• ক্লাব ফুটবল
  • " />

     

    বইসোস নয়েস: মাঠে নিষিদ্ধ, মাঠের বাইরে প্রতিপক্ষের আতঙ্ক। ফুটবলের পাগলা ফ্যানরা। পর্ব ৩

    বইসোস নয়েস: মাঠে নিষিদ্ধ, মাঠের বাইরে প্রতিপক্ষের আতঙ্ক। ফুটবলের পাগলা ফ্যানরা। পর্ব ৩    

    ২৩ নভেম্বর, ২০০২।

    মৌসুমের প্রথম এল ক্লাসিকো। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনার মুখোমুখি হতে কাতালুনিয়ায় গেলো রিয়াল মাদ্রিদ। এমনিতেই এল ক্লাসিকো মানেই দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে থাকে বাড়তি উত্তেজনা, আর বিশেষ করে ওই ক্লাসিকো নিয়ে বার্সা সমর্থকদের ভেতরে ছিল একটু বেশি উত্তাপ। দুই বছর আগের গ্রীষ্মেই বার্সেলোনা থেকে রিয়াল মাদ্রিদে পাড়ি জমানো লুইস ফিগো আছেন রিয়াল মাদ্রিদের স্কোয়াডে, নিজেদের মাঠে তাঁকে একটু ‘সমাদর’ করার ইচ্ছাও জেগেছিল বার্সেলোনার পাঁড় সমর্থকদের সংগঠন ‘বইসোস নয়েস’-এর মধ্যে। ফিগো এলেন, খেললেন। বার্সা সমর্থকদের দুয়োধ্বনির শিকার হলেন। এমনকি একটা কর্নার নেওয়ার সময়ে গ্যালারি থেকে তাঁর দিকে ধেয়ে এলো একটা শূকরের মাথাও। যে বইসোস নয়েসের সদস্যরা দুই বছর আগে ফিগোকে ভালোবাসতেন ‘ঘরের ছেলে’ পেপ গার্দিওলার চেয়েও বেশি, তাঁরাই তাঁকে প্রত্যাখ্যান করলেন ঘৃণাভরে। আর ‘ফিগো বনাম বইসোস নয়েস’-এর ওই ঘটনাটা ফুটবল ইতিহাসে জায়গা পেলো সমর্থকদের পাগলামির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে।

    ফুটবলের এমন সব বিখ্যাত পাগলাটে সমর্থকদলের গল্প নিয়েই প্যাভিলিয়নের এই আয়োজন, “ফুটবলের পাগলা ফ্যানরা”। এই সিরিজের তৃতীয় পর্বে থাকছে ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনার পাগলাটে সমর্থকদল “বইসোস নয়েস”-এর গল্পগুলো।

    কাতালান ভাষার “বইসোস নয়েস”-কে (Boixos Nois) ইংরেজিতে অনুবাদ করলে দাঁড়ায় “ক্রেজি বয়েস”। বাংলায় বলা যেতে পারে, “পাগলা ছেলের দল”। ১৯৮১ সালে প্রায় ৫০জন তরুণকে নিয়ে গঠিত হয় এই সংগঠনটি। শুরুতে এই সংগঠনের বেশিরভাগ সদস্যই ছিলেন বামপন্থী, পাশাপাশি কাতালুনিয়ার স্বাধীনতার জন্যও কাজ করতেন তাঁরা। এছাড়া বইসোস নয়েজের একদম শুরুর দিকের কার্যক্রমের মধ্যে ছিল ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনার তৎকালীন সভাপতি ইয়োসেপ নুনেজের পদত্যাগও। তাঁর মতো ‘কর্তৃত্ববাদী’ এবং ‘স্বৈরাচারী’ সভাপতিকে অপসারণের জন্য মাঠে ব্যানার-ফেস্টুন নিয়েও যেতেন সংগঠনের সদস্যরা।

