• ক্লাব ফুটবল
  • " />

     

    ফুটবলারদের এসিএল চোট ও পুনর্বাসন: কী, কেন, কীভাবে?

    ফুটবলারদের এসিএল চোট ও পুনর্বাসন: কী, কেন, কীভাবে?    

    ৬ অক্টোবর ২০২৪।

    সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে স্বাগতিক রিয়াল মাদ্রিদের মুখোমুখি হয়েছে সফরকারী ভিয়ারিয়াল। ম্যাচের সময় শেষ হতে মাত্র এক মিনিট বাকি। মাঠের ডানপাশের টাচলাইনে কাছে বল দখলের জন্য লড়াই করছিলেন ভিয়ারিয়ালের ইয়েরেমি পিনো এবং রিয়াল মাদ্রিদের দানি কারভাহাল।

    হঠাৎ মাটিতে পড়ে গেলেন কারভাহাল, শোনা গেল তাঁর আর্তচিৎকারও। নিজের ডান হাঁটু ধরে কাতরাতে শুরু করলেন তিনি, ততক্ষণে সতীর্থদের পাশাপাশি ছুটে এসেছেন দলের ফিজিও-ও। প্রচণ্ড ব্যথায় এরপর আর উঠে দাঁড়াতে পারেননি তিনি, স্ট্রেচারে করেই মাঠ ছাড়তে হয়েছে তাঁকে। পরবর্তীতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা গেল, এসিএল ছিঁড়ে যাওয়ায় মৌসুমটাই শেষ হয়ে গেছে দানি কারভাহালের। 

    Image Source: Getty Images

    কারভাহাল একা নন, এসিএল ইনজুরিতে পড়ে চলতি মৌসুমটা শেষ হয়ে গেছে ম্যানচেস্টার সিটির রদ্রি, বার্সেলোনার মার্ক বের্নাল, মার্সেইয়ের ভ্যালেন্টিন কার্বোনি প্রমুখেরও।

    এসিএল কী?

    এসিএল বা অ্যান্টেরিওর ক্রুশিয়েট লিগামেন্ট অবস্থান করে মানুষের উভয় হাঁটুতে। অ্যান্টেরিওর অর্থ ‘অগ্র বা সামনের দিকে অবস্থিত’, ক্রুশিয়েট অর্থ ‘ক্রস-আকৃতির’, আর লিগামেন্ট বলতে বোঝায় অস্থিবন্ধনীকে। হাঁটুর ওপরের হাড় ফিমারের সাথে হাঁটুর নিচের হাড় ফিবুলা এবং টিবিয়ার সংযোগস্থলে এসিএলের অবস্থান।

    বলে রাখা ভালো, এই সংযোগস্থলে অ্যান্টেরিওর ক্রুশিয়েট লিগামেন্ট ছাড়াও রয়েছে পোস্টেরিওর ক্রুশিয়েট লিগামেন্ট এবং ল্যাটারাল ও মিডিয়াল কোল্যাটারাল লিগামেন্ট। এদের মধ্যে অ্যান্টেরিওর ক্রুশিয়েট লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেলে বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাকে এসিএল ইনজুরি বলা হয়।

    Image Source: Atlanta Bone and Joint Specialists

    এসিএল ইনজুরির কারণ

    অনেকেই এসিএল ইনজুরির জন্য খেলোয়াড়দের অতিরিক্ত ওয়ার্কলোডকে দায়ী করেন। তবে তা পুরোপুরি সত্য নয়। অন্য অনেক ইনজুরির জন্য ওয়ার্কলোড দায়ী হলেও এসিএল ইনজুরির জন্য ওয়ার্কলোড সরাসরি দায়ী নয়। মূলত তিনটা কারণে এসিএল ইনজুরি হয়ে থাকে।

    ১। কন্ট্যাক্ট মেকানিজম

    প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের সাথে সংঘর্ষের ফলে এসিএল ইনজুরি হতে পারে। দানি কারভাহালের ক্ষেত্রেই তেমনটা দেখা গেছে। 

