অল্প গল্পে অলিম্পিক -৫: দ্বৈরথ, বিতর্ক আর আকাশ ছোঁয়ার গল্প
অল্প গল্পে অলিম্পিক - ১ঃ হারকিউলেসের হাত ধরে
অল্প গল্পে অলিম্পিক - ৪ঃ লজ্জা, আফসোস এবং অন্ধকারের গল্প
‘দ্বৈরথ’
‘কে সেরা’ এই নিয়ে যদি বিতর্কই না থাকে তাহলে আর খেলা দেখে মজা কি? হালের রোনালদো-মেসি, তার আগে পেলে-ম্যারাডোনা, লারা-শচীন-পন্টিং, ক্যালিস-সোবার্স... চাইলে অন্তহীনভাবে এই তালিকা লম্বা করে ফেলা যায়। সেরাদের দ্বৈরথ থাকে বলেই না আমরা আমজনতা একটু উদ্বেল হতে পারি, খেলার মাঠে মর্ত্যে জন্মানো অ্যাথলেটদের থেকে অন্য ভুবনের কলাকৌশল দেখতে পারি!
তবে ‘জন্ম থেকেই দ্বৈরথ’- এ ব্যাপারটির মাঝে বোধ হয় একটু ভিন্নতা থেকেই যায়। জেমস ওভেট আর সেবাস্তিয়ান কো, মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে জন্ম নেয়া এই দুই মাঝারি পাল্লার দৌড়বিদের আবির্ভাব ১৯৭২ সালে, ব্রিটেনের ‘স্কুল ক্রসকান্ট্রি চ্যাম্পিয়নশিপ’ এর মধ্য দিয়ে। হাইস্কুলে থাকা এই দুই অ্যাথলেট কিন্তু একই ট্র্যাকে দৌড়ায়নি, এর আগে একে অপরের নামও শোনে নি। সূচনা থেকে তবুও তাঁরা নিয়তির নাটকীয়তায় ‘দ্বৈরথবদ্ধ’ হয়ে গেছে।
এঁরা দুজন ছিলেন আদর্শ প্রতিপক্ষ- কো উঠে এসেছেন ইংল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূলের গরীব পরিবার থেকে, অপরদিকে ওভেট এর জন্ম উত্তর ইংল্যান্ডের সম্ভ্রান্ত পরিবারে। খর্বকায় কো ছিলেন জন্মগতভাবেই অমিত প্রতিভার অধিকারি, অন্যদিকে ওভেট ছিলেন লম্বা; প্রতিভার চাইতে পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজেকে শাণিত করতেই তিনি ছিলেন বেশি আগ্রহী! আধুনিক যুগে উসাইন বোল্ট তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী আসাফা পাওয়েল বা টাইসন গের সাথে প্রতি বছরই একাধিক মিটে লড়াইয়ে নামেন। এটাই স্বাভাবিক, যুগ যুগ ধরে এটাই চলে এসেছে। কিন্তু কো আর ওভেট ছিলেন নিতান্তই ব্যতিক্রম- একই দেশের অ্যাথলেট হলেও দুজন একসাথে একই মিটে দৌড়িয়েছেনই মাত্র ছ’বার! এর আগে অবশ্য তাঁদের দ্বৈরথের একটা বর্ণনা বলে দেয়া দরকার। ১৯৭৯ সালে কো মাত্র ৪১ দিনের ব্যবধানে ৮০০ মিটার, ১ মাইল এবং ১৫০০ মিটারের বিশ্ব রেকর্ড নিজের করে নেন! ইতিহাসে একই সময়ে এই তিনটি মুকুট মাথায় তুলে রাখার দৃষ্টান্ত তখন পর্যন্ত ঐ একটাই ছিল। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই ওভেটের সেটা ভাল লাগে নি! ‘রেকর্ডের জন্য দৌড়াই না’ বলতে বলতেই ঐ বছরেই পৃথক মিটে তিনটা ইভেন্টেই ওভেট কো এর রেকর্ড ভেঙ্গে দেন, সাথে ১০০০ মিটারের রেকর্ডটাও ভেঙ্গে দিয়ে যেন আহ্বান জানান- ‘পারলে চারটা রেকর্ডই এখন ভেঙ্গে দেখাও তো বাপু’!