    ওই আশির দশকের পরবর্তী বছরগুলোতে লন্ডনের স্কিনহেড আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ে বার্সেলোনাতেও। ওই আন্দোলনের সাথে জড়িত অনেকে যোগ দেন বইসোস নয়েসেও। এই নতুন ভাবধারার সদস্যদের আধিক্যের কারণে বইসোস নয়েসের রাজনৈতিক মতাদর্শ ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে থাকে, সোশ্যাল-লিবারেলিজম থেকে ফ্যাসিবাদের দিকে। এই কারণে সংগঠনের অভ্যন্তরে কিছুটা দ্বিধাবিভক্তি এবং দলাদলি শুরু হয়। কাতালুনিয়ার স্বাধীনতার প্রশ্নেও দুই ভাগে ভাগ হয়ে যান তাঁরা, তাতে বার্সা সমর্থকদের মধ্যে উদারমনা পক্ষের সংগঠন পেনিয়া আলমোগেভারসের সাথেও মুখোমুখি অবস্থানে চলে যান তাঁরা। ওদিকে ক্লাবের সাথে কিন্তু ভালো সম্পর্কই বজায় থাকে বইসোস নয়েসের। তাঁদের জন্য ম্যাচের টিকেট এবং যাতায়াত ফ্রি করে দেওয়া হয় ক্লাবের পক্ষ থেকে, ক্যাম্প ন্যুতে নিজেদের ব্যানার রাখার জন্য স্টোরেজ রুমের সুবিধাও পান তাঁরা।

    ১৯৮৫ সালের ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনালের আগে বেলজিয়ামের হেইসেল স্টেডিয়ামে ঘটে যায় দুর্ঘটনা। জুভেন্টাস-লিভারপুল মুখোমুখি হওয়ার আগে লিভারপুল সমর্থকদের আক্রমণে ভেঙে পড়ে পুরোনো হয়ে যাওয়া ওই স্টেডিয়ামের একটা দেয়াল। মর্মান্তিক ওই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ৩৯ জন সমর্থক, আহত হন ছয় শতাধিক।

    কিন্তু ওই ঘটনার পর বিতর্ককে আরো বাড়িয়ে দেয় বইসোস নয়েস। ক্যাম্প ন্যুর দক্ষিণ গ্যালারিতে তারা ব্যানার প্রদর্শন করে, “গ্রাসিয়াস লিভারপুল!” (ধন্যবাদ, লিভারপুল)। এর সাথে বার্সার প্রচলিত কাতালান পতাকার পরিবর্তে ওড়ায় ‘স্বস্তিকা’ পতাকা। তাঁদের এমন কাজে ক্ষেপে যান সভাপতি নুনেজ, দক্ষিণ দিকের গ্যালারি থেকে তাঁদের সরিয়ে ক্যাম্প ন্যুয়ের তৃতীয় তলায় পাঠিয়ে দেন। বইসোস নয়েসও তাদের কাজের ধরনে কিছুটা পরিবর্তন আনে। স্টেডিয়ামের বাইরে আগের মতোই তাদের কার্যক্রম চালিয়ে গেলেও, স্টেডিয়ামের ভেতরে কোনো ধরনের বিতর্কিত কাজ না করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফিরে পায় তাদের দক্ষিণ গ্যালারির জায়গা।

    এরপর গ্যালারিতে কিছুদিন শান্ত থাকলেও মাঠের বাইরে বইসোস নয়েস হয়ে ওঠে বেপরোয়া। ১৯৯১ সালের ২২ আগস্ট, নগরপ্রতিদ্বন্দ্বী এসপানিওলের একজন সমর্থককে খুন করার অভিযোগে বইসোস নয়েসের সদস্য ফ্রেডেরিক রৌকিয়েরের ২৬ বছরের জেল হয়। একই বছরের অক্টোবরে আরো একটা খুনের অভিযোগ আসে বইসোস নয়েসের কিছু সদস্যের বিরুদ্ধে।