    ২। নন-কন্ট্যাক্ট মেকানিজম

    প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়ের সাথে সংঘর্ষ না হলেও এসিএল ইনজুরি হতে পারে। দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ গতি কমিয়ে ফেলতে চাইলে, বা দ্রুত ঘুরতে গিয়ে, কোন মুভমেন্টে হাঁটুর ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়লে লিগামেন্টে চোট পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। 

    ৩। রিস্ক ফ্যাক্টর

    অনেক খেলোয়াড়ের দৈহিক, জিনগত এবং বায়োমেকানিক্যাল কারণে এসিএল ইনজুরির শঙ্কা বেশি থাকে। হাঁটুর সংযোগস্থলে শিথিলতা, মাসল ইমব্যালান্স বা আগের ইনজুরির রেকর্ড থাকলে এসিএল ইনজুরির সম্ভাবনা থাকে।

    Image Source: Getty Images

    এসিএল ইনজুরির লক্ষণ

    এসিএল ইনজুরিতে পড়লে সাথে সাথে হাঁটুতে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। অনেকের ক্ষেত্রে হাঁটুতে ‘কট’ করে একটা শব্দ হয়। এরপর হাঁটু ফুলেও যায়, আর খেলোয়াড়ের পক্ষে হাঁটু নড়ানো সম্ভব হয় না। ওই হাঁটুর ওপরে ভর দিয়ে দাঁড়ানো সম্ভব হয় না। এ সময়ে স্পোর্টস অ্যাক্টিভিটিজ তো দূরের কথা, ঠিকঠাক হাঁটাহাঁটি করাও কষ্টকর হয়ে যায় খেলোয়াড়দের জন্য।

    কীভাবে শনাক্ত করা হয় এসিএল ইনজুরি?

    কোন খেলোয়াড় এসিএল ইনজুরিতেই পড়েছেন কিনা, সেটা শনাক্তকরণের জন্য কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়। প্রথমেই খেলোয়াড়ের মেডিক্যাল ইতিহাস দেখা হয়। চোটের ধরন এবং চোটে পড়ার কারণ বিশ্লেষণ করা হয়। খেলোয়াড়টি এই ধরনের চোটে আগে কখনো পড়েছেন কিনা, সেই ইতিহাসও দেখা হয়। এরপর খেলোয়াড়ের বর্তমান শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হয়। হাঁটুর অবস্থা কী, হাঁটু ফুলে গেছে কিনা, কতটুকু নাড়াতে পারছেন বা হাঁটুর ওপর কতটুকু ভর দেওয়া যাচ্ছে, পর্যবেক্ষণ করা হয় এর সবই। এরপর কিছু বিশেষ টেস্টের মাধ্যমে এসিএলের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করা হয়। যেমন ল্যাচম্যান টেস্ট, অ্যান্টেরিওর ড্রয়ার টেস্ট, পিভট টেস্ট, ইত্যাদি। সবশেষে লিগামেন্টের অবস্থার ছবি পাওয়ার জন্য এমআরআই বা এক্সরে করা হয়। এগুলোর মাধ্যমে এসিএলের অবস্থা নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি আশেপাশের অন্যান্য লিগামেন্ট বা হাড়ের কোন চোট আছে কিনা, সেটাও বোঝা যায়।

    এসিএল ইনজুরির রিহ্যাব

    এসিএল ইনজুরি যেমন মারাত্মক, তেমনি এর পুনর্বাসনও অনেক সময়সাপেক্ষ। ইনজুরি শনাক্ত এবং অপারেশনের পর এই ইনজুরির রিহ্যাবের ক্ষেত্রে অনেকগুলো পর্যায় আছে। 

    ১. অপারেশন-পরবর্তী প্রাথমিক পর্যায় (০-২ সপ্তাহ):