ব্রিটিশ গণমাধ্যমে তখন উচ্ছ্বাসের ঢেউ, আসন্ন অলিম্পিকে মাঝারি পাল্লার কোন সোনাই সে দেশের বাইরে যাচ্ছে না এটা তারা একদম ধরেই নিয়েছিল এই ঘটনার পর। মস্কো অলিম্পিকে হলও তাই। ৮০০ মিটার ইভেন্টে সোনা জিতলেন ওভেট, বদলা হিসেবে ১৫০০ মিটারে সোনা জিতলেন কো। মস্কো অলিম্পিক ‘ব্যর্থ’ পরিগনিত হল দুজনের কাছেই- আর আখেরে লাভ হল ব্রিটেনের!
মস্কো অলিম্পিকই কিন্তু শেষ নয়, ১৯৮১ এর আগস্টে কো এক মাইল দৌড়ে নতুন বিশ্বরেকর্ড করেন, ওভেট সেটা ভেঙ্গে দেন, কো আবার সেটা নিজের আওতায় নিয়ে আসেন। এই রেকর্ড ভাঙ্গা-গড়ার খেলা চলেছিল স্রেফ নয় দিনের মধ্যে! পুরো ক্যারিয়ারে কেউ কারো ছায়া মাড়াতে চাইতেন না, এমনকি একজন কোন এক মিটে অংশ নিলে অপরজন সেই মিট এড়িয়ে চলতেন।
ক্যারিয়ার শেষে অবশ্য সেই বরফ ঠিকই গলেছে! দুজনই এখন বেশ ভাল বন্ধু, একসাথে ব্রিটেনের আগামি দিনের অ্যাথলেট তৈরির কারিগর। কো এখন মনে করেন মাঝারি পাল্লার দৌড়ে ওভেট অবিসংবাদিত সেরা। আর ওভেটের মতে কো এর মতো জন্মগতভাবে এত নিখুঁত দৌড়বিদ আর একটিও আসবে না! দ্বৈরথ থাকলেও পারস্পরিক সম্মানই যে দিনশেষে মূল কথা- কো আর ওভেট এর বন্ধুত্ব তো সেটারই প্রমাণ!
‘ব-তে বক্সিং, ব-তে বিতর্ক’
বক্সিং এবং বিতর্ক হাত ধরে চলবে, এটাই বোধহয় অলিম্পিকের চিরন্তন নিয়তি! শুরুটা সেই ১৯২৪ সালে, ব্রিটেনের হ্যারি ম্যালিনকে কোয়ার্টার ফাইনালে পরাজয় বরণ করতে হল ফ্রান্সের রজার ব্রাউসের কাছে। সেটা হতেই পারে, কিন্তু খেলা শেষে রিং এ থাকতেই হ্যারি তার গলা, বুক, ঘাড়ে রজারের দাঁতের কিছু ‘ছাপ’ দেখালেন! কয়েকটা কামড়ের দাগ থেকে রক্তও ঝরছিল! এমন অখেলোয়াড়োচিত আচরণের পর স্বাভাবিকভাবেই বিচারকরা রজারকে জয়ী রাখেননি। আর প্যারিস অলিম্পিকের দর্শকরা ঘরের ছেলের এই সোনা কেড়ে নেয়াকে গণ্য করল ‘অবমাননা’ হিসেবে। রিং এ শুরু হল ‘গণ-বক্সিং’, দর্শকদের পাঞ্চের আঘাতে পরাস্ত হলেন জাজ মহোদয়গণ! পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশের লাঠিচার্জও করতে হল!
বক্সিংয়ে খেলোয়াড় ‘ডিসকোয়ালিফাইড’ হওয়াটাও নৈমিত্তিক। কিন্তু ১৯৬০ রোম অলিম্পিকে একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত দেয়ার জন্যে ম্যাচ রেফারি আর জাজদেরকেই ‘ডিসকোয়ালিফাইড’ করে দেয়া হয়! ১৯৬৮ টোকিও অলিম্পিকে ডিসকোয়ালিফাইড হবার জ্বালা সইতে না পেরে একজন বক্সার তো জাজদেরই ঘুসি মেরে বসেন, আরেকজন রিং এর মধ্যেই ঘন্টাখানেক প্রতিবাদ স্বরূপ বসে থাকেন!