    ২০০০ সালে বার্সেলোনার সভাপতির পদ থেকে সরে যান ইয়োসেপ নুনেজ। তাঁর জায়গা নেন সহসভাপতি গ্যাসপার্ট। দায়িত্ব পেয়েই বইসোস নয়েসের প্রতি নিজের দুর্বলতার কথা মিডিয়ার সামনে প্রকাশ করেন গ্যাসপার্ট। এমনকি সভাপতির পদ ছাড়ার পরে তিনি নিজেই যে বইসোস নয়েসে যোগ দেবেন, সেটাও জানিয়ে দেন। তাঁর কথায় যেন বাড়তি উৎসাহ পেয়ে যায় বইসোস নয়েস, আড়ালে-আবডালে তাদেরকে ‘দ্য চেয়ারম্যান’স বয়েজ’ বলেও ডাকতে শুরু করেন অনেকে।

    ওই বছরের জুলাইতেই বার্সেলোনা থেকে সরাসরি রিয়াল মাদ্রিদে পাড়ি জমান পর্তুগিজ তারকা লুইস ফিগো। এই ট্রান্সফারের কিছুদিন আগেও কেউ ভাবতে পারেননি যে এমনটাও সম্ভব, আর ফিগোর পক্ষ থেকেও কিছু জানানো হয়নি। তাই স্বাভাবিকভাবেই এই ঘটনা বার্সার সমর্থকদের কাছে এসেছিল বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো, আর এর বিরুদ্ধে কড়া প্রতিক্রিয়া জানায় বইসোস নয়েস। ২০০০ সালের নভেম্বরে, লা লিগার মৌসুমের প্রথম এল ক্লাসিকো খেলতে ক্যাম্প ন্যুতে আসে রিয়াল মাদ্রিদ। শুধু অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি আর দুয়োধ্বনি নয়, ওই ম্যাচে ফিগোর জন্য বরাদ্দ ছিল গ্যালারি থেকে উড়ে আসা নকল টাকা, কাচের বোতল সহ আরো অনেক কিছু। বইসোস নয়েস যেন পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দেয়, এককালে ক্যাম্প ন্যু হয়তো ফিগোর হোম ভেন্যু ছিল, কিন্তু এখন এখানে তিনি একেবারেই অনাহূত।

    ফিগো ন্যু ক্যাম্পে আবারও খেলতে আসেন দুই বছর পরে, ২০০২ সালের নভেম্বরে। সেবারও তাঁর জন্য একই ব্যবস্থা করে বইসোস নয়েস। দুয়োধ্বনি, হুইসেল বাজানো, গ্যালারি থেকে বোতল ছুঁড়ে মারা তো ছিলই, এর সাথে কর্নার নেওয়ার সময়ে তাঁর দিকে ছুটে এসেছিল একটা শূকরের মাথাও। এসব নিরাপত্তাজনিত কারণে ম্যাচটাও বন্ধ ছিল ১৩ মিনিট। 

    এরপর ২০০৩ সালে আবারও সভাপতি নির্বাচন হয় বার্সেলোনায়। ওই নির্বাচনে হোয়ান লাপোর্তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মাঠে ছিলেন লুইস ব্যাসাত। এই লুইস ব্যাসাত আবার ছিলেন ইহুদি-ধর্মাবলম্বী। নির্বাচনের আগে ব্যাসাত এবং ইহুদি ধর্মের বিরুদ্ধেও ক্যাম্পেইন করতে দেখা যায় বইসোস নয়েসকে। সব মিলিয়ে, নির্বাচনে জিতে যান হোয়ান লাপোর্তা। কিন্তু নির্বাচনে জিতেই বইসোস নয়েসকে ক্যাম্প ন্যুতে নিষিদ্ধ করেন হোয়ান লাপোর্তা, সাথে বাতিল করেন আগের সব সুযোগ-সুবিধা।

    বইসোস নয়েসও এর কড়া উত্তর দেয়। লাপোর্তার বাড়ির দেয়ালে লিখে দেওয়া হয় মৃত্যুর হুমকি, ২০০৪ এর ফেব্রুয়ারিতে বইসোস নয়েসের দুজন সদস্য তাঁকে আক্রমণও করে। তবুও লাপোর্তা, বা পরবর্তীতে সান্দ্রো রোসেল বা ইয়োসেপ মারিয়া বার্তোমেউ তুলে নেননি বইসোস নয়েসের নিষেধাজ্ঞা।