    (i) ব্যথা এবং ফোলা কমানো

    অপারেশনের পর প্রথম কয়েকদিন শুধু হাঁটুতে বরফ দিয়ে ব্যথা এবং ফোলাভাব কমানো হয়।

    (ii) হাঁটুর স্বাভাবিক মুভমেন্ট ফেরানো 

    এরপর ধীরে ধীরে হাঁটুর নড়াচড়ার মাধ্যমে স্বাভাবিক মুভমেন্ট ফেরানোর কাজ শুরু করা হয়।

    (iii) হাঁটুর শক্তি ফেরানো 

    এরপর আস্তে আস্তে হাঁটু ভাঁজ করা ও খোলার মাধ্যমে আশেপাশের মাসলকে অ্যাক্টিভেট করা ও হাঁটুতে শক্তি ফেরানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। রদ্রি এবং দানি কারভাহাল এই মুহূর্তে রিহ্যাবের এই পর্যায়েই রয়েছেন।

    Image Source: X/ Seleccion Espanola Masculina

    ২. মাধ্যমিক পর্যায় (৩-১২ সপ্তাহ):

    (i) হাঁটাহাঁটি করা

    এই প্রক্রিয়ায় ধীরে ধীরে হাঁটুর ওজন ধারণের সক্ষমতা বাড়ানো হয়। শুরুতে ক্র্যাচ ব্যবহার করে, এবং পরবর্তীতে স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা শুরু করা হয়।

    (ii) হাঁটুর রেঞ্জ অব মোশন

    হাঁটু স্বাভাবিকভাবে পুরোপুরি খুলতে ও ভাঁজ করতে পারার মাধ্যমে হাঁটুর ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করা হয়।

    (iii) ব্যালান্স ট্রেনিং

    এরপর ধীরে ধীরে সমতল এবং অসমতল জায়গায় হাঁটাহাঁটির অভ্যাসের মাধ্যমে হাঁটুর ব্যালান্স ঠিক করা হয়।

    (iv) কার্ডিওভাস্কুলার ট্রেনিং

    কার্ডিওভাস্কুলার ট্রেনিংয়ের অংশ হিসেবে ক্রস ট্রেনার বা রোয়িং মেশিন ব্যবহার করা হয়।

    (v) হাঁটুর শক্তি বাড়ানো

    এছাড়া হাঁটু এবং এর আশেপাশের মাংসপেশির শক্তি বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন ব্যায়ামের প্রয়োজন হয়। ধীরে ধীরে পায়ে বেশি ওজন চাপানো হয় এবং অন্যান্য ট্রেনিং করা হয়।

    Image Source: Footballtnt

    ৩. অ্যাডভান্সড পর্যায় (৩-৬ মাস):

    (i) রানিং

    পরবর্তী পর্যায়ে, খেলোয়াড়কে সরলরেখায় জগিংয়ে অভ্যস্ত করা হয়। ধীরে ধীরে দূরত্ব বাড়িয়ে দৌড়, আস্তে আস্তে গতি বাড়ানো-কমানো, দৌড়ের দিক পরিবর্তন, এসব করা হয়।

    (ii) স্ট্রেন্থ ট্রেনিং

    এই পর্যায়ে হাঁটুতে ধীরে ধীরে অল্প থেকে বেশি লোড দেওয়া হয়। বিভিন্ন এক্সারসাইজ এবং ট্রেনিং শুরু হয়।

    (iii) প্লাইমেট্রিক এক্সারসাইজ

    এই পর্যায়ে প্লাইমেট্রিক এক্সারসাইজ বা হাঁটুর শক্তি বাড়ানোর ব্যায়ামের প্রতি জোর দেওয়া হয়। বেসিক জাম্প এবং ল্যান্ডিং শুরু করেন খেলোয়াড়রা।