১৯৮৮ সালের কাহিনীটা অবশ্য আগের সবকিছুকেই ছাপিয়ে গেছে। আমেরিকান রয় জোন্স জুনিয়র আর কোরিয়ান পার্ক সি হুন মুখোমুখি হলেন লাইট মিডলওয়েট শ্রেণীর গোল্ড মেডেল ম্যাচে। তখন তো টেলিভিশন ক্যামেরা বেশ শক্তিশালী, খেলাকে আরো প্রাণবন্তভাবে সারা বিশ্বের দর্শকদের কাছে পৌঁছে দিতে অনেক রকম প্রযুক্তি এসে গেছে। এনবিসির পাঞ্চ রেকর্ডার অনুসারে রয় নিশ্চিতভাবেই ২০-৩, ৩০-১৫, ৩৬-১৪ স্কোরে পরিস্কার ব্যবধানে পার্ককে হারালেন। কিন্তু ‘বেরসিক’ রেফারি জয়ী ঘোষণা করলেন পার্ককে! পার্ক নিজেও ব্যাপারটি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না এটা তাঁর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। হতবাক রয় জোন্স পুরোটা সময় বিষ্ফোরিত নেত্রে রয়কে পদক নিতে দেখলেন, নিজের রূপার পদকটা গলায় পড়ানোর সাথে সাথেই খুলে ফেললেন।
এই নির্লজ্জ জালিয়াতির পর স্বাভাবিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদপত্রে বিষ্ফোরণ ঘটে গেল। সংবাদপত্রেরই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এল যে, ঐ ম্যাচের জাজ আর রেফারিদের ঘুষ দেয়া হয়েছে। ঘরের ছেলেকে সোনা জিতানোর জন্যে কোরিয়ান আয়োজকরাই নাকি এই কাজ করেছেন! কেউ কেউ তো এতে সোভিয়েত প্রপাগান্ডা বাস্তবায়নেরও গন্ধ পেলেন। ১৯৯৭ সালে আইওসির তদন্ত প্রতিবেদনে অবশ্য এর কিছুই প্রমাণ করা যায়নি। পাঞ্চ কাউন্টার যেহেতু টুর্নার্মেন্ট আওতাভুক্ত কিছু ছিল না - তাই রেফারিদের রায়কেই সঠিক মনে করে আইওসি আর পার্কের স্বর্ণ পদকটি কেড়ে নেয়নি। নিয়মের বেড়াজালে আটকে আর প্রমাণের অভাবে রয় জোন্সকে তাই আজো সোনা জিতে রূপা পাওয়ার সান্ত্বনা নিয়ে থাকতে হচ্ছে!
‘এডি দ্য ঈগল’
এডির গল্পটি সামার অলিম্পিকের নয়! তবে গল্পের সূত্রপাত ১৯৭২ সামার অলিম্পিকের হাত ধরেই।
ব্রিটেনে জন্ম নেয়া এডির জন্মগতভাবেই পায়ে সমস্যা, জীবনের প্রথম দশ-বার বছর তাকে ব্রেস পড়েই কাটাতে হয়েছে, স্কুলে যেতে বগলদাবা করতে হয়েছে ক্রাচ! পায়ের প্রকট সমস্যার জন্যে অধিকাংশ সময়ই থাকতে হত হাসপাতালে, সময় কাটানোর জন্য পড়তে হত বই। ‘দ্য গ্রেটেস্ট মোমেন্টস অব অলিম্পিক’ বইটার সাথে এডির সখ্যতার শুরু তখনি। এডি পেয়েছিল ১৯৭২ মিউনিখ অলিম্পিকের সংস্করণটা। অ্যাথলেটদের জাতীয়তাবোধ, খেলোয়াড়ি চেতনা আর অতুলনীয় সম্মান শিশু এডির মধ্যে অলিম্পিয়ান হবার বীজ বুনে দেয়। একজন ‘অলিম্পিয়ান’ হওয়াই হয়ে উঠে তার জীবনের লক্ষ্য।
কিন্তু যে শিশু জন্ম থেকেই ক্রাচ ছাড়া হাঁটতে পারে না আর বার বছরে এসে হাঁটুর ব্রেস ছাড়া প্রথম দাঁড়ানো শেখে, অলিম্পিয়ান হবার স্বপ্নটা তার কাছে অবাস্তবিক ব্যতীত তো আর কিছুই নয়। এডির সাফল্যটা আসলে সেখানেই, ফিল্ড এন্ড ট্র্যাকে প্রথমে চেষ্টা করেছে খেলোয়াড় হবার, সাঁতারে গিয়েছে, শ্যুটিংয়ে গিয়েছে। প্রত্যেকবারই কোচ বলেছেন ‘তোমাকে দিয়ে হবে না’। এডি এরপরও থামে নি, সামার অলিম্পিকের স্বপ্ন বাদ দিয়ে অতঃপর সে স্কিইং কে খেলা হিসেবে নিয়েছে। এখানে কিন্তু এডি খারাপ করে নি, তবে জাতীয় পর্যায়ে থেকে অলিম্পিকে যাবার মত যোগ্যতাও সে অর্জন করতে পারেনি। ফলশ্রুতিতে ১৯৮৮ সালের ক্যালগারি উইন্টার অলিম্পিক গেমসের ব্রিটিশ দলে এডির জায়গা হয়নি।