    ক্যাম্প ন্যু অথবা মন্টজুইচ, এই মুহূর্তে বার্সেলোনার হোম ভেন্যুতে বইসোস নয়েস নিষিদ্ধ। তবে অনেক ক্ষেত্রে বেনামে ক্যাম্প ন্যুয়ের উত্তর গ্যালারিতে তাঁরা উপস্থিত থাকেন। এছাড়া অ্যাওয়ে বা নিরপেক্ষ ভেন্যুতে বার্সেলোনার খেলা থাকলে অনেক সময়ে বইসোস নয়েসের কিছু উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ২০১৫ চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে জুভেন্টাসকে হারানোর পরে বার্লিনের অলিম্পিয়াস্তাদিওনে লিওনেল মেসির হাতে দেখা গিয়েছিল বইসোস নয়েসের পতাকা। 

    তবে মাঠে নিষিদ্ধ হলেও, মাঠের বাইরে বইসোস নয়েসের ‘কুকীর্তি’ কমেনি। ২০১৪ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগের ম্যাচ খেলতে কাতালুনিয়ায় এসেছিল প্যারিস সেইন্ট-জার্মেইন। তখন পিএসজির দুজন সমর্থককে ছুরিকাঘাতে আহত করার অভিযোগ এসেছিল বইসোস নয়েসের কিছু সদস্যের বিপক্ষে। ২০২০ সালে এসপানিওল বি দলের বিপক্ষে বার্সেলোনার বি দলের ম্যাচে বইসোস নয়েস জোর করে মাঠে ঢুকে পড়ে নাৎসি স্লোগান দিয়েছিল, এমন অভিযোগও রয়েছে তাদের বিপক্ষে। 

    তবুও, বিভিন্ন সময়ে বইসোস নয়েসকে ফেরানোর দাবি উঠতে দেখা গেছে বার্সেলোনার সমর্থকদের মধ্যে। ২০২১ সালে ইউরোপা লিগের ম্যাচে, হোম ভেন্যু ক্যাম্প ন্যুতেই ‘সংখ্যালঘু’ হয়ে পড়েছিলেন বার্সেলোনার সমর্থকেরা। সফরকারী আইনট্রাখট ফ্রাঙ্কফুর্টের সমর্থকদের আধিক্য, তাঁদের সাদা জার্সি, সাদা পতাকা এবং মুহুর্মুহু স্লোগানে হতভম্ব হয়ে পড়েছিলেন বার্সার সমর্থকেরা। বার্সাও ম্যাচটা হেরেছিল অবিশ্বাস্যভাবে। ওই ম্যাচের পরে বার্সা সমর্থকদের অনেকেই বইসোস নয়েসকে ক্যাম্প ন্যুতে ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছিলেন। এছাড়া এল ক্লাসিকো বা এমন কোন বড় ম্যাচে বইসোস নয়েসকে মাঠে ঢুকতে দেওয়ার দাবিও ওঠে নিয়মিতই। 

    সব মিলিয়ে, মাঠের বাইরে চরম বিতর্কিত এই সংগঠনটির সদস্যরা কাতালুনিয়ার স্বাধীনতার প্রশ্নে  এখনো দ্বিধাবিভক্ত, কিন্তু কাতালান ক্লাব বার্সেলোনাকে সমর্থনের ব্যাপারে তাঁরা ঐক্যবদ্ধ। যেকোন মূল্যে প্রতিপক্ষকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে মেরুন-নীলের ক্লাবটিকে বিজয়ীর বেশে মাঠ ছাড়তে দেখতে চান তাঁরা, কিন্তু সেই চাওয়ার জন্য সময়ে সময়ে খেলোয়াড়ি চেতনার বিরুদ্ধে চলে যাওয়াটাই অনেকের কাছে অজনপ্রিয় করে তোলে তাঁদের।