    (iv) ফুটবল-কেন্দ্রিক ড্রিল

    এই পর্যায়ের শেষ দিকে ফুটবল-কেন্দ্রিক ড্রিল শুরু হয়। দৌড়ের দিক ও গতি পরিবর্তন, ড্রিবলিং, পাসিং, বেসিক হেডিং শুরু করেন খেলোয়াড়রা।

    Image Source: Getty Images

     

    ৪. খেলাধুলায় ফিরে আসা (৬ থেকে ১২ মাস):

    (i) স্ট্রেন্থ ও ফিটনেস টেস্টিং

    খেলায় ফিরে আসার প্রক্রিয়ায় খেলোয়াড়দের মাসল স্ট্রেন্থ ও ব্যালান্স পরীক্ষা করা হয়। এছাড়া ম্যাক্সিমাম অ্যারোবিক স্পিড টেস্টের মাধ্যমে তাদের ফিটনেসও পরীক্ষা করা হয়।

    (ii) স্ট্রেন্থ ট্রেনিং

    ফিটনেস ফেরানোর জন্য খেলোয়াড়দের হাই লেভেল স্ট্রেন্থ এবং কন্ডিশনিং প্রোগ্রাম করতে হয়। এই পর্যায়ে মাসল ইমব্যালান্স দূর করা ও পাওয়ার ট্রেনিংয়ের ওপর জোর দেওয়া হয়।

    (iii) হাই ইন্টেনসিটি স্পোর্ট স্পেসিফিক ট্রেনিং

    খেলোয়াড়দের দৌড়ানোর সময়ে গতি বৃদ্ধির সাথে সাথে নরমাল মুভমেন্ট ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করা হয়। গতি কমানো এবং স্প্রিন্ট নিয়েও কাজ করা হয়। ধীরে ধীরে তাদের লোড বাড়ানো হয়।

    (iv) ট্রেনিং লোড ইন্টিগ্রেশন

    এরপর, রিহ্যাবের শেষ পর্যায়ে খেলোয়াড়ের সর্বোচ্চ ফিটনেসের জন্য কাজ করে তাকে মাঠে খেলার উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়। খেলোয়াড়ের গতি এবং ক্ষিপ্রতা বাড়ানো হয়। এই পর্যায়ে স্কোয়াডের সাথে যুক্ত করে সাবধানতার সাথে তাকে কিছু ড্রিল করানো হয়।

    (v) রিটার্ন টু পারফরম্যান্স

    এরপরই খেলোয়াড় পুরোদমে ট্রেনিং শুরু করতে পারেন। এ সময়ে তাঁকে ট্রেনিংয়ের পুরো লোড দেওয়া হয় এবং ম্যাচের জন্য প্রস্তুত করে তোলা হয়। বার্সেলোনার পাবলো গাভি বা অ্যাস্টন ভিলার টাইরন মিংস এই পর্যায়েই রয়েছেন।

    Image Source: Getty Images

    সব মিলিয়ে, এসিএল ইনজুরিটা যেকোন খেলোয়াড়ের জন্য অভিশাপ-স্বরূপ। একদিকে যেমন অপারেশন এবং রিহ্যাব মিলিয়ে প্রায় এক বছর মাঠের বাইরে থাকতে হয় খেলোয়াড়কে, পাশাপাশি মাঠে ফেরার পর নিজের সেরা ছন্দে ফিরতেও অনেকটা সময় লেগে যায়। খেলোয়াড়ের নিজের ক্যারিয়ার যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, দলও তার থেকে সেরাটা পায় না। বার্সেলোনার আনসু ফাতির মতো চোটের আগে দারুণ ফর্মে থাকা খেলোয়াড়টিও অনেক সময়ে চোটের পর নিজেকে আর খুঁজে পান না। তাই তরুণ খেলোয়াড়দের জন্য এসিএল ইনজুরি একটা আতঙ্কের নাম, নিজের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দলের সবচেয়ে অপছন্দের খেলোয়াড়টাকেও এই চোটে দেখতে চান না কেউ!