এরপরই এডির সিদ্ধান্ত স্কি জাম্প করার! আমাদের দেশে শীতকালীন অলিম্পিকের কোন কিছুই প্রচলিত নয়, স্কি জাম্পিং নিয়ে সেজন্যেই একটু বলা দরকার। এটি হচ্ছে অনেক উঁচু থেকে স্কিইং করে নেমে লাফ দেয়ার একটি প্রতিযোগিতা! বিজয়ী নির্ধারিত হয় অতিক্রান্ত দূরত্ব আর লম্ফকারীর নৈপুণ্য বিচার করে। দূরত্ব অতিক্রমই তাই এখানে শেষ কথা নয়, নিখুঁতভাবে লাফ দেয়াটাও এই খেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে এটি বেশ জনপ্রিয় একটি খেলা। তবে এ খেলার বিপদও অনেক। স্কিইং, টেকঅফ এবং ল্যান্ডিং এ সামান্য গোলমাল হলেই বিপদ অবধারিত। হাত-পা ভাঙ্গা এই ইভেন্টে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা, ঘাড় ভেঙ্গে মৃত্যুর ইতিহাসও এই খেলায় অজস্র।
স্ক্যান্ডিনেভিয়াতে ৫-৬ বছর বয়স থেকে এই খেলার তালিম দেয়া চলে, ক্ষণিকের সিদ্ধান্তে অলিম্পিকের ৫ মাস আগে থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এই খেলায় অংশ নিতে চাওয়া আর নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে নিজেকে সঁপে দেয়ার মধ্যে এজন্যেই তাই পার্থক্য নেই! এডির বাবা-মা এজন্যেই এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন। উপায় না দেখে এডি পালালো বাড়ি থেকে, গেল জার্মানিতে স্কি জাম্পের ট্রেনিং এর জন্যে। অর্থ ছিল না বলে প্রচণ্ড শীতের মধ্যে রাত কাটালো পানশালায়, আনাড়িপনার দরুন স্বীকার হল নানা দেশের অলিম্পিয়ানদের কটুক্তির। ঝামেলা এখানেই শেষ নয়, ব্রিটিশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনও কোনভাবেই চাচ্ছিল না এডিকে কানাডায় পাঠানো হোক। যেখানে পদকের কোন আশাই নেই সেখানে এডিকে পাঠানো নেহায়েত টাকার অপচয় এ ছিল তাঁদের যুক্তি।
এসব বাধাই এডি অতিক্রম করেছিল, ক্যালগারিতে গিয়ে পূরণ করেছিল তার আশৈশব অলিম্পিয়ান হবার স্বপ্নটাও। নাহ, এডি ওখানে গিয়ে কোন রূপকথা ঘটায় নি, ৭০ মিটার এবং ৯০ মিটার দুই উচ্চতা থেকে দেয়া লাফেই সে হয়েছিল ‘লাস্ট’। ব্রিটেনে এই খেলার চল নেই বলে তার সেই ‘লাস্ট’ হওয়াটাই ব্রিটেনে জাতীয় রেকর্ড হিসেবে টিকে ছিল অনেক বছর! কিছুটা অস্বাভাবিক আচরণ আর শেষে থেকেও ‘জাতীয় রেকর্ড’ করার আনন্দে লম্ফঝম্ফ করার জন্যে গেমসের ‘আইকনিক ফিগার’ ছিল এডি। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ছাড়াও অন্যান্য দেশের সাংবাদিকদেরও এডিকে নিয়ে আগ্রহ ছিল তুঙ্গে। তথাকথিত ‘ক্রিপলড’ হয়েও অলিম্পিয়ান হওয়ার উদাহরণ যে খুব বেশি নেই।
এডি ‘লাস্ট’ হবার পরও তাই উপাধি পায় ‘দ্য ঈগল’। দেশে এসে পায় বীরোচিত সংবর্ধনা। ব্যারন পিয়েরে দ্য কুবার্তিন যদি তখন বেঁচে থাকতেন তাহলে ‘এডি দ্য ঈগল’ এর উপর নিশ্চিতভাবেই অনেক অনেক প্রসন্ন হতেন। পুঁজিবাদী আধুনিক সমাজব্যবস্থায় অলিম্পিকের চেতনা তুলে ধরার জন্যে এডির মত লোকের যে খুবই অভাব!
পরের পর্বঃ