেখবেন যেন গ্যালারির দেড় লাখ মানুষ যেন একসাথে পাগল হয়ে গেছেন।”

    Image Source: Getty Images

    জেরার্ড নামক কেন্টের একজন রেডিও রিপোর্টার বলেন, “ম্যাচের পঁয়তাল্লিশ মিনিট আগ থেকেই পুরো জায়গাটা গমগম করতে থাকে। আর ম্যাচে কোন গোল হলে মাঠটা রীতিমতো কাঁপতে থাকবে, আর সাথে বিয়ার দিয়ে আপনার একদফা গোসল হয়ে যাবে নিশ্চিত। এই পরিবেশটা আসলে বর্ণনার অতীত। ইয়েলো ওয়াল নিজের দলকে উৎসাহ দিচ্ছে, এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য ফুটবলে খুব কম আছে।”

    ইয়েলো ওয়ালের ব্যাপারে আরো একটা তথ্য দিয়ে রাখা যেতে পারে। এই হলুদ দেয়ালের নিচের প্রান্তটা তো অবস্থান করে গোলরক্ষকের থেকে হাতছোঁয়া দূরত্বে, আর উপরের প্রান্তটা তৈরি করে প্রায় ৩৭ ডিগ্রি কোণ। পুরো স্থাপনাটাই যেন স্কি-জাম্পের জন্য একেবারে যথাযথভাবে তৈরি, যার মাটি থেকে ছাদ পর্যন্ত পুরোটাই হলুদ!

    আর হ্যাঁ, আশ্চর্যজনক শোনাতে পারে, কিন্তু এই ইয়েলো ওয়ালের রূপ পরিবর্তিত হয় প্রতিযোগিতাভেদে। এর কারণও আছে। ডর্টমুন্ডের হোম ভেন্যু সিগনাল ইদুনা পার্কের ধারণক্ষমতা পরিবর্তনশীল। বুন্দেসলীগার ম্যাচে এই স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে পারেন ৮১,৩৬৫ দর্শক, কিন্তু ইউয়েফা বা ফিফার প্রতিযোগিতাগুলোতে সেই ধারণক্ষমতা নেমে আসে ৬৫,৮২৯-এ। ইউয়েফার নীতিমালা অনুসারে, মহাদেশীয় ক্লাব প্রতিযোগিতার ম্যাচগুলোতে অবশ্যই গ্যালারির সব দর্শকের জন্য আসনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। আর এসব প্রতিযোগিতায় কোন দর্শককে দাঁড়িয়ে খেলা দেখার অনুমতি দেয় না ইউয়েফা। অপরদিকে বুন্দেসলীগায় এমন কোন বিধিনিষেধ নেই। 

    Image Source: Getty Images

    ঠিক এই কারণেই, বুন্দেসলীগার ম্যাচে গ্যালারির দক্ষিণ পাশে, অর্থাৎ ইয়েলো ওয়ালের পাশে দর্শকদের আসনগুলো বন্ধ করে বা সরিয়ে ফেলা হয়। ফলে সেসব অংশে দুজন করে দর্শক দাঁড়ানোর সুযোগ পান। অন্যদিকে চ্যাম্পিয়নস লিগ বা ইউরোপা লিগের ম্যাচের আগে ওই আসনগুলো পুনরায় স্থাপন করা হয়, এবং দর্শক ধারণক্ষমতাও কিঞ্চিৎ কমে যায়। পাশাপাশি একটু হলেও রূপ পরিবর্তন করে ডর্টমুন্ডের হলুদ দেয়াল। তবে প্রতিটি ম্যাচের আগে সমস্বরে “ইউ উইল নেভার ওয়াক অ্যালোন” গাওয়া, স্টেডিয়ামের প্রেজেন্টার এবং সাবেক খেলোয়াড় নোবার্ট ডিকেলের কথার সাথে সাথে প্রতিধ্বনি তোলা, এই ব্যাপারগুলোতে পরিবর্তন আসে না।

    অর্থনৈতিকভাবে ইয়েলো ওয়াল অনেক ক্ষেত্রেই ডর্টমুন্ডের জন্য ‘ক্ষতিকর’ হিসেবে প্রতীয়মান হয়। সিজন-টিকেট কিনলে গড়ে ১৪ ইউরোর বিনিময়ে সিগনাল ইদুনা পার্কে বসে ডর্টমুন্ড প্রতিটা হোম ম্যাচ দেখা সম্ভব, পাশাপাশি থাকে কম দামে বিয়ার এবং অন্যান্য সুবিধা। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে একটু ক্ষতি হলেও ক্লাব-কর্তৃপক্ষ সেটা মেনে নেয় হাসিমুখেই। টিকেটের দাম বাড়াতে গিয়ে ক্লাবের ‘আত্মা’ বিক্রি করে দিতে রাজি নয় বরুশিয়া ডর্টমুন্ড!

    সত্যিই তো, ক্লাবের পরিচয়ের সাথে মিশে যাওয়া সমর্থকদের এই অকৃত্রিম আবেগকে কোন ক্লাবই বা হারাতে চাইবে!